
01/07/2025
🌼 শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের আবির্ভাবের পূর্ণ কাহিনি 🌼
(পৌরাণিক ও লোকজ সূত্রের সংমিশ্রণে)
প্রাচীন কালে মালব দেশের অধিপতি ছিলেন এক ধার্মিক রাজা—মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন। তিনি পরম বিষ্ণুভক্ত ছিলেন এবং চিরকাল চেয়েছিলেন, এমন এক ভগবানের মূর্তি স্থাপন করবেন, যার দর্শনলাভে আত্মার মুক্তি ঘটে।
🔹 স্বপ্নাদেশ ও সন্ধান
একদিন গভীর ধ্যানে বসে তিনি এক অলৌকিক স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে এক দেবদূত এসে বলল—
> “হে রাজন, পৃথিবীতে এক বিরল মূর্তি আছে, যাঁর নাম নীলমাধব। তিনি জঙ্গলে, এক শবরগৃহে পূজিত হন। তাঁকেই খুঁজে পাও, তাঁকেই প্রতিষ্ঠা করো।“
এই স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাজা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মন্ত্রী বিদ্যাপতি-কে পাঠালেন সেই মূর্তির সন্ধানে।
🔹 শবররাজা ও নীলমাধব
বিদ্যাপতি অনেক ঘুরে পৌঁছালেন এক গহীন জঙ্গলে, যেখানে থাকতেন এক শবরগোষ্ঠীর প্রধান—বিশ্বাসু শবর রাজা। শবররাজা নিজ গৃহে গোপনে নীলমাধবের পূজা করতেন। প্রথমে বিদ্যাপতিকে কিছুই দেখালেন না, কিন্তু পরে বিদ্যাপতি তাঁর কন্যা ললিতাকে বিবাহ করলে, ললিতা স্বামীকে গোপনে মন্দির দর্শন করাল।
বিদ্যাপতি অবাক হলেন—এই তো সেই অলৌকিক নীলমাধব! তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজাকে খবর পাঠাতে গেলেন, কিন্তু এর আগেই... মূর্তিটি হঠাৎ অন্তর্ধান করলেন।
🔹 দারুবিগ্রহের আবির্ভাব
রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নে ফের আদেশ পেলেন—
> “আমি আবার আসব, সিন্ধু নদীতে দারু (কাঠ) রূপে ভেসে উঠব। সেই কাঠ দিয়ে আমার রূপ তৈরি করো।”
একদিন পুরীর সমুদ্রতটে সত্যিই ভেসে এল এক বিরাট দারুবিগ্রহ—ঘন কাঠ, যেখানকার গন্ধে সুগন্ধ ছড়ায়, গায়ে ছিল চক্র ও শঙ্খের চিহ্ন।
রাজা সেই কাঠ মন্দিরে নিয়ে এলেন এবং একটি উপযুক্ত কারিগরের সন্ধানে পড়লেন। ঠিক তখন এক বৃদ্ধ কারিগর এসে উপস্থিত হলেন—তিনি নিজেকে “বিশ্বকর্মা” বললেন।
তিনি বললেন—
> “আমি দেবমূর্তি গড়ব, তবে শর্ত একটাই—দরজা খুলবে না, শব্দ করো না, আর ২১ দিন সময় দিও।”
রাজা সম্মত হলেন। কিন্তু কৌতূহলবশত ১৪ দিন পর রানী সেই দরজা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই বৃদ্ধ অন্তর্ধান করলেন।
🔹 অপূর্ণ মূর্তি, পূর্ণ ঈশ্বর
রাজা হতবাক হয়ে দেখলেন—মূর্তিরা অপূর্ণ, হাত নেই, পা নেই, রূপ অনন্য ও অদ্ভুত। দুঃখে ক্লিষ্ট হয়ে পড়লে, আবার স্বপ্নে আদেশ এল—
> “আমরা ত্রিদেব—আমি জগন্নাথ, আমার ভাই বলরাম, এবং বোন সুভদ্রা। এই অপূর্ণ মূর্তিই আমার সম্পূর্ণ রূপ। আমাকে এইভাবেই স্থাপন করো।”
রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আনন্দে মূর্তিগুলিকে মহান ধুমধামে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন।
---
🔸 মহা রথযাত্রা
এই জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রার সম্মানে প্রতিবছর আষাঢ় মাসে আয়োজিত হয় রথযাত্রা। তিনটি বিশাল রথে করে তাঁরা যান গুণ্ডিচা মন্দিরে। লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই রথ টানেন—বিশ্বাস করা হয়, নিজ হাতে রথ টানলে পুন্য ও মুক্তি লাভ হয়।
---
📜 এই কাহিনির তাৎপর্য
এই কাহিনি কেবল এক দেবতার আবির্ভাব নয়, বরং এটি ভক্তি, ধৈর্য, প্রত্যয় ও ঈশ্বরের অভাবিত রূপগ্রহণের স্বীকৃতি। শবর জাতির গৃহদেবতা, আর্য রাজা ও সর্বজনীন ঈশ্বর—তিনে মিলেই রূপ নেন "জগন্নাথ" নামে "জগতের নাথ"।
---
✨ শেষ বাণী:
> “যাঁর হাত নেই, তবু টানেন রথ
যাঁর চোখ নেই, তবু দেখেন সব পথ।
অপূর্ণ রূপে পূর্ণ যিনি—
তিনিই জগন্নাথ, ভক্তহৃদয় খনি।”