
20/07/2025
বর্ষাকাল আমার ভীষণ পছন্দের.... হঠাৎ আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা, টুপ্ টাপ তাল তুলে বাড়ির ছাদে বৃষ্টির সুর কিংবা প্রকান্ড গর্জনসহ মুষলধারে বরিষণ...আমাকে ভাবুক করে তোলে...মনে মনে নানান জলছবি আঁকি যেগুলো বৃষ্টি থেমে রোদ উঠলে আবার রাস্তাঘাটের মতোই শুকিয়ে যায়...
একবার এরকম বৃষ্টি দিনে জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছি...আমাদের ফ্ল্যাটে তখন বারান্দা ছিল না..উপরের ফ্ল্যাটে দুটো বারান্দা..আমি প্রায়ই ওদের ফ্ল্যাটে খেলতে যেতাম আর বারান্দায় গিয়ে রাস্তা দেখতাম..যাক সে কথা..দেখি নিচ দিয়ে একটা লোক ভীষণ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দৌড়াচ্ছে...বাবাকে বললাম "ওই দেখো একটা কালো মতো লোক কি দৌড়াচ্ছে বৃষ্টিতে"...বাবা কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললো "ওটা গোপাল, আমাদের বাড়িতেই আসছে.."
বাবার জনৈক বন্ধু গোপালকে আমি চিনতাম..ভীষণ স্বল্পভাষী অথচ খুব ভালো মানুষ...কাকভিজে হয়ে বাড়িতে এলো..এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়ানো গেলো না আবার কি একটা কাগজ নিয়ে ভিজতে ভিজতে চলে গেলো...যাওয়ার আগে বলে গেলো "জঘন্য বৃষ্টিটার জন্য সব কিছু ভেস্তে গেলো, আবার ছাদ ফেটে জল পড়বে.."
বুঝলাম বৃষ্টি সবার জন্য সুখকর নাও হতে পারে..আমার মন "হংস বলাকার পাখা" হলেও বাকিদের কষ্টটা যে চোখের পড়বে না এতটাও আহাম্মক ছিলাম না...কিন্তু তাও বৃষ্টি পড়লেই মনটা নেচে উঠতো...মনে হতো ছবি আঁকি, গান শুনি, গল্পের বই পড়ি আর কিছু না হোক জানালা ধরেই দাঁড়িয়ে থাকি..কে জানে আগের জন্মে বোধহয় ময়ূর ছিলাম এখনো নিজের প্রাণের সখীকে খুঁজে বেড়াচ্ছি...
চাকরির সুবাদে আমি হাড়োয়া থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে ম্যানেজারি করেছি...বৃষ্টি পড়লেই আমাদের সব মেশিন বন্ধ হয়ে যেত..লিংকের প্রব্লেম, সার্ভার এরর লেগেই থাকতো...আজ থেকে ১২ বছর আগের কথা তখন ইন্টারনেটের রমরমা এতো ছিল না..আমরা কেউই সংযুক্ত অথচ বিক্ষিপ্ত ছিলাম না..তাই ব্যাংকে সেই সময় খদ্দের উপস্থিত থাকতেন প্লাস আমরা কর্মীরা গোল হয়ে বসে ভূতের গল্প শুনতাম...কোনোদিন আধ ঘন্টা, কোনোদিন ২ ঘন্টা বা কোনোদিন বিকেল অব্দি..কারেন্ট না আসা অব্দি বিরতি...অনেক দূর দূর গ্রাম থেকে লোক আসতেন জল কাদা পেরিয়ে..আমাদের ক্যাশিয়ার নিমাইদা অত্যন্ত পরোপকারী সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন...কারুর যদি প্রচন্ড প্রয়োজন থাকতো স্লিপ নিয়ে এমনি টাকা দিয়ে দিতেন..আমি বলতাম " নিমাইদা পরে এন্ট্রি সময় যদি লোকটার একাউন্ট এ টাকা না থাকে আপনি কি করবেন?"
উনি মুচকি হেসে জবাব দিতেন "আমি ৫০০ টাকা নিজের থেকে দিয়ে দেব...আর এসব লোক ঠকানি ব্যাপার তোমাদের শহরে হয়...গ্রামে এদেরকে সবাই ঠকায়...গরিব মানুষ ছেলের জ্বর..ওকে কিভাবে বলি যে বৃষ্টির জন্য লিংক নেই, নিচে ছেলেটাকে বসিয়ে উপরে এসেছে টাকা তুলতে, না দেওয়াটা পাপ.."
মনুষ্যত্ব যে লাভ ক্ষতির অনেক উপরে ব্যাংকে থেকে সেটা বোঝা যায়...একদিকে রিস্ক কমাতেই হবে অন্যদিকে অসহায় মানুষ গুলোরও যে সাহায্যের প্রয়োজন...এ এক অদ্ভুত টানাপোড়েন, ইংরেজিতে যাকে বলে ডেলিকেট ব্যালেন্স... অথচ এই নিমাইদাকেই দেখেছি ৬কিমি হেটে আসতে...কেউ যদি বলতো "এসো বাইকে, তোমায় ছেড়ে দিই"
তক্ষুনি না করে দিতেন, বলতেন "না, লাগবে না, হাঁটলে শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে"
আমি একদিন থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম "আপনি বাইকে করে চলে আসলেই তো পারেন, অসুস্থ শরীরে বৃষ্টির মধ্যে এতো পরিশ্রম রোজ কেন করেন?" উনি বলতেন "আজকে বাইকে ওঠার পরে কাল যদি বলে ম্যানেজার দিদিকে দিয়ে লোনটা করিয়ে দিন..আমি কি উত্তর দেব? না আমি কারুর কাছে ঋণী থাকতে চাই না"
বৃষ্টির এরকম আরো অনেক গল্প জমানো আছে ঝুড়িতে...এখন আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি নামব নামব করছে, ছাদ থেকে কাপড় গুলো তুলে আনি..বাকি গল্প পরের অধ্যায়ে...