23/09/2025
কবি বা লেখক শুনলেই এখনও অধিকাংশ মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। লেখকদের অন্য জগতের প্রাণী বলে একঘরে করে রাখেন। যখন একজন মানুষ লেখক হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিতে শুরু করে, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা আর আগের মতো তেমন একটা কথা বলে না। রাস্তায় বেরোলে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আশেপাশের মানুষজন । সমাজের মূল স্রোতের মানুষের থেকে যেনো আলাদা করে দেয়, অলিখিত ভাবেই । কেউ জিজ্ঞাসা করে কোনো মানসিক সমস্যা হচ্ছে কি না । কেউ বলে প্রেমে প্রতারিত হয়েছে নির্ঘাত।
অথচ কম বেশি বই সবাই কেই পড়তে হয়। বই ছাড়া কেউ বাঁচতে পারবে না। বই পড়তে বা কিনতে সমস্যা নেই, তাহলে যে লেখে তাকে নিয়ে তবে কিসের সমস্যা ?
আবার এই ছোটো, বড়ো লেখকদের লেখা গুলোই যখন বড়ো ইউটিউব ভিডিও তে বেনামে চালিয়ে দেওয়া হয়, কখনো মিম পেজ গুলো নিজেদের দরকার মতো নিজেদের নামে চালায়, যার যখন ইচ্ছা নিজের সুবিধা মতো চালিয়ে দেয় তখন সেগুলো হয় ট্রেন্ড। আর যারা এগুলো সৃষ্টি করলো , তারা হয়ে গেলি আধপাগল। এটাই আধুনিক উন্নত সভ্য সমাজ!
গল্প ,উপন্যাস নিয়ে সিনেমা তৈরি হলে বিশাল মাতামাতি হয়। অথচ যে লিখেছে তাকে কেউ চেনার প্রয়োজন মনে করে না।
কেনো ? শুধু প্রেমে প্রতারিত হয়ে একজন মানুষ লেখক বা কবি হবেন কেনো? স্বতস্ফুর্তভাবে কি লেখক হতে পারেন না ? মানুষ নাচ , গান শেখে ছবি আঁকা শেখে সেটা যেমন স্বাভাবিক এটাও তেমন। একবার ও কেউ এটা ভেবে দেখেন না, যে গানটা আপনি শুনছেন সেটা কেউ লিখেছে , সেও স্বাভাবিক মানুষ , প্রেমে প্রতারিত বা মানসিক রোগী না , মানসিক রোগী তো তারা যারা এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা এখনো সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেন না।
এসব কারণে অনেকে নাম পাল্টিয়ে লেখেন । অনেক এ বেশি বয়সে লেখা শুরু করেন আর কিছু হারানোর নেই বা বুড়ো বয়সে কি আর বদনাম হবেন ,ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে। বলা ভালো অনেক মানুষ সমাজের এই কটূক্তির ভয়ে, নিজের নাম , পরিচয় , ছবি গোপন করে সামাজিক মাধ্যমে নিজের রচনা পোস্ট করেন , তার নিজের জন্য এটা খুব অপমানের ও লজ্জার।
এসব ভেবে অনেকে লিখবো লিখবো ভাবেন কিন্তু কোনোদিন লিখে উঠতে পারেন না । বা লিখলেও নিজের ডাইরিটা বিছানার নীচে লুকিয়ে রাখে।
না আমি সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের কথা বলছি না। উচ্চশ্রেণীর মানুষ এর হাতের নাগালে সব রকম স্বাধীনতাই সহজলভ্য চিরকালই । এই সমস্যা গুলো হয় সাধারণ মানুষদের।
ছেলেরা লেখা শুরু করলে তার কেরিয়ার নষ্ট হয়ে গেলো বলে রব উঠিয়ে দেয় আশেপাশের লোকজন। মেয়েরা লিখলে আর বিয়ে না বলে ছিচিৎকার শুরু করে দেয়। যে যা লেখে সেটা তার নিজের জীবনে ঘটেছে বলে প্রতিবেশীরা , বন্ধুরা নিজেরাই সেটা নিয়ে নতুন উপন্যাস তৈরি করে ফেলেন ।এদের মধ্যে অনেকেরই প্রথাগত শিক্ষা যথেষ্ট আছে।
