01/01/2025
অরিন্দম আচার্যের নতুন উপন্যাস "ধূসর পায়রা" থেকে নেওয়া একটি অংশ -
"অফিস থেকে বেরিয়ে ইন্টারন্যাশানাল ফাইন্যান্স ব্যাঙ্ক বা আইএফবির পিছনে একটা চায়ের দোকানে রাখা বেঞ্চের উপর বসতে গিয়ে গল্পটা আবার মনে পড়ল। এমন এক চায়ের দোকানের কথাই বলেছিলেন চঞ্চলবাবু। যেখানে সুগত লাহিড়ী, সুপর্ণ শেখর রায় আর প্রেম রড্রিগেজের মতন সহকর্মীরা আড্ডা দিত। এমন একটা চায়ের দোকানেই কত সুখ দুঃখের কথা আলোচনা করত ওরা। কত ব্যক্তিগত কথা অন্তরঙ্গতার মাধ্যমে বিনিময় হত। অনেকদিন ভেবেছি সেই চঞ্চলবাবুর কাছে শোনা ঘটনাগুলো নিয়ে একটা উপন্যাস বা নিদেন একটা বড় গল্প লিখে ফেলি। আজকাল গল্পের বড় আকাল চলছে। শহরের মানুষগুলো কেমন যেন বড় ছাপোষা হয়ে গেছে। সারাদিন সংসারের আবর্তনচক্রে পড়ে জীবনের রোমাঞ্চ হারিয়ে ফেলছে। সেদিন প্রকাশকের দপ্তরে গিয়ে কথাটা পাড়তেই তিনি একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও নাও, মস্তিষ্কে খানিক ধোঁয়া দিয়ে চাঙ্গা কর। তোমার গল্পের দরকার বলে কি দেশশুদ্ধ লোক পাপ করবে নাকি?
আমি বললাম, না না, তা কেন? আমি বলতে চাইছি, গল্পের ইন্ধন পাবার মতন কোন জীবন ঠিক নজরে পড়ছে না। যাক গে, তোমার সেই চঞ্চলবাবুর সিনিয়ারের কেসটার কী হল?
প্রকাশক বললেন, একটু পরই আসবে। তাকেই জিজ্ঞাসা করো।
সত্যি বলতে কী, অনেকদিন পর আবার সেই ঘটনাগুলো মনে পড়ল বলে বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছিল। সেই সঙ্গে মনে পড়ছিল সুগত লাহিড়ীর ছোটবেলার কথা, তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোর কথা, সেই মধুজার সঙ্গে আলাপ হওয়ার গল্প। মনে হল আর একবার ঝালিয়ে নি। প্রশ্নও করলাম চঞ্চল বাবুকে, তা চঞ্চলবাবু, সেই যে সেই ছেলেটির নাম বলেছিলেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের নেতা না কে! কী যেন নাম?
চঞ্চলবাবু বললেন, আহা, প্রসেনজিৎ পাত্র। মনে নেই, সেই যে যেবার সুগত আর সুপর্ণকে পুলিশে ধরল, সেদিন প্রসেনজিৎএর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বলেছিলাম তো ট্র্যাজিক গল্পটা। শুধু তো ট্র্যাজেডি না, প্রচন্ড শেমফুল। সামাজিক লজ্জা বলা যায়! সুপর্ণর আর কী – ল্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। কিন্তু সুগতর কথাটা ভাবুন। না হয় সেদিন থানার বড়বাবুর জন্য ছাড়া পেয়েছিল, কিন্তু লজ্জা তো আর আটকানো যাবেনা?
আমি বললাম, কিন্তু সেই বেশ্যাটাকে পুলিশ ধরল না কেন?
চঞ্চলবাবু চোখ ঘুরিয়ে বললেন, বোঝেন তো সব। এরা সব লাইনের মাল। ধরা তো পড়ে শুধু সাধারণরা। এই যে মৃত্তিকা ঘোষাল এবং মিঠুন সাহার ব্যক্তিগত ঝামেলা আইনি রূপ পেল, সেখানে আসলে ফাঁসল কে? সুগত লাহিড়ী। কপাল বুঝলেন, কপাল।
আমি বললাম, তা শেষটা কী হল? সেটা শোনা যে খুব দরকারি। ভাবছি এটাই গল্প হিসাবে নামিয়ে দেব।
চঞ্চলবাবু বললেন, তাই নাকি? করতেই পারেন। বন্ধু হিসাবে একটা গল্প না হয় বলেই রাখলাম।
আমি বললাম, বেশ, তবে বলুন গল্পের শেষটা কী?
