09/10/2025
কালি কথা:পর্ব দুইঃ
শক্তির কাহিনি : মায়ের অলৌকিক উপাখ্যান
দ্বিতীয় পর্ব — রামকৃষ্ণ পরমহংস ও দক্ষিণেশ্বরের অলৌকিক দিনগুলি
জয় বাংলা সংবাদ
দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গাতীরে, গোধূলির আলোয় ভেসে আসা ঘণ্টাধ্বনি, ভক্তির গান আর ধূপের গন্ধে যেন আজও মায়ের উপস্থিতি অনুভব করা যায়। এই পবিত্র মন্দিরের ইতিহাস যেমন রানী রাসমণির স্বপ্নাদেশে শুরু, তেমনই তার চেতনা ও মাহাত্ম্য চিরজাগরূক হয়ে ওঠে এক মহাপুরুষের আগমনে — রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব।
গদাধরের আগমন:
রানী রাসমণির নির্মিত দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে প্রধান পুরোহিত ছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সহায়ক হিসেবে একদিন মন্দিরে আসেন ছোট ভাই গদাধর চট্টোপাধ্যায় — যাঁকে তখন সবাই “গদাই” নামে চিনতেন। কিন্তু অচিরেই সেই গদাই মায়ের উপাসনায় নিমগ্ন হয়ে পড়লেন সম্পূর্ণরূপে। মায়ের রূপ, মায়ের মূর্তি, মায়ের উপস্থিতি— সব তাঁর কাছে এক অলৌকিক বাস্তব।
রামকুমারের মৃত্যুর পর, রানী রাসমণি নিজ হাতে তাঁকেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত নিযুক্ত করেন। সেদিন থেকে শুরু হয় দক্ষিণেশ্বরের ইতিহাসে নতুন এক যুগ — ভক্তির, অনুভূতির ও আত্মসমর্পণের যুগ।
ভবতারিণীর সঙ্গে জীবন্ত সম্পর্ক:
রামকৃষ্ণ দেবের উপাসনা কোনো রীতি বা আচার ছিল না, ছিল প্রেম ও অনুভূতির সাধনা। তিনি মাকে ডাকতেন শিশুর মতো — কখনও হাসতেন, কখনও কাঁদতেন, কখনও অভিমান করতেন।
দক্ষিণেশ্বরের গর্ভগৃহে রোজ দেখা যেত এক অলৌকিক দৃশ্য — কখনও তিনি অচেতন অবস্থায়, কখনও হাস্যরত, কখনও কান্নায় ভিজে মায়ের কাছে আর্তি জানাচ্ছেন, “মা, তুই কি সত্যিই আছিস?”
আর তারপরই যেন বাতাসে মায়ের উপস্থিতি, তাঁর চোখে দীপ্তি, মুখে তৃপ্তি — যেন মা নিজে তাঁর হৃদয়ে আবির্ভূত।
লোককথা বলে, এক রাতে মন্দিরের গর্ভগৃহে তিনি স্পষ্ট দেখতে পান মা কালী জীবন্ত হয়ে উঠেছেন, আলিঙ্গন করেছেন তাঁকে, আর অচেতন রামকৃষ্ণ দেব পরদিন ভোরে জেগে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত এক মানুষ হয়ে।
সেই থেকেই তাঁর জীবনে শুরু হয় ‘মায়ের সঙ্গে মিলনের পথ’ — যা কেবল দক্ষিণেশ্বর নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য এক আধ্যাত্মিক জাগরণের সূত্রপাত ঘটায়।
রানী রাসমণি ও সাধকের সম্পর্ক:
রানী রাসমণি নিজেও রামকৃষ্ণ দেবের অলৌকিকতায় মুগ্ধ হন। অনেকেই বলতেন, মায়ের আশীর্বাদেই রানী ও সাধকের সাক্ষাৎ ঘটেছিল।
রামকৃষ্ণ দেব মন্দিরে পূজা করতেন নির্ভীকভাবে, কখনও আচারভঙ্গ করেও মায়ের কাছে পৌঁছে যেতেন নিখাদ ভক্তির শক্তিতে। রানী তাঁকে কখনও বাধা দেননি; বরং তাঁর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভক্তি রেখেছিলেন।
দক্ষিণেশ্বরের আলোকবর্তিকা:
দক্ষিণেশ্বরের সেই মন্দিরেই পরবর্তীতে আসেন মা সারদা দেবী, যিনি হয়ে ওঠেন চিরসঙ্গিনী ও মায়ের প্রতিরূপ। এখানেই আসেন তরুণ নরেন্দ্রনাথ দত্ত — যিনি রামকৃষ্ণের আশীর্বাদে হয়ে ওঠেন স্বামী বিবেকানন্দ।
এই দক্ষিণেশ্বরই তাই কেবল একটি তীর্থক্ষেত্র নয় — এটি ভারতীয় আত্মার পুনর্জাগরণের উৎস।
গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মন্দির আজও যেন বলে,
“যেখানে ভক্তি আছে, সেখানেই মা আছেন — জীবন্ত, জাগ্রত, অনন্ত।”
আজও ভোরের আলোয়, ঘণ্টাধ্বনি আর আরতির সুরে, দক্ষিণেশ্বরের বাতাসে ভেসে আসে এক অনুভব —
“মা এখনো আছেন, তাঁর সন্তানদের মাঝে, প্রতিটি হৃদয়ের অন্তরালে।”
আগামী পর্বে পড়ুন
“মা সারদা দেবী: করুণার প্রতিমা, দক্ষিণেশ্বরের নীরব শক্তি”
— যেখানে মায়ের আশ্রয়ে রচিত হয় এক নারীর অন্তর্নিহিত দেবত্বের গল্প।
Joy Bangla Sambad Santanu Ray Santanu Ray Official