18/07/2025
📗সচিত্র টারজান সিরিজ ৩
অ্যাকশন, অ্যাডভেঞ্চার আর কৈশোরের হারিয়ে যাওয়া নস্টালজিয়া ফিরিয়ে নিয়ে এল ‘বুক ফার্ম’। প্রায় ৫০ বছরের আগের পত্রিকার পাতায় হারিয়ে যাওয়া ‘অগ্রন্থিত’ টারজান উপন্যাস যা এডগার রাইজ বারোজের টারজান অনুবাদে নয়, এক মৌলিক টারজান কাহিনি হিসেবে ফিরে এল ‘সব্যসাচী’ (সুধীন্দ্রনাথ রাহা)-র স্বাদু কলমের ছোঁয়ায়। এই সংকলনের পাতায় পাতায় নারায়ণ দেবনাথের দুষ্প্রাপ্য অলংকরণ বইটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
১৯৫২-১৯৯৩ অবধি প্রায় ৪১ বছর ধরে সুধীন্দ্রনাথ রাহা ও নারায়ণ দেবনাথ জুটি টারজান সিরিজের মণিমুক্তো বাংলা সাহিত্যে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। প্রায় ৪১ বছরের এই দীর্ঘ সফরে নারায়ণ দেবনাথের অলংকৃত টারজানের ছবি ৯০০-রও বেশি! বাংলা গ্রন্থ অলংকরণের ইতিহাসে এ-এক নজিরবিহীন রেকর্ড!
আত্মবিস্মৃত বাঙালি আজ ভুলতে বসেছেন ‘সব্যসাচী’রূপী সুধীন্দ্রনাথকে, টারজান-অলংকরণ শিল্পী নারায়ণ দেবনাথকে। সেইজন্যেই ‘বুক ফার্ম’-এর পক্ষ থেকে তাঁদের কথা স্মরণ করে পাঠকদের হাতে বইটি তুলে দেওয়া হল।
📕লেখক : সব্যসাচী (সুধীন্দ্রনাথ রাহা)
📙অলংকরণ : নারায়ণ দেবনাথ
📘সম্পাদনা : ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
📙প্রচ্ছদ : অর্ক চক্রবর্তী
📗প্রকাশক : বুক ফার্ম
📘দাম : (প্রকাশিতব্য)
📘লিঙ্কঃ Boichitro: (প্রকাশিতব্য)
****************************************************************
বিষয় টারজান :
‘ডাইনোসরের দু-পাশে পাখা জুড়ে দিলে যেমন হয় তেমন দেখতে পাখিটা। সোঁ সোঁ করে অনেক উঁচু থেকে নেমে আসছে গাছের মগডালের দিকে। পুরো আকাশের আলো ঢেকে যাচ্ছে পাখার বিস্তারে। গাছের সবচেয়ে উঁচু ডাল থেকে এক অরণ্য-মানব ঝাঁপ দিল সেই পাখির পা লক্ষ্য করে, টারজান’। এই অবধি সবে পড়েছি, কে যেন কানটা ধরে চিৎকার করে উঠল, ‘এটা ভূগোল পড়া হচ্ছে? ভূগোল? হতভাগা, তোর একদিন কি আমার একদিন।’ প্রণব স্যার। আমার গৃহশিক্ষক।
এ আমার তথা সেসময়কার সব কিশোরদের রোজনামচা। স্কুলে হোক আর বাড়িতে, লুকিয়ে লুকিয়ে টারজানের অ্যাডভেঞ্চার পড়তাম সকলেই। টারজান ছিল কিশোর তথা বড়োদেরও ফ্যান্টাসি-হিরো। একসময় ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ টারজানকে নিয়ে যে কী করেছেন, তা কল্পনাতীত। শ্যামল কান্তি দাসের একটি প্রবন্ধ পড়ে জানতে পারি, বিদেশে টারজানের নামে তৈরি হয়েছে হাতঘড়ি, রেকর্ড, বাবলগাম, খেলনা, কফি, বোতাম, আইসক্রিম, পাউরুটি, গার্টার