04/06/2025
🗞️ ইতিমধ্যে সকলেই জেনেছেন বিগত ২৬শে মে ও ২৭শে মে স্বাস্থ্য ভবন থেকে প্রকাশ করা দুটি বিজ্ঞাপ্তির মাধ্যমে ২০২৩-২৫ শিক্ষাবর্ষের ৭৭৮ জন ও ২০২২-২৪ শিক্ষাবর্ষের ৮৭১ জন পোস্ট-গ্র্যাজ্যুয়েট জুনিয়র চিকিৎসকের বন্ড পোস্টিংয়ের সংশোধিত ফাইনাল লিস্ট ঘোষণা করা হয় এবং তাতে কেবলমাত্র আর জি কর আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা ডাঃ অনিকেত মাহাত, ডাঃ আসফাকুল্লা নাইয়া ও ডাঃ দেবাশিষ হালদার-এর পোস্টিং পাল্টে দেওয়া হয়। এই নিয়ে মূলত ২টি ধারায় বাক-বিতন্ডা চলছে।
১. আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা এবং সাধারণ জনতা বলছেন যে মেধার ভিত্তিতে প্রকাশিত বন্ড পোস্টিংয়ের পূর্বতন তালিকাকে বর্জন করে নতুন তালিকা প্রস্তুত করে তাতে এই তিন জন চিকিৎসকের পোস্টিং পাল্টে দেওয়া আসলে আন্দোলনকারীদের ওপর শাসকদের প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবের পরিচায়ক।
২. রাজ্য সরকার, শাসক দল ও মিডিয়া হাউসের একাংশ বলছে নতুন পোস্টিং নতুন প্রয়োজনের ভিত্তিতে করা হয়েছে, তাতে এই চিকিৎসকরা বিভিন্ন অজুহাতের আড়ালে ‘গ্রাম্য’ জায়গায় চিকিৎসা করাতে অস্বীকার করছেন। এটা তাদের সুবিধাবাদী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মনোভাবের পরিচায়ক।
আসুন, আমরা বুঝে নিই প্রকৃত সত্য কোথায়।
🔴 বন্ড পোস্টিং কী? সরকারি চাকরির বদলি ও বন্ড পোস্টিংয়ে বদলি কি একই জিনিস?
২০১৩ সালের ৩১শে জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত একটি নোটিসে (Memo no. HF/O/MERT/912/ME/MISC-78- 13) প্রথম পোস্ট গ্র্যাজ্যুয়েট ও পোস্ট ডক্টরাল শিক্ষা শেষে চিকিৎসকদের বন্ড পোস্টিংয়ের বিষয় নিয়ে সরকারি নির্দেশ আসে। এই নোটিসে বলা হয়,
“It has been decided that Doctors, after completing their Postgraduate and Post-Doctoral Education in State Medical Teaching Institutions in West Bengal, will work in Multi-Speciality/Super-Speciality Hospitals, Secondary & Tertiary level hospitals in West Bengal for a period of one year to serve the rural people.”
অর্থাৎ, শিক্ষার শেষে চাকরি নয়, শিক্ষার এক্সটেনশন হিসেবেই বন্ড পোস্টিং নিয়ে আসা হয়।
আবার, ১০ই জুন, ২০১৪ তারিখে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত একটি নোটিসে (No. HF/O/MERT/923/ME/MISC-78-13) বন্ড পোস্টিংয়ের বিষয়টি রাজ্য সরকার সংশোধিত করে বলে,
“........ Now, in partial modification of Notification Number HF/O/MERT/912/ME/MISC-78-13 dated 31 day of July, 2013, _it is hereby ordered that, every postgraduate trainee (other than State Government sponsored in service doctors) has to execute an indemnity bond to serve this State Government for a period of three years after successful completion of Post Doctoral/MD/MS Course and for a period of two years after successful completion of PG Diploma course_, failing which such candidates will be liable to recompense this State Government a penal amount of Rupees Ten lakh for each defaulting year.......”
