26/07/2025
মহারানী ভক্তিপ্রিয়া এবং ভাগ্যক্রমে প্রাপ্ত সেবার সুযোগ
একদা শ্রীধাম বৃন্দাবনের নিকটবর্তী এক গ্রামে, যেখানে ভগবানের প্রতি ভক্তিই ছিল জীবনের মূল ভিত্তি, সেখানে এক বিশেষ কৃষ্ণবর্ণের কুকুর ছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ভক্তিপ্রিয়া। তার চোখ দুটি ছিল শান্ত ও গভীর, আর তার আচরণ ছিল অত্যন্ত বিনয়ী। গ্রামবাসীরা তাকে একটি সুন্দর গোলাপী রঙের পোশাক ও মুকুট পরিয়েছিল, যা তাকে এক রাজকীয় শোভা দিয়েছিল। তার গলায় ছিল একটি হৃদয়-আকৃতির লকেট এবং কপালে একটি লাল টিপ, যা তাকে আরও মায়াময়ী করে তুলেছিল।
ভক্তিপ্রিয়ার দিনের শুরু হত মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শুনে। সে মন্দিরের আশেপাশে ঘুরে বেড়াত, ভক্তদের আগমনে লেজ নাড়ত, এবং কখনও কখনও তাদের কাছে জল বা প্রসাদের জন্য অপেক্ষা করত। তার এই আচরণ দেখে মনে হতো যেন সে পূর্বজন্মের কোনো সুকৃতির ফলস্বরূপ এক পবিত্র পরিবেশে জন্ম নিয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লেখ আছে যে, জীব তার পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে বিভিন্ন যোনিতে জন্মগ্রহণ করে। ভক্তিপ্রিয়াও যেন তার পূর্বকৃত কোনো পুণ্যের কারণে এই পবিত্র ভূমিতে জন্ম নিয়েছিল।
একদিন মন্দিরে একটি বড় সংকীর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ভক্তিপ্রিয়া সারাদিন মন্দিরের প্রাঙ্গণে ভক্তদের মাঝে বিচরণ করছিল। সে কাউকে বিরক্ত করত না, বরং বিনম্রভাবে ভক্তদের পাশে বসে থাকত। কেউ কেউ তাকে প্রসাদ দিলে সে কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করত। একজন প্রবীণ বৈষ্ণব আচার্য তাকে দেখে মন্তব্য করলেন, "এই জীবটি ভাগ্যবান। অন্য অনেক জীব যেখানে নানা প্রকার ক্লেশে জীবন ধারণ করে, সেখানে এই কুকুরটি এমন এক পবিত্র স্থানে জন্ম নিয়েছে যেখানে হরিনাম হয়, ভক্তদের আনাগোনা থাকে। এটি তার পূর্বজন্মের কোনো সুকৃতির ফল।" আচার্য ব্যাখ্যা করলেন যে, সব কুকুর বা সব জীবই একই রকম হয় না। কিছু জীব তাদের পূর্ব কর্মফল অনুসারে বিশেষ পরিস্থিতিতে বা পরিবেশে জন্ম নেয়, যা তাদের পক্ষে ভক্তি বা আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে সহায়ক হতে পারে। ভক্তিপ্রিয়া সেই সৌভাগ্যবান জীবদের মধ্যে অন্যতম ছিল।
আচার্য আরও বললেন, "কেবল জীবের প্রতি সেবা করাই 'প্রকৃত ধর্ম' নয়, যদিও সেবা একটি মহৎ গুণ। প্রকৃত ধর্ম হলো ভগবানের প্রতি নিষ্কপট ভক্তি ও তাঁর নির্দেশিত পথে জীবন যাপন করা। শ্রীমদ্ভাগবতে যেমন বলা হয়েছে, 'ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম্'—ধর্মের তত্ত্ব অত্যন্ত নিগূঢ়। মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আত্ম-উপলব্ধি এবং ভগবানের প্রেমময় সেবা লাভ করা। জীবের প্রতি দয়া, প্রেম, সেবা—এগুলি সবই ভক্তির সহায়ক অঙ্গ। কিন্তু একমাত্র এই সেবাকেই পরম ধর্ম বললে ভুল হবে, কারণ প্রতিটি জীবের মধ্যে যে ভগবান রয়েছেন, সেই উপলব্ধি না থাকলে সেবার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় না।"
ভক্তিপ্রিয়া যদিও একটি পশু ছিল, তবুও তার আচরণে এক প্রকার শুদ্ধতা ও শান্ত ভাব ছিল যা ভক্তদের মন জয় করেছিল। আরতির সময় সে শান্তভাবে বসে আরতি দেখত, যেন নীরব ভক্তি নিবেদন করছিল। চৈতন্যচরিতামৃতে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য জীবের প্রতি যে প্রেমের কথা বলেছেন, তা সকল জীবকে ভগবানের অংশরূপে দেখারই একটি অংশ। ভক্তিপ্রিয়া ছিল সেই পরম ভাগ্যের অধিকারী, যে কিনা এমন এক পরিবেশে জন্ম নিয়েছিল যেখানে তার পক্ষে এই সেবার সুযোগ এসেছিল। তার এই নীরব ভক্তি ও বিনম্রতা, যা ভাগ্যের এক বিশেষ ফলস্বরূপ প্রাপ্ত হয়েছিল, তা গ্রামের সকলের কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রইল যে, এমনকি পশুদের মধ্যেও ভগবানের কৃপা কীভাবে প্রকাশিত হতে পারে, এবং কীভাবে প্রতিটি জীবের মধ্যে থাকা ভগবানের অংশকে সম্মান জানানো উচিত।