30/07/2025
*"জাতের শেকলে বন্দি ন্যায়: দলিতদের গল্প এখনও অসমাপ্ত" গণতন্ত্রে*
*✍🏼কলমে: শুভাশীষ মণ্ডল*
আমরা সবাই কাগজে-কলমে এই দেশের নাগরিক। সংবিধানের পৃষ্ঠায় আমাদের জন্য লেখা আছে সমান অধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতার অঙ্গীকার। কিন্তু বাস্তব জীবনে, সমাজ যেন আমাদের অদৃশ্য রঙে আলাদা করে ফেলে কখনো নাম দেখে, কখনো পদবি দেখে, কখনো জাত দেখে। সেই অদৃশ্য বিভাজনের নিচে সবচেয়ে বেশি পিষ্ট হয় যে সম্প্রদায়, তাদের নাম দলিত।
তাদের কান্না নেই কোনো শিরোনামে, নেই মিছিলের ব্যানারে। তারা যেন ভারতের চুপ করে যাওয়া এক ইতিহাস। যারা আজও জাতপাতের জঞ্জালে আটকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত লড়াই করে বাঁচে। যারা জন্ম নিয়েই অপরাধী হয়ে যায় কারণ সমাজ বলে, ওদের রক্ত "শুদ্ধ" নয়।
স্কুলে যাওয়া, জল খাওয়া, মন্দিরে প্রবেশ, সমান বেতনের দাবি, প্রতিবাদ — এসবই যেন একেকটা বিপদে পড়ার রাস্তা তাদের জন্য। শুধু পদবি বা গাত্রবর্ণের কারণে মানুষকে মেরে ফেলা হয়, ধর্ষণ করা হয়, সমাজচ্যুত করা হয়। অথচ আমরা চুপ থাকি। কারণ আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অভ্যস্ত হয়েছি অমানবিকতাকে পাশ কাটাতে, ব্যথাকে অস্বীকার করতে।
এই সমাজের কোথাও এক কোণে, যেখানে আলো পৌঁছায় না, সেখানে দলিতরা প্রতিদিন হারাচ্ছে নিজেদের অধিকার, সম্মান, নিরাপত্তা — এবং আমরা, যারা দেখতে পাচ্ছি এই অন্যায়, তারা চুপ করে আছি। ঠিক এই নীরবতা থেকেই জন্ম নিচ্ছে সবচেয়ে গভীর প্রশ্ন:
এই সমাজ কি সত্যিই আমাদের সবার জন্য? এই দেশ কি সত্যিই সংবিধান মানে?
* *প্রাচীন ভারত থেকে বর্তমান: এক নির্মম ধারাবাহিকতা*
ভারতে জাতপাতের শিকড় হাজার হাজার বছর ধরে সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। বর্ণব্যবস্থার নামে এই বিভাজন এক প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক ও ধর্মান্ধ মতবাদ, যা মানুষের জন্মগত পরিচয়কে ভিত্তি করে তৈরি করেছে এক জঘন্য সামাজিক কাঠামো। এই কাঠামোর নীচে পড়ে আছে দলিত সমাজ — যাদের কোনো ধর্মস্থানে প্রবেশাধিকার ছিল না, যাদের সঙ্গে উচ্চবর্ণের ছায়াও পড়া নিষিদ্ধ ছিল, যাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনমান ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের দয়ার উপর নির্ভরশীল।
* *স্বাধীনতার পরে দলিত অধিকার ও সংবিধানের প্রতিশ্রুতি*
ভারতের সংবিধান, যার প্রধান রচয়িতা ছিলেন ডঃ বি. আর. আম্বেদকর — নিজেই একজন দলিত — সেই সংবিধান জাতপাতের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
* অনুচ্ছেদ ১৪: সকলের সমান অধিকার
* অনুচ্ছেদ ১৫: জাত, ধর্ম, লিঙ্গ ও জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ
* অনুচ্ছেদ ১৭: অস্পৃশ্যতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
* অনুচ্ছেদ ২১: জীবনের অধিকার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
* SC/ST (Prevention of Atrocities) Act, 1989: দলিতদের প্রতি সংঘটিত অপরাধ কঠোরভাবে দণ্ডনীয়
কিন্তু এই সংবিধান কেবল এক দলিল হয়ে থেকে গেছে। বাস্তবে দলিতদের প্রতি রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গিতে সামান্য পরিবর্তনও আসেনি।
* *প্রতিদিনের দুঃস্বপ্ন — নির্যাতনের ধরন ও বাস্তবতা*
দলিতদের প্রতি সহিংসতা আর নিপীড়ন আজকের ভারতেও ঠিক ততটাই নির্মম ও ন্যক্কারজনক, যতটা তা ছিল প্রাচীনকালে। ধর্ষণ, খুন, পিটুনি, জমি কেড়ে নেওয়া, সামাজিক বয়কট, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে না দেওয়া — এ যেন প্রতিদিনের খবরে পরিণত হয়েছে।
* *সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী*
