22/10/2025
#পাঠপতিক্রিয়া
দেবরাজ রায় লিখলেন -
ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড
বইটা সম্পর্কে লেখার আগে বইটা সম্পর্কে সামান্য FAQ দেওয়া উচিত। 1932 সালে প্রকাশিত হওয়া বইটিকে ‘মডার্ন লাইব্রেরী’ 1998-99 সালে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ 100 টি ইংরেজি বইয়ের তালিকায় পঞ্চম স্থান দেয়। এছাড়া আমেরিকান লাইব্রেরী অ্যাসোসিয়েশনের সেরা 100 নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায়ও বইটি স্থান করে নেয়।
একটা বই পড়ে সেই বইয়ের ইতিহাস আগে কখনও এভাবে খুঁজিনি, কিন্তু এই বইয়ের ক্ষেত্রে সেটা করতে হয়েছে। আর বইটার প্রথম দুটো অধ্যায় পড়লে পাঠক নিজের থেকেই বুঝবে কেন বইটা নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় স্থানলাভ করেছে।
কাহিনীর প্রেক্ষাপট ভবিষ্যতের লন্ডনে, আরো বিস্তারে বললে 2540 খ্রিস্টাব্দ বা 640 After Ford সালের কাছাকাছি সময়কালে। সেখানে সমাজ ব্যবস্থার যে ছবি আঁকা হয়েছে সেটা আমাদের অপরিচিত। এখানে বলা উচিত, ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস গুলোতে সাধারণত সামাজিক অবক্ষয়, ধ্বংসের পরের পৃথিবী এরকম প্রেক্ষাপট হয়, তবে সেই কাহিনীগুলোতে সমাজব্যবস্থার চিত্র মোটামুটি আমাদের পরিচিত হই, কিন্তু রীতিনীতি সামান্য পাল্টে দিলেও মোটের উপর আমরা relate করতে পারি। কিন্তু এই কাহিনী সেটা না, আর পরিচিত সামাজিক সকল ধ্যানধারণাকেও এভাবে কোনো উপন্যাসে ভেঙে পড়তে দেখিনি। অরওয়েলের 1984 উপন্যাসে যে সমাজচিত্র আঁকা হয়েছিল সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র ভয় আর দমনের মাধ্যমে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছিল, কিন্তু ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ডে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বৈভব, জাগতিক সুখসুবিধার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে মানুষ ভাবে যে তারা মুক্ত বিহঙ্গ।
সামাজিক ধ্যানধারণা ভেঙে ফেলার কথা লিখেছিলাম, কটা উদাহরণ দেওয়া প্রয়োজন সেগুলো বোঝার ক্ষেত্রে -
১. কাহিনীর জগতে কোনো শিশু আর মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নেয় না, সবাই টেস্ট টিউব বেবি, মা বাবা অথবা পরিবারের সম্পূর্ণ ধারণা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, ওই সমাজে মা, বাবা এগুলো অশ্লীল শব্দ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিবাহ নামক institution টাও মুছে গেছে, লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কেউ যখন খুশি নিজের সঙ্গী চয়ন ও পরিবর্তন করতে পারে ওই সমাজে
২. টেস্ট টিউবেও, ভ্রূণ অবস্থায় ঠিক করে দেওয়া হয় কোন ভ্রূণ সামাজিক স্তরবিন্যাসের কোন তলায় অবস্থান করবে। সেই মতো ভ্রূণ পৃথকীকরণ হয়ে গেলে একদম শৈশব থেকেই শিশুদের মনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় যে, যে শিশু যেই স্তরের জন্য নির্ধারিত, সেই স্তরের থেকে ভালো কিছু তার জন্য হতে পারে না। আর সেই স্তর সে ভবিষ্যতে পরিবর্তনও করতে পারবে না, কারণ উন্নতির উচ্চাশা সমাজে হিংসা, বিদ্বেষের মত সমস্যা সৃষ্টি করে
