22/10/2025
কাল সন্ধেয় উদগ্র শব্দবাজিতে ভেসে যাচ্ছিল শহর কলকাতা। হয়তো সমগ্র পশ্চিমবঙ্গই। আর ঠিক তখনই দীপাবলি পালন হচ্ছিল লায়নস রেঞ্জের শতাব্দী প্রাচীন কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জে। এটাই তার শততম দীপাবলি। এবং শেষ দীপাবলি।
কারণ কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চিরতরে। স্বেচ্ছাঅবসর দেওয়া হয়েছে তার কর্মীদের। বিক্রী হয়ে যাচ্ছে তার সম্পত্তি।
দীপাবলি নয়। মৃত্যুঘণ্টা। আর সেটারই উদযাপন করছিল শব্দবাজির তাণ্ডব। আকাশে হলকা ছেটানো আগুন।
মুম্বাই আর কলম্বোর পর কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ এই উপমহাদেশের তৃতীয় প্রাচীন স্টক একচেঞ্জ। ১৯০৮ সালে যখন এই স্টক এক্সচেঞ্জ গঠিত হয় তখনও কলকাতা বৃটিশ রাজের রাজধানী। তখনও কলকাতা এশিয়ার সব থেকে বড় শহর। বিশ্বের প্রথম দশটা শহরের একটা।
চা, কয়লা, জুট, খনিজ, কলকাতা বন্দর – রমরম করে চলত কলকাতার বাণিজ্য। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শেয়ার বাজারও। সে কথার সাক্ষী সেই সময়ের বাংলা সাহিত্য। পঞ্চাশ -ষাট দশকের সিনেমাও। শেয়ার বাজারের ওঠা নামার কথাও।
বাঙালি মনে রাখেনি। তবে এই উপমহাদেশের বাঙ্কিং সিস্টেমও শুরু হয়েছিল এই শহরেই। ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অনেক আগে ব্যাঙ্কিং শুরু করেছিলেন এই শহরেরই এক বাঙালি ‘বামুন’ -চন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়। যিনি অনেক বেশি পরিচিত ছকুবাবু নামে।
ছকুবাবু ছাড়াও ব্রিটিশদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাঙ্কিং সিস্টেম শুরু করেছিলেন সিনেমার শুটিং খ্যাত লাহাবাড়ির লাটুবাবু। যাঁর আসল নাম দুর্গাচরণ লাহা। রামনাথ ঠাকুর, দিগম্বর মিত্র, মতিলাল শীল – কত নাম।
যার সূত্র ধরে কিছুদিন আগে অবধিও কয়েকটা ব্যাঙ্কের সদর দপ্তর ছিল কলকাতাতেই। সেই ব্যাঙ্কগুলোর ব্যালেন্সশিটের কী অবস্থা আমরা জানি। তাদের মধ্যে কতগুলো অন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশে গেছে তাও জানি আমরা।
ঠিক তেমনই হয়েছে কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গেও। সত্তর দশকের পর থেকেই ভারতের নব্যশাসকরা কলকাতা শহর থেকে মুম্বাইতে সরিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করে ক্যাপিটাল। তাদের তৈরি করা লাইসেন্সরাজ গলা টিপে মারে এই শহরের ব্যবসাগুলোকে। খুন করা শুরু হয় এশিয়ার বৃহত্তম শহরকে। আর তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ে তীব্র শ্রমিক অসন্তোষ। আত্মবিধ্বংসী রাজনীতি।
