12/09/2025
গৌরচন্দ্র চাটুজ্জ্যে, নামটা শুনলেই আপামর বাঙালির ধমনীতে যেন ইলিশের তেল আর কাসুন্দির ঝাঁঝ একসঙ্গে খেলে যায়। তিনি 'বঙ্গভূমির সন্তান' নামক এক জাতীয়তাবাদী সংগঠনের মধ্যমণি। তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনলে মনে হয়, যেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশাই তাঁর কণ্ঠে ভর করে দিল্লীর উদ্দেশ্যে হুঙ্কার ছাড়ছেন। টিভি চ্যানেলের সান্ধ্যকালীন বিতর্কে তিনি বিপক্ষকে বাংলা শব্দের গোলায় এমনভাবে ধরাশায়ী করেন যে, তাদের মুখের ভাষা হারিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। গৌরবাবুর জীবনের মূল মন্ত্র একটাই – বাঙালিয়ানা। তাঁর মতে, বাঙালির সংস্কৃতি, ভাষা, এবং জীবনযাত্রাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ।
গৌরবাবুর বিশেষ রোষ ছিল দিল্লির প্রতি। তাঁর মতে, দিল্লি হলো বাঙালির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। আর এই ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্র? CBSE বোর্ড। গৌরবাবু প্রায়ই সভা-সমিতিতে বুক চাপড়ে বলতেন, "ওই CBSE বোর্ডে ছেলেমেয়েকে পড়ানো মানে নিজের হাতে বাঙালির ভবিষ্যতের টুঁটি টিপে হত্যা করা। ওটা বাঙালিয়ানা মুছে দিয়ে এক সর্বভারতীয় 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান' মার্কা খিচুড়ি বানানোর কারখানা।"
একবার এক টিভি বিতর্কে তিনি উত্তেজনার বশে এর থেকেও এক কদম এগিয়ে মন্তব্য করে বসেন, "CBSE বোর্ডে বাঙালীর মেয়েকে পড়ানো মানে, তাকে পরবর্তীকালে দিল্লী-গুরগাঁও-এর ছেলেদের বিছানা গরম করার জন্য প্রস্তুত করা।" এই মন্তব্য নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হলেও, তাঁর অনুগামীরা 'দাদা ঠিকই বলেছেন' বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে দেয়। চারিদিকে তাঁর জয়জয়কার। তিনি হয়ে ওঠেন আপামর বাঙালির 'সাংস্কৃতিক অভিভাবক'।
কিন্তু কথায় আছে, প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। গোল বাধল সেদিন, যেদিন 'বঙ্গভূমির সন্তান'-এর একনিষ্ঠ কর্মী, হরিপদ হালদার, তার মেয়ের ভর্তির জন্য কলকাতার এক নামজাদা স্কুলে গিয়েছিল। স্কুলটি ছিল CBSE বোর্ডের অধীনস্থ। হরিপদ মনে মনে গৌরদার বাণী স্মরণ করে একটু ইতস্তত করছিল, কিন্তু স্ত্রীর চাপে পড়ে তাকে আসতেই হয়েছিল। অ্যাডমিশন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সে যখন ভাবছিল, "কী করি, গৌরদার কথা অমান্য করে মেয়েকে কি তবে গোল্লায় পাঠাব?", ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল করিডোর ধরে হেঁটে আসা এক পরিচিত মুখের দিকে। আরে! এ যে তাদের গৌরদারই স্ত্রী! আর তাঁর হাত ধরে থাকা ছোট্ট মেয়েটির মুখ তো অবিকল 'গৌরদা'-র আদলে গড়া।
