
07/06/2025
কোরবানির আড়ালে থাকা ভারতের এক অবিশ্বাস্য অর্থনীতি:
দিল্লি, মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, কলকাতা, বেঙ্গালুরু কিংবা লক্ষ্ণৌ – কোরবানির ঈদ এলেই এসব শহরের পশুর হাটে নামে উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু শুধু পশু কেনাবেচা নয়, ঈদুল আযহার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বিশাল অর্থনৈতিক চক্র, যা অনেকেই কল্পনাও করেন না।
🐄 পশু কেনাবেচা ও নগদ লেনদেন
ভারতে প্রতি বছর কোরবানির সময় প্রায় ১.৫ কোটি গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু কোরবানি হয় (আনুমানিক)।
গড়ে যদি একটি পশুর দাম হয় ₹২০,০০০ – ₹৪০,০০০ টাকা, তাহলে শুধু পশু কেনাবেচায় প্রায় ₹৩০,০০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় মাত্র ৭–১০ দিনে!
এই অর্থের প্রায় ৯০%-ই লেনদেন হয় সম্পূর্ণ হাতে হাতে, নগদে – কোনো ব্যাংক, ডিজিটাল পেমেন্ট নয়।
এই লেনদেনের অংশীদার বেশিরভাগই হন গ্রামীণ ও নিম্নবিত্ত মানুষ – যারা পশু বিক্রি করে বছরের বড় আয়ের মুখ দেখেন।
🔪 দেশীয় অস্ত্রের বাজার
একটি গরু কোরবানি ও মাংস কাটতে দরকার হয় ৫–৭টি ছুরি বা ধারালো অস্ত্র।
হায়দ্রাবাদের পুরানা শহর, কলকাতার শ্যামবাজার, দিল্লির সীলমপুর, মুম্বাইয়ের দাদর অঞ্চলে ঈদের আগে ছুরি, চাপাতি, দা, কুড়াল বিক্রির বেচাকেনা হয় প্রতি দোকানে দিনে ₹৫০,০০০–₹১ লক্ষ পর্যন্ত।
ভারতজুড়ে হাজার হাজার ক্ষুদ্র দোকানি ঈদের সময়ে ব্যবসা করে প্রায় ₹৫০০–৭০০ কোটি টাকার বেশি।
🧂 চামড়া, লবণ ও সংরক্ষণ শিল্প
২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে প্রতি বছর ঈদুল আযহায় প্রায় ১ কোটির বেশি চামড়া সংগ্রহ হয় কোরবানির পশু থেকে।
গড়ে এক একটি গরুর চামড়া বিক্রি হয় ₹৫০০–₹৮০০ টাকায়।
ছাগল ও ভেড়ার চামড়া বিক্রি হয় ₹৫০–₹১০০ টাকা দরে।
সব মিলিয়ে চামড়া থেকে লেনদেন হয় প্রায় ₹৭০০–১,০০০ কোটি টাকা।
এই চামড়াগুলো পরবর্তী সময়ে ভারতের ট্যানারি শিল্পে রূপান্তরিত হয়ে জুতা, ব্যাগ ও লেদার গুডস হিসেবে রপ্তানি হয় বিদেশে।
লোনাভলা, কানপুর, চেন্নাই, অগ্রা – এসব অঞ্চলের লেদার ইন্ডাস্ট্রি ঈদের চামড়ার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
🧅 মসলা ও কাঁচা বাজারের উত্থান
কোরবানির ঈদ মানেই মাংস রান্না।
এই সময়েই সবচেয়ে বেশি চাহিদা বাড়ে –পেঁয়াজ,আদা,রসুন,দারুচিনি,এলাচ,লবঙ্গ,মরিচ,তেল।
ভারত সরকার ও বিভিন্ন ট্রেড রিপোর্ট অনুসারে, ঈদের সময়ে শুধু মসলা ও কাঁচা বাজারেই লেনদেন হয় প্রায় ₹১০,০০০ কোটি টাকার বেশি।
🧊 ফ্রিজ ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স বিক্রি
ভারতে বছরে গড়ে ৭০–৮০ লক্ষ ফ্রিজ বিক্রি হয়। তার মধ্যে অন্তত ২০–২৫% বিক্রি হয় কোরবানির ঈদের আগে ও পরে।
গড়ে যদি এক একটি ফ্রিজের দাম হয় ₹১৫,০০০–₹২০,০০০ টাকা, তবে ঈদের সময় ফ্রিজ বিক্রি হয় ₹৩,০০০–₹৫,০০০ কোটি টাকার বেশি।
🐂 পশু পরিবহন, বাঁশ-খুঁটি, খামার খরচ, টোল ও লোকবল
এই সময় পশু পরিবহনের জন্য ট্রাক, পিকআপ, টেম্পো ভাড়া বাড়ে দ্বিগুণ। বাঁশ ও খুঁটির দাম বেড়ে যায় ৩–৪ গুণ।
পশু রাখার সাময়িক খাঁচা, দড়ি, খাদ্য ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠে অস্থায়ী বাজার – যেখানে লেনদেন হয় আরও ₹২,০০০–৩,০০০ কোটি।
নিম্নবিত্তের হাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা!
এই পুরো অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রায় ৭০–৮০% লেনদেন হয়ে থাকে এমন সব মানুষের সঙ্গে যারা মূলত গ্রামীণ কৃষক, খামার মালিক, পশু ব্যবসায়ী, শ্রমিক, ছুরি বিক্রেতা, বাঁশ ব্যবসায়ী, কাঁচা বাজারের হকার ও ফুটপাথ ব্যবসায়ী।
অর্থাৎ এই এক ঈদ ঘিরেই লক্ষ লক্ষ নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরে সারা বছরের মূল আয় চলে আসে।
---
শেষ কথা:
ঈদের কোরবানি শুধু ধর্মীয় ত্যাগ নয় – এটি ভারতের অর্থনীতির এক অপ্রকাশিত অথচ জোরালো অংশ।
এটি একইসাথে দারিদ্র বিমোচন, অর্থ প্রবাহ ও কর্মসংস্থানের এক অনন্য চক্র, যা বছরে একবার হলেও দেশের সর্বস্তরের মানুষের জীবন বদলে দেয়।
আপনি কি এই “অদৃশ্য ইকোনমি”টা আগে কখনও এভাবে ভেবেছিলেন?