09/01/2025
সপ্তাহে কেন ৭ দিন
আমাদের জীবনে সপ্তাহের ধারণা এতটাই সাধারণ ব্যাপার যে আমরা এটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না। তবে কখনও ভেবে দেখেছেন কি, কেন সপ্তাহে ঠিক ৭ দিন থাকে? কেন এটা ৫ বা ১০ দিনের নয়? আর কেন সোমবারের পর সরাসরি রবিবার আসে না, বরং মঙ্গলবার আসে?
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসে, আধুনিক ইরাকের প্রাচীন সভ্যতার সময়ে।
আসলে আমাদের সময়কে ৭ দিনের সপ্তাহে ভাগ করার পেছনে রয়েছে চাঁদের আবর্তন আর মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদার গভীর যোগসূত্র।
অনেক ক্যালেন্ডারের মতই, আজকের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারও মূলত চাঁদের আবর্তনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ফলাফল? একটা সহজ আর কাজ চালানোর মত সময়ের কাঠামো, যা এখনও আমরা ব্যবহার করছি।
# ব্যাবিলনীয়দের ভূমিকা
চাঁদ তার সবগুলি আবর্তন সম্পন্ন করতে প্রায় ২৯.৫ দিন নেয়। কিন্তু এত বড় একটা সময় মানুষের দৈনন্দিন ব্যবস্থার জন্য বেশ অগোছালো হয়ে যেত। এখানেই আসে ব্যাবিলনীয়দের ভূমিকা।
মেসোপটেমিয়ার এই প্রাচীন সমাজ (যা আজকের ইরাক) চাঁদের চক্রকে ২৮ দিনে নামিয়ে আনে এবং এটিকে ৭ দিনের ৪টি ভাগে বিভক্ত করে। তারা লক্ষ্য করেছিল, প্রতি ৭ দিন পর পর চাঁদের আকার এবং অবস্থানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। এই ৭ দিনের চক্র তাদের ক্যালেন্ডারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
ব্যাবিলনীয়রা চাঁদের পর্যায় ছাড়াও সূর্যের গতিবিধি এবং গ্রহের অবস্থান নিয়ে গভীর গবেষণা করেছিল। তারা চাঁদের এই ৭ দিনের বিভাজনকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং সামাজিক সময়সূচি নির্ধারণের জন্য ব্যবহার করত।
উদাহরণস্বরূপ, ব্যাবিলনীয়রা নতুন চাঁদের উদয়কে একটি নতুন মাসের সূচনা হিসাবে উদযাপন করত এবং এর ওপর ভিত্তি করে কৃষিকাজ এবং ধর্মীয় উৎসবের সময় নির্ধারণ করত।
তারা জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করে দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করেছিল এবং বিভিন্ন গ্রহের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছিল। তাদের ধর্মীয় ক্যালেন্ডারে ৭ দিন ধরে একটি বিশেষ পূজা বা উপাসনা পালনের প্রথা ছিল, যা দেবতাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
প্রাচীন ব্যাবিলনীয় ক্যালেন্ডারের এই প্রভাব পরবর্তীতে গ্রিক এবং রোমান সভ্যতায় ছড়িয়ে পড়ে, যা আধুনিক ক্যালেন্ডারের ভিত্তি গঠনে ভূমিকা রাখে।
# ধর্ম এবং সৃষ্টিতত্ত্বে ৭ দিনের গুরুত্ব
ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৮৯৪ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তাদের উদ্ভাবিত ৭ দিনের কাঠামোটি পরবর্তীকালে একাধিক জনপ্রিয় সৃষ্টিতত্ত্বে প্রভাব ফেলে। যদিও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সময়ে ৭ দিনের সপ্তাহের ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, এটি পরে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আরও গুরুত্ব পায়।
হিব্রু ও খ্রিস্টীয় বাইবেলের ‘বুক অফ জেনেসিসে’ বলা হয়েছে যে ঈশ্বর ৭ দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন: ছয় দিন কাজ করে এক দিন বিশ্রাম। প্রাচীন মিশরীয় এবং সুমেরীয় সভ্যতার সৃষ্টি কাহিনীতেও ৭ সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
# ৭টি গ্রহ এবং ৭ দিনের সংযোগ
ব্যাবিলনীয়রা জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে আকাশে দৃশ্যমান ৭টি প্রধান জ্যোতিষ্ক মানুষের জীবন এবং ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের দিকে তারা একটি প্রকারের রাশিচক্র তৈরি করেছিল, যেখানে সপ্তাহের প্রতিটি দিন একটি গ্রহের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই ৭টি গ্রহ হল: সূর্য, চাঁদ, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি।
ব্যাবিলনীয়রা প্রতিটি গ্রহকে একটি নির্দিষ্ট দেবতার সঙ্গে যুক্ত করেছিল এবং দিনগুলির নাম সেই দেবতাদের নামানুসারেই নির্ধারণ করেছিল। কিছু ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, সপ্তাহের দিন এবং গ্রহগুলির মধ্যে এই সংযোগ প্রাচীন গ্রিকদের মাধ্যমে আরও জনপ্রিয় হয়েছিল এবং এটি রোমান সভ্যতায় পরিমার্জিত হয়ে আধুনিক ৭ দিনের সপ্তাহের ভিত্তি গড়ে তোলে।