হরিপদর বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হলো না যে, যে CBSE বোর্ডের বিরুদ্ধে তার 'মহান নেতা' দিনরাত বিষোদগার করেন, নিজের একমাত্র কন্যাকে তিনি সযত্নে সেই 'দিল্লির দালাল' বোর্ডেই ভর্তি করিয়েছেন। হরিপদর মনে হলো, যেন তার পায়ের তলার মাটি নয়, গোটা বাঙালিয়ানাটাই ধসে গেছে।
খবর চাপা থাকে না, বিশেষ করে এই ডিজিটাল যুগে। বাতাসের আগে খবর ছড়িয়ে পড়ল। শীঘ্রই সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নিয়ে কানাঘুষো, মিম এবং ট্রোল শুরু হলো। গৌরবাবুর এক অন্ধ ভক্ত, পঞ্চানন পাঁজা, প্রথমে তো বিশ্বাসই করেনি। সে ফেসবুক লাইভে এসে হুঙ্কার দিয়ে বলল, "এসব দিল্লির আইটি সেলের চক্রান্ত। দাদাকে কালিমালিপ্ত করার ঘৃণ্য চেষ্টা। দাদা এমন কাজ করতেই পারেন না।"
কিন্তু সত্যের জোর যে বড় জোর। কিছুদিনের মধ্যেই গৌরবাবুর মেয়ের স্কুলের আইডি কার্ডের ছবি, যেখানে স্কুলের নামের নীচে বড় বড় করে লেখা "Affiliated to C.B.S.E., New Delhi", ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে গেল।
এবার গৌরবাবু পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরতেই তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, "আপনারা জানেন? এটা আমার এক গভীর চাল। শত্রুর ডেরায় ঢুকে শত্রুকে খতম করার পরিকল্পনা। আমার মেয়ে ওখানে পড়ছে, যাতে বড় হয়ে ওই CBSE বোর্ডের অন্দরমহলের সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে। ও আমার 'এজেন্ট'!"
উপস্থিত সাংবাদিকরা এই অদ্ভুত যুক্তি শুনে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। একজন timid সাংবাদিক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কিন্তু স্যার, আপনার সেই 'দিল্লী-গুরগাঁও-এর বিছানা...' ওয়ালা মন্তব্য?"
গৌরবাবু এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। তারপর চোখেমুখে এক দার্শনিক ভাব ফুটিয়ে তুলে বললেন, "ওটা ছিল সাধারণ মেয়েদের জন্য বলা। আমার মেয়ে সাধারণ নয়, ও এক বিপ্লবের অগ্নিশিখা। ওকে আমি বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ওসব ওর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।"
সেই দিন থেকে 'বঙ্গভূমির সন্তান' সংগঠনের অনেকেই গৌরচন্দ্র চাটুজ্জ্যেকে আড়ালে 'দু মুখো চাটুজ্জ্যে' বলে ডাকতে শুরু করেছে। শোনা যায়, তিনি নাকি আজকাল রাতের বেলা বাড়ি ফিরে মেয়ের সাথে হিন্দিতে কথা বলার অভ্যাস করছেন, যাতে মেয়ে বড় হয়ে 'এজেন্ট' হিসেবে দিল্লিতে সহজে মানিয়ে নিতে পারে। আর তিনি শ্রী গৌরচন্দ্র চাটুজ্জ্যে, বাঙালীর ‘পরিত্রাতা’ দিনের বেলায় পথে ঘাটে গরীব, খেটে খাওয়া ‘দিল্লীর দালাল’ ‘গুটকাখোর’ দোকানদারদের চমকান ও ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ধুয়ো তুলে নিজের দর বাড়ান।
এভাবেই গৌরচন্দ্র চাটুজ্জ্যে একদিকে বাঙালিয়ানার ঝান্ডা উড়িয়ে, অন্যদিকে নিঃশব্দে নিজের মেয়ের জন্য 'দিল্লির পথ' প্রশস্ত করে চলেছেন। তাঁর এই দ্বিচারিতা দেখে স্বয়ং বঙ্গমাতাও হয়তো মুচকি হাসেন আর ভাবেন, "বাঙালির চরিত্র বোঝা বড়ই কঠিন!"
© নারদ সংবাদ