প্রতিটা লেখককে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করে তুমি কি করো ? তখন সে মাথা নিচু করে বলে , আমি লেখক। তারপর সামনের মানুষটি বলবে ওসব লেখালেখি বাদ দাও তুমি বাস্তবে কি করো ? এটা বন্ধ হওয়া খুব দরকার। এরকম আর কয়েক বছর চললে লেখকরা চিরতরে বিলুপ্ত হবে। একজন শিল্পী যেমন লেখা পাঠ করে বা গান করে সম্মান পান তেমনই সেই গান , কবিতা টা যিনি হৃদয় উজাড় করে রচনা করেছেন সম্মানটা তার ও প্রাপ্য। লেখক বা কবির ও সাধারণ পরিচয় হতে পারে তার রচনার মাধ্যমে।
আমাদের সমাজে বেশির ভাগ লেখক, কবি বা লেখক হয়ে ওঠার আগেই লেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় পরিস্থিতির চাপে। আর লিখে উপার্জন করার কথা , সেটা এখনও আমাদের দেশে স্বপ্নেরও বাইরে । যুগ যুগ ধরে এমন টাই চলে আসছে। তাও কবি লেখক রা কখনো লেখা বন্ধ করেনি। যারা সাহিত্য রচনা করেন ভালোবেসে করেন । কোনো কালেই তারা উপযুক্ত সম্মান পান না জেনেও। বই প্রকাশ করার জন্য প্রকাশক পাওয়া তো ভগবানকে পাওয়ায় থেকে কিছু কম না।
অনেকে আবার বলেন কি হবে লেখা লেখি করে? জগতে কি বইয়ের অভাব? এটা ভেবে যদি সেই সময়ের মানুষরা কিছু বই না লিখতেন আমরা অতীত সম্পর্কে জানতাম কি করে ?
আজ যেটা তৎকালীন সাহিত্য কাল সেটাই ইতিহাস হয়ে যাবে। সেখান থেকেই আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে আমাদের জীবন যাত্রা সম্পর্কে।
অনেকে আবার বলেন বিজ্ঞানের যুগে ইতিহাস পড়ার কি দরকার? সাহিত্য পড়ার কি দরকার ! সাহিত্য চর্চা ব্যাকডেটেড। আচ্ছা এটা ভেবে যদি বিজ্ঞানীরা তাদের থিওরী না লিখতেন তাহলে বিজ্ঞান টা পেতেন কোথায় ? এর পরও কিছু মানুষ বলবে লেখা লিখি অপ্রয়োজনীয়। লেখকরা মাথা মোটা , পিছিয়ে পড়া লোকজন।
এই কথা গুলো যে শুধু ভুল তা নয়। প্রবল সামাজিক অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত।
২০২৫ সালে টেকনোলজির প্রবল উন্নতির শিখরে অবস্থান করার যুগে এই সামাজিক অবক্ষয় মনুষ্যত্বের নিম্নগামিতার সাক্ষ্য বহন করে।
এই ভুল ধারণা গুলো ওই মানুষগুলোর মনে একদিনে তৈরি হয় নি। সঠিক ভাবে তারা ইতিহাস ও সাহিত্য চর্চা করার কারণ আর গুরুত্ব সম্পর্কে জানে না। তাই এই ভুল ধারণা পোষণ করে। এর জন্য তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গাফিলতি দায়ী।
আধুনিক যুগে অধিকাংশ মানুষই ভুলে গেছে সাহিত্য রচনা শুধু সাহিত্য রচনার জন্য না, সাহিত্যে ফুটে ওঠে মানুষের জীবনধারার সবচেয়ে নিখুঁত বর্ণনা নির্ভুল তথ্য যা একজন পেশাদার ঐতিহাসিক এর পক্ষে ফুটিয়ে সম্ভব নয়।কারণ পেশাদার ঐতিহাসিক দের কাজে অনেক রকম প্রতিবন্ধকতা থাকে। ইচ্ছা থাকলেও তারা অনেক তথ্য প্রদান করতে পারেন না।