সব হরেকরকম জিনিস। শোনা যায়, টারজান নামাঙ্কিত পাউরুটি খুব জনপ্রিয় হয়। শুধু ১৯৪৩ সালে এই পাউরুটি বিক্রি হয় কয়েক লাখ। এ ছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি শহর আছে যার নাম 'টারজানা'। টারজানের মূল স্রষ্টা এডগার রাইজ বারোজ শহরটি তৈরি করেন। সেখানে লাইব্রেরি, ক্লাব, পোস্ট অফিস, পার্ক, রাস্তা সব টারজানের নামে। এ ছাড়াও, আছে টারজানা চেম্বার অব কমার্স। এমনকী, টি-শার্ট কথাটির টি-টুকুও এসেছে টারজানের আদ্যক্ষর থেকে।
টারজানের স্রষ্টা এডগার রাইজ বারোজের জন্ম শিকাগো শহরের ইলিওনিস অঞ্চলে ১৮৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। বাবা মেজর জর্জ টাইলার বারোজ, মা মেরি ইভালিন বারোজ। এডগার রাইজ এর রাইজ ছোটো থেকে বহু স্কুলে তিনি পড়াশোনা করেন এবং শেষে ম্যাসাচুসেটস-এর ফিলিপ্স অ্যাকাডেমি ও তারপর মিচিগান মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে স্নাতক হন। এরপর ইউনাইটেড স্টেটস মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ব্যর্থ হন ও পরিবর্তে অ্যারিজোনাতে, ঘোড়সওয়ার বাহিনীতে যোগদান করেন। পরে, হৃদ্রোগ ধরা পড়ায় সেখানকার চাকরি হারান। এরপর বহু চাকরি করেন এবং প্রায় সর্বত্রই ব্যর্থ হন। সেসময় তিনি খুব কম পয়সার পেনসিল হোলসেলারের কাজ করছেন বছর সাতেক, নিজের প্রচুর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার নিয়ে আচমকাই ঠিক করলেন গল্প লিখবেন। সেটা ১৯১১ সাল। লিখলেন ‘প্রিন্সেস অব মার্স’ নামে একটি গল্প। ১৯১২ সালে ‘অল স্টোরি’ পত্রিকায় সেটি দুটি কিস্তিতে ছাপা হল এবং তিনি পেলেন চারশো ডলার। এবং, প্রচুর প্রশংসা। উৎসাহিত হয়ে তিনি লিখলেন দ্বিতীয় গল্প ‘টারজান অব দ্য এপস’। ১৯১৪ সালে লেখাটি বই আকারে প্রকাশ পেল। ১৯১৮ সালে সেটি চলচ্চিত্রায়িত হল। আর বারোজকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জীবন থেক চরম দারিদ্র্য ঘুচে গেল। এরপর একের পর এক টারজান আসতে শুরু করল তাঁর কলমে। মোট ২৬টি উপন্যাস টারজানকে কেন্দ্র করে। ‘দ্য রিটার্ন অব টারজান’, ‘দ্য সন অব টারজান’, ‘জাঙ্গল টেলস অব টারজান’, ‘টারজান দ্য আনটেমড’, ‘টারজান অ্যান্ড দ্য লস্ট এম্পারার’, ‘টারজান অ্যান্ড লায়ন ম্যান’, ‘টারজান দ্য ইনভিন্সিবল’, ‘টারজান অ্যান্ড দ্য সিটি অব গোল্ড’ এবং আরও। এরপর বারোজের বই অনুবাদ হতে শুরু করল। প্রায় চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ওঁর টারজান। বিক্রি হয়েছে কোটি কোটি কপি। ১৯৪০ সালে বারোজের টারজানের বই বিক্রি হয়েছিল অন্তত ২৫০ লক্ষ কপি। ১৯৫০ সালের ১৯ মার্চ বারোজের মৃত্যু হয়।