ট্রেডিং ভল্যুমে মুম্বাইয়ের অনেক পিছনে পড়ে যায় কলকাতার স্টক এক্সচেঞ্জ। নতুন ইলেকট্রনিক ট্রেডিং এর প্রকৌশলেও অনেক পিছিয়ে যায় কলকাতার স্টক এক্সচেঞ্জ।
দেশভাগে সব খুইয়ে আসা বিরাট এক জনগোষ্ঠী, সত্তরের দশকের অশান্ত বাম আন্দোলনে হারিয়ে যাওয়া শত শত উজ্জল মুখ, আর এই ভাগীরথীর মতোই শুকিয়ে যাওয়া এই রাজ্যের অর্থনীতি – ছকুবাবু, লাটুবাবু, লর্ড সিনহা, আলামোহন দাশদের উত্তরসূরী বাঙালিরা হয়ে ওঠেন ব্যবসাবিমুখ। ঝুঁকি নয়, এন্টারপ্রাইজ নয়, তার আকাঙ্খা হয়ে দাঁড়ায় কেরানিবৃত্তি, স্কুল্মাস্টারির নির্ঝঞ্ঝাট ক্ষুন্নিবৃত্তি। পঞ্চাশের দশকে প্রশান্তিচন্দ্র মহালনবিশের নেতৃত্বে এশিয়ার প্রথম কম্পিউটার ল্যাবরেটরির শহর, কলকাতারই রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আসল সময়ে, সেই কম্পিউটারেরই তীব্র বিরোধিতা করে বসে।
অবশ্য পরে অদৃষ্টের আশ্চর্য খেয়ালে, নতুন অর্থনীতির সময়ে, সেই কম্পিউটার-কেরানি হওয়াই হয়ে যায় বাঙালির জীবনের সারবত্তা।
ছকুবাবু, লাটুবাবু, মতিবাবু আলামোহন দাশ, রামনাথ-দ্বাররকানাথ ঠাকুর, বীরেন মুখার্জি, রাজেন মুখার্জিরা তো হারিয়েই গিয়েছিলেন। এই শহরের খৈতান, বিড়লা, বাঙ্গুর, জালান, ডালমিয়ারাও ব্যবসার জন্য অন্য শহরের দিকে দিকে মুখ বাড়িয়েছেন। ইন্ডাস্ট্রিয়াস গুজরাতি, পার্সি, সিন্ধিরা তো সেই কবেই চলে যেতে শুরু করেছে কলকাতা থেকে।
শিক্ষিত বাঙালি চাকরি খুঁজতে চলে গেছে বিদেশে, নয় মুম্বাই-দিল্লি-ব্যাঙ্গালুরুতে। আর গরিব বাঙালিকে রাজমিস্ত্রী, গৃহসহায়ক, মুটেগিরির কাজ খুঁজতেও যেতে হয়েছে অন্য শহরে।
এই তো সেদিন, ভাইরাল ভিডিওতে দেখলাম এক মারোয়াড়ি এক বাঙালিকে কলকাতা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে কথা বলার জ্ঞান দিল। ঠিকই করেছে, এই সব ‘চাকর-বাকর’দের ভাষা সে শুনবেই বা কেন?
মজার কথা হল কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ ধ্বংস হতই, তবে তার কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতেছিল এক গুজরাতি। কেতন পারেখ। তার স্ক্যামের পরই মাজা ভেঙে গিয়েছিল এই স্টক এক্সচেঞ্জের।
বাঙালি অবশ্য সে সবও পারে না। তার স্ক্যামের দৌড়ও পঞ্জি চিটফান্ড অবধি।
আমরা কী পারি? অবশ্যই শব্দবাজি ফাটাতে। আকাশের দিকে পটকা ছুড়ে দিতে। পাখি-পশুদের ধ্বংস করে দিতে। কেনই বা পারব না? ভাই শব্দবাজির ট্রেডিং তো চম্পাহাটিতে হয়। বেআইনি বাজি কারখানা তো কয়েকটা হলেও এই রাজ্যেই আছে। বিড়ি আর বাজিই তো আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং। মেড ইন বেঙ্গল।
তাই আসুন ভাই, আমরা শব্দবাজি ফাটাই। হেরো জাত ওর বেশি আর কীই বা পারে?
( সহলেখক শমিক ঘোষের দেওয়াল থেকে নেওয়া )
#উড়োপাতা