ইতিহাসের রচনার উপাদান গুলো একজন ঐতিহাসিক সবচেয়ে বেশি তৎকালীন সাহিত্য থেকে পেয়ে থাকেন বেশির ভাগই। তৎকালীন সাহিত্য ছাড়া ইতিহাস রচনার কাজ করা সম্ভব না। আমরা যদি তৎকালীন সাহিত্য চর্চা বন্ধ করে দেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাস রচনার উপাদান কোথায় পাবে ? অতীত ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে আমাদের সবারই কম বেশি এই অভিজ্ঞতা হয়েছে।
সাহিত্য স্বাধীন , সেখানে কোনো দেশ- কাল- সীমানার গণ্ডি নেই। তৎকালীন ইতিহাস এর অনেক গুরত্বপূর্ণ তথ্য ইতিপূর্বে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তৎকালীন সাহিত্য থেকে জানতে পেরেছি যা আমাদের ইতিহাস প্রদান করতে পারে নি বিভিন্ন সংগত কারনে। তাই আমাদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি কিছু দায়িত্ব থেকেই যায় , সাহিত্য কে বাঁচিয়ে রাখার।যাতে তৎকালীন সাহিত্য স্বাধীন ভাবে ইতিহাস রচনার উপাদান রেখে যেতে সক্ষম হয়।
আজকাল আবার শুরু হয়েছে বড়লোকদের নিজেকে কবি সাহিত্যিক হিসাবে আখ্যায়িত করার এক ধারাবাহিক নাটক। যে নাটকে অভিনয় করতে গেলে টাকা খরচ করে সম্মাননা পত্র কিনতে হয়। সেই সম্মাননা পত্র কে প্রদান করে? একদল বড়লোক মানুষ ( টাকাওয়ালা )।সেই সম্মাননা পত্র কিনে লাভ কি ? ড্রয়িং রুম সাজাতে কাজে লাগে। নিজেকে কবি সাহিত্যিক হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। তাঁরা কি লেখেন ? কেউ কেউ যা খুশি তাই লে কেউ লেখা চুরি করেন।
৯০ এর দশকে শুনেছিলাম বড়োলোকের গরীবের কাছ থেকে খুব কম দামে লেখা কিনতেন এখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের কল্যাণে সেই ঝক্কি পোহাতে হয় না। খুঁজে খুঁজে পছন্দ মত বেনামী কোনো লেখকের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়।
আজকাল আবার লিখতে গিয়ে আরেক নতুন সমস্যা। কিছু লিখলেই পাবলিক ধেয়ে আসবে এটা দাবি করতে যে ব্যক্তির লেখা সেই ঘটনা তার নিজের সাথেই ঘটেছে। মানুষ আমার আমার করতে করতে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে আমার বাদ দিয়েও যে কিছু ভাবা যায় , লেখা যায় , করা যায় সেটা ওটা ভাবনাতেই আনতে পারছে না। স্বার্থপরতার সব সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে বর্তমান সমাজ।
সচেতন নাগরিক হিসাবে সবারই উচিৎ লেখক, কবিদের প্রতি এই বস্তাপচা , নিচু দৃষ্টিভঙ্গি গুলো পরিবর্তন করার চেষ্টা করা।গরীব ঘরের মানুষ ,যারা লেখেন তাদের সুস্থ স্বাভাবিক আচরণ করা। শুধু বড়োলোকের ঘরে লেখক জন্মে এই ধারণা বদল হওয়া উচিৎ। এমনি স্বাধীন লেখক বিলুপ্ত প্রায়।সত্যি যেদিন লেখকরা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে সেদিন সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ সভ্যতাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
স্রোতস্বিনী রায়