20/07/2025
শিরোনাম: "চিরচেনা বেঞ্চ, অপরিচিত সময়"
নাফিজা আজ বহুদিন পর ক্যাম্পাসে এল। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে যেন সময়টা হঠাৎ থেমে গেল। চারপাশটা যেন অপরিচিত, অথচ কোথাও কোথাও এত পরিচিত যে চোখে জল এসে গেল।
দুই বছর আগের একটা দিন মনে পড়ল তার। ভর্তি হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, অনেক স্বপ্ন নিয়ে। প্রথমদিনের সেই আগ্রহ, অচেনা মুখগুলোর সঙ্গে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা, আর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে প্রিয় শিক্ষকদের কথা—যাঁদের পাঠে নাফিজা জীবনের অনেক গভীরতা চিনেছিল।
কিন্তু হঠাৎই জীবনে এল একটা ঝড়। বাবার হঠাৎ অসুস্থতা, পরিবারের দায়িত্ব, আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে তাকে পড়াশোনার মাঝপথেই ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়। প্রতিদিন ক্লাসে যাবার সময়, ব্যাগে বই ভরার শব্দ, লাইব্রেরির গন্ধ, করিডোরে বন্ধুদের হাসি—সব যেন এখন স্বপ্নের মতো লাগে।
নাফিজা চোখ বুজে সেই পুরোনো ক্লাসরুমটাকে কল্পনা করে—প্রফেসর আহমেদের ব্যতিক্রমী লেকচার, জানালার ধারে বসে থাকা তৃষা, ক্লাসে পিছনের বেঞ্চে হেসে পড়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো। সে চুপচাপ অডিটোরিয়ামের দিকে হাঁটে। দরজাটা বন্ধ, কিন্তু ভিতরের নীরবতায় যেন হাজারো স্মৃতির গুঞ্জন।
"এই ক্লাসগুলো শুধু পড়াশোনার জায়গা ছিল না," নাফিজা ভাবল, "এগুলো ছিল আমার শেকড়, আমার বড় হয়ে ওঠার গল্পের পৃষ্ঠা।"
চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রুটা সে মুছে ফেলে। তার হারানো ক্লাসের স্মৃতি হয়তো আর ফিরবে না, কিন্তু সেসব দিন তাকে আজও পথ দেখায়।
আমাদের জীবনে কিছু অধ্যায় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তাদের ছায়া পড়ে থাকে সারাজীবন। হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, অসমাপ্ত পাঠ, ফেলে আসা বন্ধু—সবই আমাদের গল্পের অমূল্য অংশ। তারা আমাদের গড়ে তোলে, একটু একটু করে।
নাফিজা ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসে পা রাখে, যেন বহুদিন পর ফেলে আসা জীবনের একটা অংশকে ছুঁয়ে দেখতে এসেছে। চারপাশটা আগের মতোই আছে, কিন্তু কোথাও যেন নেই—তাকে ছাড়া কিছুই আর আগের মতো মনে হচ্ছে না।
সে দাঁড়িয়ে পড়ে গণিত বিভাগের সেই চেনা ক্লাসরুমের সামনে। দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে তাকাতেই যেন চোখ ভিজে যায়। বোর্ডে চকের লেখা, প্রফেসর আহমেদের গলা, আর ছাত্রদের মনোযোগী মুখগুলো যেন তাকে স্মৃতির গভীরে টেনে নিয়ে যায়।
নাফিজা, তৃষা, অনিক আর সাব্বির—এই চারজন ছিল অবিচ্ছেদ্য এক দল। ক্লাসের পরে সিঁড়ির ধারে বসে চা খাওয়া, প্রজেক্টের রাতভর আলোচনা, কিংবা পরীক্ষা নিয়ে একসাথে দুশ্চিন্তা করা—সব ছিল যেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তৃষা ছিল প্রাণখোলা, যে সবাইকে জোর করে হাসাতে পারত।
অনিক, মেধাবী কিন্তু চুপচাপ। তার সাথে নাফিজার সম্পর্কটা ছিল একটু অন্যরকম। কেউ কিছু বলেনি, কিন্তু তারা দু'জনেই বুঝত কিছু একটা ছিল... হয়তো ভালোবাসা, হয়তো বন্ধুত্বের চেয়ে একটু বেশি কিছু।
আর সাব্বির, যাকে সবাই ডাকত ‘জ্যোতি ভাই’। সব সমস্যার সমাধান জানা লোক।
আজ এক বছর পর সে দাঁড়িয়ে আছে সেই ক্লাসের দরজার সামনে। ভিতরে এখন অন্য ছাত্রছাত্রী, অন্য গল্প, অন্য জীবন। কিন্তু ওই জানালার পাশে একটা বেঞ্চ আছে—যেখানে একদিন নাফিজা বসত।
সে বুঝতে পারে—সেই ক্লাস, সেই বন্ধুরা, সেই দিনগুলো আর কোনোদিন ফিরবে না। তবুও তারা বেঁচে থাকবে তার ভেতরে, জীবনের এক নীরব অধ্যায়ে।
শেষ কথা:- হারিয়ে যাওয়া ক্লাসরুমগুলো শুধু স্মৃতি নয়, তারা হয়ে ওঠে আমাদের শক্তি, ফিরে আসার প্রেরণা। জীবন কখনও পুরোপুরি বন্ধ হয় না, শুধু পৃষ্ঠা বদলায়।