10/09/2022
পাহাড়িদের অধিকারহীনতা
মঙ্গল কুমার চাকমা
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২২ । ০০:০০ । প্রিন্ট সংস্করণ
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পর তৎকালীন সরকার চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু পরে কোনো সরকারই চুক্তি বাস্তবায়নে আশানুরূপ এগিয়ে আসেনি। এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে একনাগাড়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের পন্থায় পার্বত্য সমস্যা সমাধানের নীতি অনুসরণ করে চলেছে বলে মনে হয়। চুক্তি অনুযায়ী সব অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের পরিবর্তে বর্তমানে প্রত্যাহূত ক্যাম্পের জায়গাগুলোতে পুনরায় ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে।
পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে "'পুলিশ (স্থানীয়)' এবং জেলার আইনশৃঙ্খলার তত্ত্বাবধান ও উন্নয়ন" বিষয় দুটি ন্যস্ত না করে এবং পার্বত্য জেলা পরিষদের আইন ও বিধি অনুযায়ী 'পার্বত্য পুলিশ বাহিনী' গঠন না করে সরকার সম্প্রতি প্রত্যাহূত সেনা ক্যাম্পের জায়গাগুলোতে এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ প্রকাশের ওপর এক প্রকার সেন্সরশিপ চলছে। ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের খবর দেশের জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো সুকৌশলে এড়িয়ে চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম-সংক্রান্ত অনেক নিউজ পোর্টাল বন্ধও করে দিয়েছে সরকার। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর সুপারিশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর ১১টি বিধিনিষেধ জারি করে, যার মধ্যে রয়েছে- বিদেশিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়া এবং দেশি-বিদেশি সংস্থা ও ব্যক্তি কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিনিধি রাখার নির্দেশনা। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কার্যত পরিণত করা হয়েছে অবরুদ্ধ অঞ্চলে।
এমন পরিস্থিতিতে গত ১৭ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট হিন্দু সম্প্রদায়সহ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোকে সহিংসতা ও তাদের ভূমি বেদখল থেকে সুরক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ২৫ বছর আগে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। কিন্তু ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মিশেল ব্যাচেলেট পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং স্বাধীন পক্ষগুলোর ওই এলাকা পরিদর্শন করার ক্ষেত্রে অবাধ অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে মন্ত্রী-আমলাদের বক্তব্য ও হাবভাব দেখে সরকার এ বিষয়ে শিগগিরই এগিয়ে আসবে, এমনটা আশা করা কঠিন। সরকার এখনও সেই নেতিবাচক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। মিশেল ব্যাচেলেটকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে যেভাবে ব্রিফ করেছেন বলে সাংবাদিক বলেছেন, তাতে নিশ্চিত চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে মর্মে সরকার এখনও সেই শিবের গীত গেয়ে চলেছে। আর মানবাধিকার হাইকমিশনারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিদর্শনে অনুমতি না দেওয়ার ফলে জাতিসংঘে নিঃসন্দেহে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি যদি অসত্য হতো তাহলে ব্যাচেলেটকে পার্বত্যাঞ্চল সফরে অনুমতি না দেওয়ার কোনো কারণ ছিল না।
আমরা যাঁরা পার্বত্য সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই, তাঁরা সবাই কামনা করি এবং আশাবাদ জিইয়ে রাখতে চাই- সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান বাস্তবতা উপলব্ধি করে যদি সরকার জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের সুপারিশ আমলে নিয়ে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে, তা নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকার তথা দেশের জন্য হবে মঙ্গলজনক। অন্যথায় বর্তমান সরকারের আমলে দেশে অব্যাহত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং বিচারহীনতার বিষয়টি যেভাবে একটি বৈশ্বিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, সেভাবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টিও আন্তর্জাতিক স্তরে আরও জোরালো হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই।
গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জবাবদিহির জন্য একটি স্বাধীন সংস্থা গঠনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার যে সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলেছেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এবং পার্বত্যাঞ্চলের ওপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের সহযোগিতার বিষয়টি এ ধরনের প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। রাষ্ট্র ও আদিবাসীদের মধ্যকার চুক্তি, ইতিবাচক পদক্ষেপ ও সমঝোতা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের একটা বিশেষ প্রক্রিয়া রয়েছে। যেমন- জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের প্রস্তাব ৩৩/২৫ অনুসারে, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কর্মব্যবস্থার (এক্সপার্ট মেকানিজম) অনুরোধক্রমে সদস্য রাষ্ট্র এবং/অথবা আদিবাসীদের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করতে কারিগরি সহায়তা দেয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এক্সপার্ট মেকানিজম ২০১৮ সালে ফিনল্যান্ড ও মেক্সিকো, ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০২০ সালে সুইডেন ও ব্রাজিলে এ ধরনের মিশন পরিচালনা করেছে। তাই সরকার আন্তরিক হলে মানবাধিকার পরিষদের অধীন এক্সপার্ট মেকানিজমের এই বিশেষ প্রক্রিয়াকে কাজে লাগাতে পারে।
জানা গেছে, জলবায়ু ও মানবাধিকারবিষয়ক নতুন স্পেশাল র্যাপোর্টিয়র শিগগিরই বাংলাদেশ পরিদর্শনে আসছেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও সে-সংক্রান্ত মানবাধিকারের সঙ্গে আদিবাসী ইস্যুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ব্যাচেলেটের সুপারিশ অনুসারে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নসহ আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সহিংসতা ও তাদের ভূমি বেদখল থেকে সুরক্ষার বিষয়টিও আমলে নিয়ে সরকারের বিশেষ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে বিবেচনা করা যায়।
এটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে, দেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা, পার্বত্যাঞ্চলের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠে এসেছে সরকারের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ অস্বীকার না করে বরং গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা অপরিহার্য। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সব অস্থায়ী ক্যাম্প অচিরেই বন্ধ করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে, যেটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির কয়েকটি সভায়ও আলোচিত হয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থেই তা বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক। তা না হলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
মঙ্গল কুমার চাকমা :পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক