
26/09/2025
অনেকদিন পর হঠাৎই দেখা হয়ে গেল আমার এক স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে। এখন সে ফ্লিপকার্ট-অ্যামাজনে ডেলিভারি পার্টনার হিসেবে কাজ করছে। মুখে ক্লান্তি, গলায় হাঁপ ধরা কণ্ঠ। বলল—
“দোস্ত, গতকাল থেকে একটানা ডেলিভারি করছি, একটুও ফাঁকা সময় নেই। সব আইফোন! আর আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, কেউ বেস মডেল নিচ্ছে না। শুধু 15 প্রো, 16 প্লাস, 16 প্রো, নইলে সরাসরি প্রো ম্যাক্স।”
কথা শুনে প্রথমে অবাক হলাম, তারপর আরও চমক খেলাম যখন সে বলল, “যে বাড়িগুলোতে ফোনগুলো পৌঁছে দিচ্ছি, সেগুলোর অবস্থা দেখে তুমি বিশ্বাসই করবে না। টালির চালের বাড়ি, রংচটা একতলা পুরোনো ঘর, এমনকি বস্তির ভেতরেও। আজকেই তোমাদের এই লাইনের ধারের বস্তিতে ছ’টা ফোন দিলাম। সব জায়গায় একই দৃশ্য— স্কুলে পড়া ছেলে-মেয়েরা, তাদের বাবা-মা, সবার মুখে অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। কারও পোশাক, কারও বাড়ির হাল দেখে বোঝার উপায় নেই যে ভেতরে ঢুকছে এক লাখ তিরিশ হাজার টাকার ফোন।”
ডেলিভারি পার্টনারদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে অনেকক্ষণ, কারণ সবাই আনবক্সিং ভিডিও বানাচ্ছে। যেনো নতুন ফোনটা কেনা নয়, তার ভিডিওটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বন্ধু জানাল, প্রায় সব ফোনই EMI-তে কেনা। আর এই EMI-র খেলা আসলেই ভয়ংকর। ফাইনান্স কোম্পানিগুলো স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদেরও ২-৩ বছরের “নো কস্ট EMI” দিয়ে দিচ্ছে প্রায় কোনও ডকুমেন্ট ছাড়াই। কিন্তু এটাই আসল ফাঁদ। একবার কোনও কিস্তি মিস হলেই ৩৫-৪০% হারে পেনাল্টি, তখন “নো কস্ট” হঠাৎ করেই এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। একজন ডিফল্টারের পেনাল্টি থেকেই উঠে আসে দশজনের “নো কস্ট EMI”-র টাকা।
ভেবে দেখো, নিজের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে গিয়ে, শুধুমাত্র অন্যকে দেখানোর জন্য, একটি এলিট প্রোডাক্ট কিনে বসা। “আমার হাতে আইফোন 16 প্রো মানেই আমি আলাদা”—এই ভুয়া আইডেন্টিটি তৈরি করার চেষ্টা। আর এই ভ্রমটাই হলো ক্যাপিটালিজমের সবচেয়ে বড় কৌশল। তোমার শখ আসলে তোমার নিজের নয়, বাজারের তৈরি। তুমি শুধু তার ফাঁদে পা দিচ্ছ।
নোবেলজয়ী ডঃ অভিজিৎ ব্যানার্জী একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন— আমাদের অর্থনীতি এমনভাবে ডিজাইন করা যে, নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত যে ব্যান্ডে জন্মায়, যতই পরিশ্রম করুক, সাধারণত সেই ব্যান্ডেই জীবন শেষ হয়। আউটলায়ার্স বাদ দিলে এই চক্র ভাঙা যায় না। অর্থনীতির সেই লকড সিস্টেমের ভেতরে আমরা সবাই ঘুরপাক খাচ্ছি।
এই কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে পড়ল অঞ্জনের চলো অঞ্জন অনুষ্ঠানে সব্যসাচী চক্রবর্তীর সেই বিখ্যাত লাইনটা—
“…আমার পাঁচ জনের পরিবার, আমার যদি একটা সাধারণ সুমো গাড়িতে কাজ হয়ে যায়, আমি একটা প্যাজেরো কিনতে যাব কেন? এই বেঞ্চমার্কটা আমাকে ঠিক করতে হবে। নিষেধটা আসবে আমার ভেতর থেকে। এই শিক্ষা আসবে আমার পরিবার থেকে, আমার বাবা-মা থেকে, বই থেকে, আমার বন্ধুদের থেকে, যারা আমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী…”
কিন্তু সেই জীবনবোধ কোথায়?
আমাদের স্কুলে যদি সত্যিই শেখানো হত কিভাবে নিজের চাহিদা আর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হয়, কিভাবে ভোগবাদ আর ঋণের ফাঁদ থেকে বাঁচতে হয়— তাহলে হয়তো এত মানুষ এই ম্যানুফ্যাকচার করা স্বপ্নের দৌড়ে গলা বাঁধত না।
অবশেষে বুঝলাম— আসল শিক্ষা শুধু চাকরি বা পরীক্ষা পাশের মধ্যে নেই। আসল শিক্ষা হলো কোনটা না চাইতে হবে, কোনটার ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না, কোনটা তোমাকে সত্যি মানুষ করবে।
Collected from a school group