অর্থাৎ, বন্ড পোস্টিংয়ের সময় বাড়লো এবং এই নোটিসে পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করা হলো যারা বন্ড পোস্টিংয়ে থাকছেন, তারা রাজ্য সরকারকে ‘serve’ করছেন।
স্পষ্টতই, বন্ড পোস্টিং ও সরকারি চাকরি কোনোভাবেই একই বিষয় নয়। বন্ড পোস্টিং শিক্ষার একটা এক্সটেনশন। সরকারি চাকরিতে ‘বদলি’ স্বাভাবিক হলেও, বন্ড পোস্টিং সংক্রান্ত কোনো নোটিসে রাজ্য সরকারের ইচ্ছানুযায়ী ‘বদলি’ করে দেওয়ার কোনো নিয়মের উল্লেখ নেই। যেহেতু বন্ড পোস্টিং চাকরি নয়, তাই এতে বদলিও হয় না। তবে কিছু স্বার্থান্বেষী চক্র এই বিষয়টিকেই গুলিয়ে দিতে চাইছে।
🔴 বন্ড পোস্টিংয়ে সিট অ্যালট হয় কীভাবে?
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বন্ড পোস্টিংয়ের SOP সম্পর্কিত নোটিস (Memo. No. HF/O/H S(MA)1222/HFW-430 tt(tt) I |S2I2022-ADMIN) জারি করা হয়। এই নোটিসের দ্বিতীয় পাতায় 4a) পয়েন্ট অনুযায়ী,
“The candidates who have completed Post Graduate Degree will be posted as
Senior Resident at different Medical Colleges and Hospitals /Teaching Institutions,
which are having either recognized seats or at least LoP conferred by NMC,
throughout the state for initial one year. For the remaining period of the indemnity
bond, they will be posted at different Secondary tier Hospitals and Rural Hospitals,
as per requirement of the Specialist at such hospitals, throughout the state.”
অর্থাৎ, পোস্ট গ্র্যাজ্যুয়েট শেষে চিকিৎসকদের সিনিয়র রেসিডেন্ট হিসেবে বন্ড পোস্টিংয়ের প্রথম বছর বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল / শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পোস্টিং হবে। পরের দুই বছর প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী রাজ্যের বিভিন্ন দ্বিতীয় স্তরের হাসপাতাল বা গ্রামীণ হাসপাতালে পোস্টিং হবে।
আবার, এই নোটিসের তৃতীয় পাতায় 7a) পয়েন্টে বলা রয়েছে,
“ Thereafter the Directorate of Medical Education along with concerned branch of
the Department (MERT) will arrange for engagement of such candidates,
_completing Post Graduate Degree (মোটা অক্ষরে), at different Medical College and Hospitals/Teaching Institutions of the state as Senior Resident for initial one year through Counselling (মোটা অক্ষরে), based on the merit list prepared on basis of the collected stated particulars_. _After completion of one year bond service by such candidates, the Directorate of Health Services along with concerned. branch of the Department [HS(MA)] will arrange for appointment of such candidates at different Secondary tier Hospitals and Rural Hospitals in the state as Senior Resident through further Counselling (মোটা অক্ষরে), based on the merit list already prepared on basis of the collected stated particulars._”
অর্থাৎ, প্রথম বছর বছর বন্ড পোস্টিংয়ের জন্য জুনিয়র চিকিৎসকদের মেরিটের ভিত্তিতে কাউন্সিলিং হবে এবং সেই অনুযায়ী তাদের পোস্টিং হবে। এক বছরের শেষে পুনর্বার মেরিটের ভিত্তিতে কাউন্সিলিং এবং সেই অনুযায়ী আবার পোস্টিং।
এরপর তৃতীয় ও চতুর্থ পাতায় 7d) পয়েন্টে বলা হয়েছে,
“However, as marks and rank of such passed out candidates are usually available from WBUHS after few days/ a week or two of publication of their result, initially such candidates will be engaged at the institution from which they pursued the course just after publication of their result. Thereafter, while they will be posted at different Medical College and Hospitals /Teaching Institutions/Secondary Tier Hospitals/ Rural Hospitals of the state, as the case may be, as Senior Resident through Counselling (in bold letters) on indemnity bond, their bond period will be
effective from date of publication of their result/ completion of tenure of course
which one is later.”