প্রতি বছর গড়ে ৩০,০০০-এর বেশি মামলা হয় দলিতদের উপর নির্যাতন নিয়ে
প্রতিদিন গড়ে ৮০ টি অপরাধ সংঘটিত হয় দলিতদের বিরুদ্ধে
২০২৩ সালে উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহার — এই চারটি রাজ্য সর্বাধিক অপরাধপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত হয়
* *৫০ টি বাস্তব ঘটনা — সমাজের বিবেক নাড়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট*
1. হাথরাস, ২০২০ (উ.প্র.) – দলিত তরুণীকে গণধর্ষণ ও হত্যা, পুলিশ রাতেই দেহ পুড়িয়ে দেয়
2. উনা, ২০১৬ (গুজরাট) – গরুর চামড়া ছাড়ানোর অভিযোগে দলিত যুবকদের নগ্ন করে মারধর
3. ভোপাল, ২০২২ (ম.প্র.) – পুকুরে স্নান করায় দলিত কিশোরকে গাছে বেঁধে পেটানো
4. জালোর, ২০২২ (রাজস্থান) – দলিত শিশুকে স্কুলে জল খাওয়ায় মারধর করে হত্যা
5. উন্নাও, ২০১৯ (উ.প্র.) – ধর্ষিতা দলিত মেয়েকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা
6. ওড়িশা, ২০২৩ – কূপ থেকে জল তুললে দলিত গৃহবধূকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা
7. তামিলনাড়ু, ২০২২ – মন্দিরে প্রবেশ করায় অন্তঃসত্ত্বা দলিত নারীকে মারধর
8. মহারাষ্ট্র, ২০১৮ – ক্রিকেট খেলায় অংশ নেওয়ায় দলিত যুবককে হত্যা
9. পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৭ – দলিত কিশোরীকে ধর্ষণ করে ভিডিও ভাইরাল
10. হরিয়ানা, ২০২১ – বাড়িতে আগুন দিয়ে দুই দলিত শিশুকে হত্যা
11. বিহার, ২০১৯ – জমি বিরোধে দলিত দম্পতিকে নগ্ন করে ঘোরানো
12. ছত্তিসগড়, ২০২০ – দলিত যুবককে বিষ খাইয়ে হত্যা
13. পাঞ্জাব, ২০১৮ – গুরদ্বারায় প্রবেশ করায় দলিতকে মারধর
14. উত্তরাখণ্ড, ২০২১ – উচ্চবর্ণ ছেলেকে ছোঁয়ায় দলিত ছাত্রকে হত্যা
15. কেরালা, ২০১৯ – পুরোহিত দলিত নারীর বাড়িতে গেলে হুমকি
16. ত্রিপুরা, ২০২৩ – দলিত ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিষ্কার
17. মিজোরাম, ২০২০ – দোকান জ্বালিয়ে দেয় দলিত ব্যবসায়ীর
18. নাগাল্যান্ড, ২০২১ – দলিত শ্রমিককে গণপিটুনি
19. সিকিম, ২০২২ – দলিত ছাত্রকে জাতবিদ্বেষমূলক মন্তব্য
20. অরুণাচল, ২০২২ – দলিত কর্মীকে অফিস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া
21. দিল্লি, ২০২০ – হোলিতে দলিত দম্পতিকে মারধর
22. চণ্ডীগড়, ২০১৯ – দলিত ছাত্রীকে হোস্টেলে বয়কট
23. লখনউ, ২০২১ – দলিত চিকিৎসককে বরখাস্ত
24. গয়া, ২০১৮ – দুধের দোকানে জল চাওয়ায় শিশুকে হত্যা
25. ঝাড়খণ্ড, ২০১৯ – দলিত ছাত্রী আত্মহত্যা করেন অপমান সইতে না পেরে
26. কোয়েম্বাটুর, ২০২৩ – গাড়ির নিচে পিষে হত্যা
27. মেঘালয়, ২০২১ – খনি শ্রমিকদের খাবারে বিষ
28. আসাম, ২০২২ – পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় শিক্ষককে আক্রমণ
29. ভুবনেশ্বর, ২০২০ – ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানো
30. রায়পুর, ২০২৩ – পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু
31. আহমেদাবাদ, ২০২১ – মারধরের ভিডিও ভাইরাল
32. চেন্নাই, ২০২৩ – বাসে হামলা
33. মুম্বাই, ২০২২ – অফিসে বসতে না দিয়ে মেঝেতে বসানো
34. নয়াদিল্লি, ২০২৩ – কবিকে সভা থেকে বের করে দেওয়া
35. বারাণসী, ২০২২ – দলিত পুরোহিতকে অপমান
36. ভোপাল, ২০২১ – বৃদ্ধকে পিটিয়ে ভিডিও লাইভ
37. গোরখপুর, ২০২০ – কনস্টেবলকে মারধর
38. রাঁচি, ২০১৯ – শিক্ষার্থীকে একা বসানো
39. হায়দরাবাদ, ২০২০ – গণধর্ষণ ও ভিডিও
40. বেঙ্গালুরু, ২০২১ – মন্দিরে দেখা গেলে বহিষ্কার
41. গুয়াহাটি, ২০২২ – অপারেশন রুমে ঢুকতে না দেওয়া
42. নয়ডা, ২০২০ – ম্যানহোলে ফেলে হত্যা
43. সুরাট, ২০২৩ – মন্তব্য করে ছুরি মেরে হত্যা
44. কানপুর, ২০১৮ – দোকানে আগুন, পুলিশ মামলা নেয়নি
45. জয়পুর, ২০২২ – ন্যাড়া করে ঘোরানো