উনি বললেন, না মশাই। এই গল্পের শেষ আমার জানা নেই। শুধু এটুকু শুনেছি, সুগতবাবুর জীবন বড় প্যাথেটিক। বেশ অনেকদিন লোকটাকে অবজার্ভ করতে করতে ওর প্রতি একটা টান অনুভব করেছিলাম। কিছুটা যেন মায়া পড়ে গেছিল। সেই মানুষ যখন কেচ্ছা কেলেঙ্কারির পাকচক্রে বিশ্রী জীবনবোধের অভিজ্ঞতা পায়, মনে বড় আঘাত লাগে। মনে হয়, এটা তো ঠিক বাঞ্ছনীয় ছিল না।
কথাটা আমারও মনে বড় লাগল। তাই তো, বেশ ধারাবাহিকভাবে শুনছিলাম সুগত, সুপর্ণ, মধুজা, মৃত্তিকা, ক্যারোলিনের মায়াময় অবিশ্বাস ভরা অদ্ভুত জগতের গল্প। সুগতর চরিত্র কেমন যেন বড় কাছের, বড় আপন বলে মনে হচ্ছিল। উত্তর কলকাতার নোনাধরা ছোট আস্তানার থেকে ধীরে ধীরে ভাগ্য আর পরিশ্রমের সহায়তায় সে নিজেকে সমাজের একটা বিশেষ মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। তার মধ্যে প্রাণ ছিল, প্রেম ছিল, ভালবাসা ছিল, মায়া মমতা স্নেহ ছিল আর ছিল সবাইকে আপন করে নিতে পারার মতন নৈসর্গিক হাসি ভরা মুখখানা। আজকের পৃথিবীতে এই ধরণের লোকের সংখ্যা যে বড় একটা চোখে পড়ে না, সেটা আমি ভাল করেই বুঝতে পেরেছি।
মাঝখানে যেন খানিক নিজের গাফিলতিতেই প্রকাশকের দপ্তরে আসা বন্ধ করেছিলাম। তার মধ্যে যে কাহিনীর একটা পরিণতি হয়ে যাবে আর আমার গল্পমালার তার কেটে যাবে, সেটা খেয়ালই করিনি। আর খেয়াল করিনি বলেই আমাদের চেনাজানা পৃথিবীর জটিলতা থেকে কোন এক ফাঁকে সুগত হাঁটতে শুরু করেছিল তার স্বপ্নমাখা সীমাহীন নতুন জগতের অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে।
নির্বান্ধব অবস্থায় সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো সে তার মেয়ে টিঙ্কার আঁকা ধূসর পায়রাটাকে ডেকে একদিন প্রশ্ন করেছিল, হ্যাঁ গা, তুমি তো শহর, রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে পৃথিবীর দুস্তর প্রান্তে ঘোরাফেরা কর। সেখানে কি কারুর খোঁজ পেয়েছ, যে আমার মতন নির্বান্ধব জীবন অতিবাহিত করে? যে আমার মতন নগন্য মানুষের কথা শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করে? যে আমার মতন মানুষের কর্মকে বিশ্বাস করে? যদি পাও, তবে আমাকে খবর দিতে দ্বিধা করো না। তোমার কাছ থেকে এটুকু উপকার পেলে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব।"
উপন্যাসঃ ধূসর পায়রা
প্রকাশকঃ তুহিনা প্রকাশনী
প্রচ্ছদঃ কৃষ্ণেন্দু মন্ডল
মূল্যঃ 400টাকা
তুহিনার ওয়েবসাইট থেকে বা 9123701662এ whatsapp করে বই সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়া আমাজন এবং বইমেলা অনলাইন বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে - লিঙ্ক নিচে
DHUSAR PAYARA https://amzn.eu/d/9n71sMj
https://boimela.in/product/dhusar-payara/