অর্থাৎ, জুনিয়র চিকিৎসকদের পোস্ট গ্র্যাজ্যুয়েট কোর্সে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতেই হবে কাউন্সিলিং এবং রেজাল্ট প্রকাশ বা কোর্স শেষ — যেটা পরে হচ্ছে, সেদিন থেকেই তাদের বন্ডের পোস্টিং শুরু হবে।
এরপর ১৬ই জুন, ২০২৩-এ প্রকাশিত নোটিস (Memo. No. HF/O/HS(MA)/908/HFW-23099/201/2023-DIR MES) বন্ড পোস্টিং কার্যকরী করার জন্য একটি Senior Resident Expert Committee ঘোষণা করা। এখানে বলা হয়,
“A committee, namely, Senior Resident Expert Committee is formed to deal effectively with the plan of distribution of Senior Residents both for the first year and consecutive second and third year _considering the rank wise list obtained from the West Bengal University of Health Sciences by utilizing the method of counselling for a scientific and rational distribution_......”
অর্থাৎ, ‘বিজ্ঞানসম্মত’ ও ‘যৌক্তিক’ পদ্ধতি হিসেবে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রস্তুত হওয়া র্যাঙ্ক অনুযায়ী কাউন্সিলিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বন্ড পোস্টিং কার্যকরী করার কথা পরিষ্কার বলা হয়।
🔴 সমস্যা কোথায়?
২০শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে ২০২২-২৪ শিক্ষাবর্ষে পাস আউট জুনিয়র চিকিৎসকদের বন্ড পোস্টিংয়ের জন্য ভ্যাকেন্সি লিস্ট বার হয় (Memo. No. HF/O/HS(MA)/224/HFW-25099/102/2023-MA)। তাতে মালদার গাজোল এসজিএইচ-এর নামই ছিল না। ডাঃ দেবাশিষ হালদার তার র্যাঙ্ক অনুযায়ী (২৪) ২৭ ফেব্রুয়ারি’২৫ তারিখে কাউন্সিলিংয়ের সময় হাওড়া জেলা হাসপাতালে অ্যানাস্থেসিওলজি-তে Self declaration-এ স্বাক্ষর করেন। অথচ, হঠাৎ করে ২৬শে মে একটি নতুন নোটিসের মাধ্যমে ৭৭৮ জন চিকিৎসকের মধ্যে একমাত্র তার পোস্টিং পাল্টে মালদা-র গাজোল এসজিএইচ-এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, ২১ মার্চ’২৫ তারিখে ২০২৩-২৫ শিক্ষাবর্ষে উত্তীর্ণ চিকিৎসকদের জন্য বন্ড পোস্টিংয়ের ভ্যাকেন্সি লিস্ট প্রকাশিত হয় (Memo No. — HAD/12M-01-2025/M/736)। এতেও রায়গঞ্জ গভ: মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অ্যানাস্থেসিওলজি কিংবা দেবেন মাহাতো গভ: মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, পুরুলিয়া-য় ইএনটি বিভাগে কোনো ভ্যাকেন্সি ছিল না। ডাঃ অনিকেত মাহাত (র্যাঙ্ক ২৪) ও ডাঃ আসফাকুল্লা নাইয়া (র্যাঙ্ক ৫৭৫) যথাক্রমে ২৫ শে মার্চ’২৫ তারিখে আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অ্যানাস্থেসিওলজি এবং ৩রা এপ্রিল’২৫ তারিখে আরামবাগ মেডিকেল কলেজে ইএনটি বিভাগের জন্য Self declaration ফর্মে স্বাক্ষর করেন। আশ্চর্যজনকভাবে, ২৭শে মার্চ প্রকাশিত এক নতুন নোটিসে ৮৭১ জনের মধ্যে বেছে বেছে কেবলমাত্র তাদের দুজনেরই পোস্টিং বদলে ভ্যাকেন্সি লিস্টে নাম না থাকা ২টি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
স্পষ্টতই, রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বন্ড পোস্টিংয়ের নিয়মাবলি ২৬ ও ২৭শে মে তারিখে রাজ্য সরকার নিজেই ভেঙ্গে দিয়েছে শুধুমাত্র তিন জনের পোস্টিং পাল্টে দেওয়ার জন্য। যেখানে রাজ্য সরকার দ্বারা প্রকাশিত একাধিক নোটিসে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে বন্ড পোস্টিংয়ের একমাত্র পদ্ধতি হলো মেধার ভিত্তিতে কাউন্সিলিং, সেখানে এই তিন জনের পোস্টিং হঠাৎ পাল্টে দেওয়াটা চূড়ান্ত বেআইনি।