46. পাটনা, ২০২৩ – উচ্চবর্ণ পাড়ায় ঢুকতে বাধা
47. মুর্শিদাবাদ, ২০২১ – গাছে বেঁধে শাস্তি
48. নদিয়া, ২০২৩ – অপমান করে বহিষ্কার
49. বারাসাত, ২০২২ – ধর্ষণ ও ভিডিও ভাইরাল
50. কলকাতা, ২০২৩ – জল নিতে গিয়ে হামলা
* *দলিত নারী — দ্বিগুণ শোষণের শিকার*
দলিত নারীরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন। তাঁরা নারী এবং দলিত — দুটি পরিচয়ের ভারে চূর্ণ। তাঁদের উপর ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন সবচেয়ে বেশি, কিন্তু বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। বিয়ের নামে পাচার, যৌন নির্যাতন, ঘরের কাজের পরিচয়ে শোষণ, এবং ধর্ষণের পর মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ — এসব প্রতিদিনের কাহিনি।
* *শহরের আধুনিকতা কি জাতপাত মানে না?*
অনেকেই ভাবেন শহরে জাতপাতের প্রভাব নেই। কিন্তু বাস্তব বলছে:
চাকরিতে রিজিউমে পদবি দেখে বাদ দেওয়া হয়,
ভাড়া বাড়ি না পাওয়া
হোস্টেলে বয়কট
ইউনিভার্সিটিতে আত্মহত্যা (যেমন: রোহিত ভেমুলা, ২০১৬)
চিকিৎসায় অবহেলা
এই সমস্তই জাতবিদ্বেষের এক ঘৃণ্য আধুনিক রূপ। এটি আর কেবল গ্রামীণ সমস্যা নয়।
* *মিডিয়া ও শিক্ষার ভূমিকা*
জাতীয় মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রেই দলিতদের উপর হওয়া অপরাধের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়। হাথরাসের মতো ঘটনায় মিডিয়া প্রথমদিকে চুপ করে থাকে। অন্যদিকে, পাঠ্যপুস্তকে দলিত ইতিহাস, সংগ্রাম, কাহিনি নেই বললেই চলে। রবিদাস, ফুলে, পেরিয়ার, কঁথিরাম, বা দলিত সাহিত্য নিয়ে কোনো পাঠ নেই। ফলে শিক্ষার মাধ্যমে যে বৈষম্য ভাঙার কথা ছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে।
* *আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া*
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ, Amnesty International, Human Rights Watch সবই ভারতের জাতপাতভিত্তিক বৈষম্যের কঠোর সমালোচনা করেছে। UN-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে:
“Caste-based discrimination is not a cultural practice, it is a human rights violation.”
এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত কোটা চালু হয়েছে, যেখানে ভারত এখনো পিছিয়ে।
সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র আইনে নয়, জনসচেতনতা, প্রশাসনিক সদিচ্ছা এবং সামাজিক শিক্ষা-সংস্কারে:
শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার: দলিত ইতিহাস বাধ্যতামূলক করা হোক
আইন প্রয়োগে কঠোরতা: সব থানায় Atrocities Cell
মিডিয়া গাইডলাইন: দলিত সংক্রান্ত খবর বাধ্যতামূলক প্রকাশ
সমাজ সচেতনতা ক্যাম্পেইন: জাত বিরোধী মনোভাব পাল্টাতে গ্রামীণ প্রশিক্ষণ
দলিত নেতৃত্ব বৃদ্ধি: প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মিডিয়ায় দলিত কোটার বাস্তব প্রয়োগ
* *উপসংহার*
দলিত নির্যাতন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। দলিতদের প্রতি অবিচার মানে কেবল একটি শ্রেণিকে নিঃস্ব করা নয়, বরং সংবিধানের প্রতি অবমাননা। আজ যদি সমাজ মুখ ফিরিয়ে থাকে, যদি রাষ্ট্র নীরব থাকে, তাহলে তা কেবল দলিতদের জন্য নয়, বরং আমাদের সবার জন্যই এক অশনি সংকেত।
আমরা যদি এখনও জেগে না উঠি, তাহলে আগামী প্রজন্ম আমাদেরকে একটাই প্রশ্ন করবে — "আপনারা কী করলেন, যখন একজন মানুষকে শুধুমাত্র তার জাতির কারণে মেরে ফেলা হচ্ছিল?"
দিনশেষে আমরা সবাই রক্তমাংসের মানুষ। কোনো ধর্ম, কোনো জাত, কোনো কাস্ট সেই সত্যকে মুছে ফেলতে পারে না। আমাদের বিবেকের কাছে, মানবতার কাছে এবং ইতিহাসের কাছে এখনই দাঁড়ানোর সময়, না হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।