৩. ঈশ্বর ধারণার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিছু সংরক্ষিত রেড ইন্ডিয়ানদের মত উপজাতি ছাড়া কেউ পুরোনো ধর্ম, যেমন হিন্দু খ্রিষ্টান ইসলাম বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জানেও না, মানেও না। কিন্তু তাই বলে কি ধর্ম পুরো মুছে গেছে? না। পুরোনো ধর্মের স্থান নিয়েছে ফোর্ড, হ্যাঁ গাড়ি কোম্পানির হেনরি ফোর্ডের কথাই লিখলাম, 1932 এর হিসেবে ভাবলে যথেষ্ট বলিষ্ঠ নির্বাচন একাধারে নতুন ধর্ম আর রাষ্ট্র জনকের ক্ষেত্রে
৪. মাদক বা ড্রাগ সমাজের প্রয়োজনীয় অঙ্গ, আর রাষ্ট্র নিজে বণ্টন করে সেই মাদক
৫. শিল্প বলতে আমরা যা বুঝি, সেই শিল্পের অস্তিত্ব মুছে দেওয়া হয়েছে সমাজের মন থেকে, কারণ শিল্প চর্চা করতে দেওয়ার অর্থ মানুষ স্বতন্ত্র চিন্তা করবে, সেটা রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদজনক হতে পারে
এবার এতভাবে যদি social structure কে চূর্ণ করা হয়, তাহলে সেই বই অবশ্যম্ভাবী রূপে নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় উঠে আসবেই। আর লেখকের অমরত্ব এইখানেই যে বইটা পড়ার পর পাঠক হিসেবে নিজের মনেই কোথাও যেন এমন সমাজের অংশ হওয়ার মনস্কামনা ফুটে উঠছিল, যদিও রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিষ্কার যে অত্যন্ত degenerated একটা সমাজের কথা লেখক লিখেছেন, হোক না সেই সমাজ বিজ্ঞানে উন্নত। ওই সমাজে কেউ বেকার না, কিন্তু কেউ স্বতন্ত্র, স্বাধীন চিন্তাও করে না… একাধিক গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তার কলমের মাধ্যমে, মানুষ হতে গেলে কি প্রয়োজন? শুধু খাদ্য আর অন্যান্য জাগতিক প্রয়োজনীয়তার পরিপূরণ, নাকি চিন্তাশক্তির বিকাশ, যা অন্য প্রাণীদের থেকে আমাদের পৃথক করে? স্বতন্ত্র পরিচয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নাকি মিলিতভাবে সমাজের অগ্রগতি? প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, জনতার মানসিকতা তাঁদের অবচেতনে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে, এগুলো উচিত না অনুচিত?
কাহিনীর মূল চরিত্র ম্যাক্স বার্নার্ড, যে একজন আলফা প্লাস মনস্তত্ত্ববিদ, সব থেকে উচ্চ সামাজিক স্তরের প্রতিনিধি, যে সকল সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্রের থেকে পেয়েও অন্তরে শূন্যতা অনুভব করে, কারণ তার কাছে সমাজ অতিরিক্ত মেকি। এছাড়া উল্টোদিকে আছে লেনিনা ক্রাউন নামের এক নারী যে বিটা মাইনাস, আলফাদের ঠিক নিচের স্তরের প্রতিনিধি, যে ওই সমাজের প্রতিমূর্তি। এছাড়া রয়েছে জন নামের এক তথাকথিত বন্য 'অসভ্য' , যাকে লন্ডনে নিয়ে আসা হয় সংরক্ষিত অরণ্য থেকে কিন্তু সে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে না নাগরিক মূল্যবোধের সাথে। তবে এ কাহিনী বার্নার্ড এর বিদ্রোহের না, বা কোনো সমাজ পরিবর্তনের কাহিনীও না। এটা শুধু একটা ভবিষ্যতের নতুন সভ্যতার গল্প, যে গল্প পড়ে মনে প্রশ্ন না জাগলে পাঠকের হয় মনোযোগের নাহলে মানসিকতায় সমস্যা আছে এটাই বুঝতে হবে।
আর হ্যাঁ, কল্পবিশ্বের বইয়ের পৃষ্ঠার মান নিয়ে প্রশ্ন বৃথা, আর ছবি দেখে হয়তো বোঝা যাবে না, কিন্তু প্রচ্ছদ চিত্রটা অসাধারণ, আন্তর্জাতিক মানের কাজ ফুটিয়ে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টা লক্ষণীয় এই প্রচ্ছদে, যদিও সত্যি ছবিটা দেখে অনেকেই হয়তো বুঝবে না কেন বললাম এটা, কারণ শুধু তো বইয়ের নাম লেখা আর তার মধ্যে কিছু কারিকুরি করা। কিন্তু যে সাইকেডেলিক আর আবস্ট্রাক্ট স্টাইল ফুটে উঠেছে সেটা অনবদ্য।
প্রকাশক - Kalpabiswa Publications
মুদ্রিত মূল্য - 400 টাকা