অনূদিত বিভিন্ন ভাষার মধ্যে বাংলা এখানে অগ্রগণ্য। একটি বাংলা কিশোর পত্রিকায় বারোজের টারজান অনূদিত হতে শুরু করল। ধারাবাহিক। নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের চারটি অনুবাদ বাদ দিয়ে প্রায় ৫২ টি টারজানের গল্প ধারাবাহিকভাবে লিখলেন সব্যসাচী। তার সঙ্গে রইল নারায়ণ দেবনাথের অবিশ্বাস্য অলংকরণ ও ছবি (ইলাস্ট্রেশন)। ‘সব্যসাচী’ ছদ্মনামের আড়ালের মানুষটি হলেন সুধীন্দ্রনাথ রাহা। পঞ্চাশের দশক থেকে সুধীন্দ্রনাথ বাঙালি পাঠকসমাজকে ধীরে ধীরে টারজানের নেশায় বুঁদ করে দিতে শুরু করলেন। ঘরে ঘরে, ছোটো থেকে বড়ো টারজান দ্বারা মোহিত হয়ে পড়ল। তার কারণ ভাষা। পড়লে কখনো মনে হত না, এটি অনুবাদ। মনে হত কোনো বাংলা গল্প পড়ছি। শুধু চরিত্রগুলির নাম বিদেশি। এ এক আশ্চর্য কম্বিনেশন। অত্যুচ্চ বুদ্ধিজীবী ছাড়া সেসময় সাধারণ বাঙালি পাঠকের বিদেশি গল্পের সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না। হইহই করে সারাবিশ্বের সাহিত্যকে অঙ্গুলিহেলনে বাঙালি পাঠকের দরবারে হাজির করে দিলেন সুধীন্দ্রনাথ রাহা। খুলে গেল আন্তর্জাতিক সীমানা। কিশোররা সারাপৃথিবী ঘোরার সাধ মেটাতে লাগল টারজানের সঙ্গে। কূপমণ্ডুক বাঙালি সাত সমুদ্র ছয় মহাদেশ, জঙ্গল, পাহাড়, নদী পাড়ি দিতে শুরু করল সুধীন্দ্রনাথের হাত ধরে। জন্ম নিল লক্ষ কোটি টারজান, মানুষের ঘরে, মনে মনে।
সব্যসাচী লিখিত গ্রন্থ আকারে 'অপ্রকাশিত' গল্পগুলি সহ বুক ফার্ম হাজির করছে 'সচিত্র টারজান সিরিজ' নিয়ে। ইতিপূর্বেই দুটি খণ্ড প্রকাশিত। যথারীতি নারায়ণ দেবনাথের অসাধারণ ইলাস্ট্রেশনকে পুনরুজ্জীবিত করেই। আশা করব, তৃতীয় খণ্ডটিও একইরকম মহিমায় উজ্জ্বল থাকবে। সুদীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরের জুটি সুধীন্দ্রনাথ ও নারায়ণ দেবনাথের, তাঁদের দ্বৈত প্রতিভায় আবার স্মরণীয় হয়ে উঠবে তৃতীয় খণ্ডটিও। বর্তমান সময়ে কত হাজার মানুষকে ছুঁতে পারল এই সৃষ্টি, তার চেয়েও অনেক বড়ো হয়ে থাকবে দুই মলাটের মধ্যে আবদ্ধ এই ইতিহাস, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুবাদ সাহিত্যে দিক্নির্দেশ করবে। আর বাংলা সাহিত্য আভূমি কুর্নিশ করবে বুক ফার্মের এই অভিনব প্রচেষ্টাকে।
আসুন, আবার টারজানের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি অ্যাডভেঞ্চারে। আরও একবার।
--- বৈজয়ন্ত রাহা ( পৌত্র: সুধীন্দ্রনাথ রাহা)