# গ্রিক ও রোমানদের প্রভাব
গ্রিক জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদরা ব্যাবিলনীয়দের জ্ঞান অনুসরণ করে নিজেদের ধ্যান-ধারণা যুক্ত করেন। তারা সপ্তাহের দিনগুলির সঙ্গে গ্রহগুলির সংযোগকে আরও সুসংগঠিত করেন এবং এর সঙ্গে দেবতাদের নাম যুক্ত করেন।
রোমানরা এই পদ্ধতিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে মানিয়ে নেয় এবং এটিকে আরও কাঠামোগত করে তোলে। তারা দেবতাদের নামানুসারে দিনগুলির নামকরণ করে, যা তাদের সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
উদাহরণস্বরূপ, শনিবার ছিল “ডাইস স্যাটার্নি” (Saturn-এর দিন)। রবিবার ছিল “ডাইস সোলিস” (Sun-এর দিন) এবং সোমবার ছিল “ডাইস লুনায়” (Moon-এর দিন)।
রোমানরা দেবতাদের সঙ্গে দিনগুলির নামকরণের মাধ্যমে সপ্তাহের ধারণাকে আরও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
ব্যাবিলনীয়রা ৭ দিনের চক্র এবং গ্রহের সংযোগের ধারণাটি প্রাচীন গ্রিকদের কাছে পৌঁছে দেয়। গ্রিকরা এটি তাদের জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ধর্মীয় ব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করে। পরে, রোমানরা গ্রিকদের কাছ থেকে এই পদ্ধতি গ্রহণ করে এবং নিজেদের দেবতাদের নাম দিয়ে দিনগুলির নামকরণ করে।
এই নামকরণ ব্যবস্থা পরবর্তীকালে লাতিনভিত্তিক ভাষাগুলি, যেমন স্প্যানিশ, ফরাসি, ইতালীয়, পর্তুগিজ এবং রোমানিয়ান ভাষায় সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলে। ইংরেজি ভাষাতেও এর কিছু প্রভাব দেখা যায়, তবে ইংরেজি একটি জার্মানিক ভাষা। নর্মান বিজয়ের (১০৬৬) পর ইংরেজি ভাষায় লাতিনভিত্তিক ফরাসি শব্দভাণ্ডারের ব্যাপক প্রবেশ ঘটে। তবে, সপ্তাহের দিনগুলির নাম প্রধানত নর্স এবং জার্মানিক দেবতাদের সঙ্গে যুক্ত, যেমন "Tuesday" নর্স দেবতা Tiu থেকে এবং "Thursday" দেবতা Thor থেকে এসেছে।
# দিনগুলোর ক্রম এবং দূরত্ব
রোমানরা গ্রহগুলির গতির ওপর ভিত্তি করে অনুমান করেছিল, কোনটি পৃথিবীর কাছে এবং কোনটি দূরে। তারা বিশ্বাস করত যে আকাশে গ্রহগুলির চলাচলের গতি তাদের দূরত্ব নির্দেশ করে। তাদের অনুমিত ক্রম ছিল:
১. শনি (শনিবার): সবচেয়ে ধীরগতিসম্পন্ন এবং পৃথিবী থেকে দূরতম।
২. বৃহস্পতি (বৃহস্পতিবার): শনির পরে ধীরগতি এবং দূরে।
৩. মঙ্গল (মঙ্গলবার): বৃহস্পতির তুলনায় দ্রুততর এবং কিছুটা কাছাকাছি।
৪. সূর্য (রবিবার): মঙ্গলের চেয়ে দ্রুততর।
৫. শুক্র (শুক্রবার): সূর্যের তুলনায় আরও দ্রুততর এবং কাছাকাছি।
৬. বুধ (বুধবার): শুক্রের চেয়েও দ্রুতগামী।
৭. চাঁদ (সোমবার): সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি।
এই ক্রম এবং গতির ধারণা তাদের সময়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যা সপ্তাহের দিনের ক্রম নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
# গ্রহের ঘণ্টা
রোমানরা বিশ্বাস করত প্রতিদিনের প্রতিটি ঘণ্টা একটি নির্দিষ্ট গ্রহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা এই ধারণাটি ব্যাবিলনীয়দের কাছ থেকে গ্রহণ করে এবং এটিকে তাদের জ্যোতিষ ও ধর্মীয় ব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করে।
প্রথম দিনের প্রথম ঘণ্টা চাঁদের অধীনে ছিল। প্রতিটি ঘণ্টার জন্য একটি নির্দিষ্ট গ্রহ দায়িত্বশীল ছিল, যা একটি ঘূর্ণন পদ্ধতির মাধ্যমে ঠিক করা হত। এই পদ্ধতিতে সপ্তাহের প্রতিটি দিনের প্রথম ঘণ্টা নির্ধারিত হত সেই দিনের গ্রহের অধীনে। উদাহরণস্বরূপ, সোমবারের প্রথম ঘণ্টা চাঁদের অধীনে এবং শনিবারের প্রথম ঘণ্টা শনি গ্রহের অধীনে ছিল।
এই প্যাটার্ন পুরো সপ্তাহের ১৬৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োগ করা হত। প্রতিটি গ্রহের ঘণ্টা অনুযায়ী দিনগুলির ক্রম তৈরি হত, যা সময় নির্ধারণ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
ফলস্বরূপ, সপ্তাহের প্রতিটি দিন একটি নির্দিষ্ট গ্রহ এবং দেবতার সঙ্গে যুক্ত হয়। এই পদ্ধতি রোমানদের সময় মজবুত ভিত্তি পায় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
সপ্তাহে ৭ দিন থাকার পেছনে চাঁদের পর্যায়, প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতার অবদান, গ্রহের গতিবিধি এবং রোমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে। এটি শুধু সময়ের একটি মাপনী নয়, বরং এটি মানব ইতিহাস, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আজও, বিশ্বের অনেক দেশ এই কাঠামো অনুসরণ করে, যা আমাদের অতীতের সঙ্গে আমাদের সংযোগ রক্ষা করে।