🔰 রাজ্য সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব
আর জি কর আন্দোলনের প্রথম সারির তিন জন নেতার বন্ড পোস্টিং পাল্টে দিয়ে তাকে সরকারি চাকরির ট্রান্সফারের সাথে গুলিয়ে দিতে চাওয়ার ন্যাক্কারজনক আচরণ প্রমাণ করে রাজ্য সরকার আদতে চূড়ান্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবের বশবর্তী হয়েই এই কাজ করেছে। সাম্প্রতিককালে রাজ্যের বুকে ঘটতে থাকা একের পর এক আন্দোলনে রাজ্য সরকারের নৃশংস দমননীতিই — শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পুলিশ দিয়ে বেধরক পেটানো, আন্দোলনকারী ছাত্রীদের থানায় তুলে নিয়ে নারকীয় অত্যাচার, ছাত্রের ওপর দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি চালিয়ে দেওয়া ইত্যাদি — এই বন্ড পোস্টিং পাল্টে দেওয়ার ঘটনাতে প্রকাশিত হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট তার অবজারভেশনে বলেছিল আর জি কর আন্দোলনের নেতাদের প্রতি ভবিষ্যতে কোনো প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করা যাবে না। অথচ, সুপ্রিম কোর্টের সেই অবজারভেশনকে অগ্রাহ্য করেই ডাঃ অনিকেত মাহাত, ডাঃ আসফাকুল্লা নাইয়া ও ডাঃ দেবাশিষ হালদারের পোস্টিং বেআইনিভাবে পাল্টে দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে থ্রেট দিলো রাজ্য সরকার। আর জি কর আন্দোলনের সময় শুরু থেকেই আমরা দেখেছি থ্রেট কালচারের পান্ডাদের বারংবার মরিয়া হয়ে রক্ষা করতে চেয়েছে রাজ্য সরকার। এমনকি, মুখ্যমন্ত্রী নিজেও থ্রেট কালচারের পান্ডাদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের প্রতি রাজ্য সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব সকলেই জানেন।
আরো একটি প্রশ্ন উঠছে। শুধুই কি আন্দোলনকারীদের ওপর প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে এ কাজ করা হলো নাকি এর মধ্যে আরোও কোন গভীর চক্রান্ত রয়েছে ? হ্যাঁ অবশ্যই রয়েছে। অনিকেতদের বেআইনি ভাবে পোস্টিং দিয়ে, পশ্চিমবাংলার জনগণের মধ্যে বিশেষ করে ছাত্র সমাজের মধ্যে রাজ্য সরকার একটা ভয় তৈরি করতে চাইছে। ছাত্র-ছাত্রীদের মনের মধ্যে ছলে বলে কৌশলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, প্রতিবাদ করলেই ফেল করিয়ে দেওয়া হবে কিংবা কোন না কোন ভাবে তোমাকে হ্যারাসমেন্ট করা হবে। যাতে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরকে সম্পূর্ণভাবে দমন করা যায়।
🔰 কিন্তু, এর মাঝেই বলিষ্ঠভাবে লড়ে যাচ্ছে ডাঃ অনিকেত-রা। ডাঃ অনিকেত মাহাত ইতিমধ্যেই বলেছেন তিনি এই বেআইনি পোস্টিংয়ে জয়েন করবেন না, বেতনও নেবেন না। অনিকেতারা বারবার জানান দিয়ে যাচ্ছে লড়াই তারা ছাড়েনি। তারা ভয় পায়নি। তারা বিক্রি হয়নি। অনিকেত নতি স্বীকার করেনি। আরেকটা অভয়ার মত ঘটনা যেন না ঘটে তার লড়াই থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ক্যারিয়ার কিম্বা পড়াশুনার অজুহাত তারা দেয়নি। তাই এই মুহূর্তে মিথ্যের মায়াজাল ছিঁড়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করাই আমাদের কর্তব্য।
সত্যান্বেষী WhatsApp চ্যানেলটি ফলো করুন :
https://whatsapp.com/channel/0029VaullgzDJ6GtkUhUzV0e