12/10/2025
অনুরূপার বিয়ে
আয়নার সামনে সন্ধ্যার মৃদু আলোয় নিজেকে দেখছিল অনুরূপা। আজ তার রূপের বাহার নেই, পরনে নেই রঙিন বেনারসি, কণ্ঠে নেই হিরে-মুক্তোর হার। মুখুজ্জ্যেরা মস্ত কুলীন, আর কুল বাঁচাতে মেয়েকে বলি দেওয়া তো এদেশের নিয়ম—আর সেটাই হয়েছে। মুণ্ডিত মস্তক, শূন্য সিঁথি আর সাদা থান—এই নিয়মেই কাটাতে হচ্ছে তার জীবন। জীবনের চোদ্দটা বছর তো এই একাদশী করেই কাটিয়ে দিল সে।
অবশ্য যে বিয়ের জেরে সে আজ বিধবা, সেই বিয়ের কথা তার মনেও নেই। শুধু আলমারিতে রাখা চেলিটা দেখলে একটু একটু মনে করার চেষ্টা করে। বিয়ে তো হয়েছিল আট বছর বয়সে, গৌরীদানের মহত্ব রক্ষা করেছিল তার বাবা আর দাদারা। জাত-কুল বাঁচাতে তাকে পড়তে হয়েছিল তিয়াত্তর বছরের এক বুড়ো জমিদারের গলায়, তার বাহাত্তরতম পত্নী হয়ে। বুড়ো বয়সেও নাকি তাঁর যৌবন ছিল সাতাশ বছরের যুবকের মতো, দাদা বলেছিল। এখন শুনে হাসে সে, শুনেছিল নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকাও পণ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।
তার বিয়ের পর ফুলশয্যাও হয়নি, বর কাশতে কাশতে পটল তুলল। শাঁখা-সিঁদুর পরার মেয়াদ ছিল তার মাত্র তিন দিন।
এখন তার বয়স বাইশ। বিধবা, তায় বামুন ঘরের মেয়ে, কাজে নিষেধ তো কম নেই। লেখাপড়া সে কিছু শিখেছিল, কিন্তু বিধবা মেয়ে হলো গিয়ে পরিবারের গলগ্রহ, তাকে দু'বেলা খেতে দেওয়াটাই ঝামেলার, আবার লেখাপড়ার খরচ! তার ওপর বেটাছেলেদের কুনজর তো আছেই।
ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে, সে জানে না। আজ একাদশী, সে জানে আজ তাকে খেতে নেই।..
অনেক বছর শহরে কাটিয়ে আজ গ্রামে ফিরল তপন। সেই ন'বছর বয়সে কলকাতা গিয়েছিল আর ফেরেনি সে। তারপর আজ ফিরল, বি.এ. পাশ করে।
গ্রামে সেরকম কোনো কাজ নেই, চাকরির চেষ্টা করেছে সে। আপাতত পাড়ার এন্ট্রান্স স্কুলে পড়াচ্ছে, চাকরি পেলেই শহরে চলে যাবে সে।
মাঝে মাঝেই যায় বন্ধু কালীনাথের বাড়ি, সেখানেই দেখে ওর মেজবোন অনুকে, ভালো নাম 'অনুরূপা'। শুনেছে বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই ওর বর মারা গেছে, শুনে তার দুঃখও হয়।
পর্দার আড়াল দিয়ে সে অনেকবার তার সুন্দর অথচ বিষণ্ণ মুখখানি দেখেছে, কিন্তু বলতে পারেনি তার মনের কথা।..
"মেজদিদি, তোমাকে তপনদা একটা চিঠি দিয়েছে, এই নাও", ছোট বোন ফুল্লরার কথায় অবাক হলো সে।
খাম ভেঙে চিঠিটা পড়ল। চিঠিতে লেখা,
"তোমাকে অনেকবার দেখেছি প্রিয়, কিন্তু বলতে পারিনি। আমি তোমাকে ভালোবাসি অনু, খুব ভালোবাসি। তোমাকে বিয়েও করতে চাই, যদি রাজি থাকো তুমি। চিন্তা নেই, শহরে বিধবাদের তো বিয়ে হচ্ছে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উদ্যোগে। আর আমি তো ওঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজেই পড়তাম, কাজেই ছাত্রের এ কাজে তিনি সাহায্য করবেন না? তিনি তো শুনেছি নিজ পুত্রেরও বিধবা বিবাহ দিয়েছেন।
বাকি রইলো গ্রামের কথা। তুমি যদি চাও, আজ রাতেই বেরিয়ে পড়ব এ গ্রাম ছেড়ে। কলকাতায় কিছু একটা হয়ে যাবে আমার, দেখো।
জানিও কিন্তু। ইতি,
তপন।"
চিঠিটা পড়ে সে অবাক হয়ে গেল। অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে তপনদার সাথে, মনেও ধরেছিল তাকে; তবু লোকলজ্জার ভয়ে কিছু বলতে পারেনি।
আর পারে না সে, আবার আয়নাটা মুখের সামনে ধরে। দেখে কনের সাজে ওরই মতো দেখতে আরেকটা মুখ যেন বলছে, "ফিরিয়ে দিবি তাকে, যে তোকে দিতে চায় নতুন মুক্তির আস্বাদ?"..
সেদিনই সে চলে যায় তপনের হাত ধরে। গ্রামের সব কলঙ্ক মাথায় নিয়ে জয়ী হয় ওদের ভালোবাসা, কলকাতায় বিয়ে হয় ওদের। মণ্ডপে তখন বাজছিল,
"যদিদং হৃদয়ং মম
তদিদং হৃদয়ং তব।"
অবশেষে বাঁধা পড়ল দুটি হৃদয়। সার্থক হোক তপনের শোনা সে গানের দুই কলি,
"বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে,
সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে!"
সিঁদুরদানের সময় আরেকবার তাকাল তার অনুর দিকে, বড্ড সুন্দর লাগছে কনের বেশে। সাদা থানের মহাশ্বেতা আজ পরিণত হয়েছে রাজরাজেশ্বরীতে, তারই ভালোবাসায়।
কলমে~ সৌমী
ছবি -সংগৃহীত
সৌজন্যে অচেনা path