18/07/2025
চিরতরে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে ২ বছর আগে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, দাদাঠাকুর, পদ্মজা নাইডু স্মৃতিবিজড়িত বড়বাজারের ঐতিহাসিক ‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’....!!
হাওড়া ব্রিজ থেকে নেমেই বাম হাতে “দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডার”। হলুদ রঙের সেকেলে বাড়িটার একতলায় নীল রঙের সাইনবোর্ডে বড়ো বড়ো করে লেখা থাকতো দোকানের নাম। পথচারী তো বটেই এমনকি বাসযাত্রীদেরও নজর এড়ায়নি এ দোকান। সকাল থেকেই এ রাস্তা ম ম করতো খাঁটি ঘিয়ে ভাজা সিঙারা-কচুরির সুগন্ধে। এম.জি. রোডের যানজট, গাড়ির সাইরেনের শব্দ, ফেরিওয়ালাদের হাঁকাহাঁকি এসবের মধ্যে যেন ওই সুগন্ধটুকুই ছিল রোজকার জীবনে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। আজ অবশ্য এ রাস্তায় আর সে গন্ধের হদিশ মেলে না। ১০০ বছরের পুরোনো দোকানে আজ বড়োসড়ো তালা ঝুলছে। একদিকে করোনাকালে ব্যাপক লোকসান, অন্যদিকে পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবসায় অনীহা, দু'য়ের ধাক্কায় থমকে গেল দোকানের পথ চলা।
লকডাউনের পর থেকেই বেশিরভাগ সময়ে শাটার বন্ধ থাকতো এ দোকানের। কিছু কিছু সময় আবার অর্ধেক খোলা শাটারের নিচ দিয়ে কিঞ্চিৎ বেচা-কেনা চলতো। তবে শেষ রক্ষা হল না কিছুতেই। তিলোত্তমার মিষ্টি মানচিত্র থেকে চিরতরে হারাল দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার! কেবল ওই পুরাতন সাইনবোর্ডটুকু রয়ে গিয়েছে আগের মতোই। শুধু তাই নয়, জানা গিয়েছে বিক্রি হয়ে ‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ এখন বেহাত। এখন হয়তো আর সাইনবোর্ডটা ও নেই।
শোনা যায়, বিখ্যাত এই মিষ্টির দোকানে মিহিদানা খেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। তাই আর কোনও সাত-পাঁচ না ভেবে তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছিল এই দোকানের।
১৯২১ সালে বর্ধমান শহরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতার বড়োবাজার অঞ্চলে দোকান তৈরি করলেন বিভূতিভূষণ চৌধুরী। উদ্যেশ্য ছিল, বর্ধমান শহরের নাম করা সিতাভোগ আর মিহিদানার স্বাদে ভোলাবেন তিলোত্তমাকে। মিষ্টির স্বাদের পাশাপাশি কয়েকজন ময়রাকেও নিয়ে এলেন কলকাতায়। কমদিনের মধ্যেই বর্ধমানের সীতাভোগ এবং মিহিদানার স্বাদে মেতে উঠলো শহরবাসী। ঘিয়ের গন্ধে রীতিমত নেশা ধরে গেল ক্রেতাদের। তরতরিয়ে চলতে লাগলো মিষ্টির ব্যবসা।
সীতাভোগ এবং মিহিদানা তো ছিলই, পাশাপাশি এ দোকানে নানা রকমের নরম এবং কড়াঁ পাকের সন্দেশের চাহিদাও ছিল তুঙ্গে। এমনকি বাহারি রসের মিষ্টিতে পসার ভালোই জমে ওঠে দেশবন্ধুর। তবে আসল বাজার মাতিয়ে রেখেছিল দোকানের দেশি ঘিয়ে ভাজা হিঙের কচুরি। বাসচালক থেকে শুরু করে নিত্য যাত্রী, অনেকেই সকালের জলখাবার সারতেন ছোলার ডাল সহযোগে হিঙের কচুরি দিয়ে।
এ দোকানের একটা নিয়ম ছিল, যাকে বলে “ফেলো কড়ি মাখো তেল”। দোকানে ঢুকে মিষ্টি পছন্দ করে তাই সোজা চলে যেতে হতো কাউন্টারে। সেখানেই টাঙানো ছিল হলুদ রঙের দামের বোর্ড। যদিও মিষ্টির নামের পাশের দামের জায়গাটায় বারবার কাগজ মেরে মোটা হয়ে গিয়েছিল। মূল্যবৃদ্ধির বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিষ্টির দাম বেড়েছিল। তবে পুরোনো সাইনবোর্ড বদলে যায়নি কোনদিনই। এখানেই নির্দিষ্ট দাম দিয়ে কুপন কেটে সংগ্রহ করতে হতো পছন্দের মিষ্টি।
‘দেশবন্ধু’ নামের আড়ালেও রয়েছে এক কাহিনি। দোকানের মালিক বিভূতিভূষণবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। শোনা যায়, বিখ্যাত এই মিষ্টির দোকানের মিহিদানা খেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। তাই আর কোনও সাত-পাঁচ না ভেবে তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছিল এই দোকানের। কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের মতো প্রসিদ্ধ গায়করা এখানকার প্রতিদিনের খরিদ্দার ছিলেন। এ দোকানে আসতেন বিখ্যাত কথা শিল্পী দাদাঠাকুর, বিদ্রোহী পদ্মজা নাইডু ও।
দোকানের শেষ ম্যানেজার মিহির বিট একটি সাক্ষাৎকারে জানান, “উৎসব অনুষ্ঠানে অনেক বেশি বেশি মিষ্টি, নোনতা তৈরি করতে হতো। লাইন পড়ে যেত দোকানের সামনে। ভিড় সামাল দিতে নাজেহাল হয়ে পড়তো কর্মচারীরা।”
এহেন ঐতিহাসিক “দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার” এর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে....!! 😔
তথ্যসূত্র: অজানা ভারতবর্ষ। Discover India 🇮🇳