
20/05/2025
**অসমাপ্ত চিঠি**
রাতের নিস্তব্ধতায় শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ। ছোট্ট ঘরের কোণে বসে ছিল রাহুল, হাতে একটা পুরনো চিঠি। চিঠিটা তার বাবা রমেশ লিখেছিলেন, বহু বছর আগে। কিন্তু কখনো শেষ করা হয়নি। রাহুলের চোখে জলের ছায়া, কারণ এই চিঠিই ছিল তার বাবার সঙ্গে শেষ স্মৃতি।
রমেশ ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। গ্রামের ছোট্ট দোকানে তিনি সারাদিন কাজ করতেন। তাঁর হাসি ছিল সবার জন্য, কিন্তু সবচেয়ে বড় হাসিটা তিনি রাখতেন রাহুলের জন্য। রাহুল ছিল তাঁর একমাত্র ছেলে, তাঁর স্বপ্নের আলো। রমেশ প্রতি রাতে রাহুলকে গল্প শোনাতেন—নদীর গল্প, পাহাড়ের গল্প, আর একদিন বড় হয়ে রাহুল যে ডাক্তার হবে, সেই স্বপ্নের গল্প।
কিন্তু জীবন সবসময় স্বপ্নের মতো হয় না। রাহুল যখন দশ বছরের, তখন রমেশের শরীরে রোগ ধরা পড়ল। ডাক্তার বললেন, সময় খুব কম। রমেশ তখনও হাসতেন, রাহুলকে বলতেন, "তুই শক্ত হবি, বাবা। আমি না থাকলেও তুই আমার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখবি।"
রাহুল বুঝত না। সে শুধু তার বাবার হাত ধরে কাঁদত। রমেশ রাতের পর রাত চিঠি লিখতেন। একটা চিঠি, যেটা রাহুলের জন্য। তিনি লিখতেন, "বাবা, তুই যখন বড় হবি, তখন জানবি জীবন কতটা কঠিন। কিন্তু তুই হাল ছাড়বি না। আমি তোকে ভালোবাসি..." কিন্তু চিঠিটা শেষ করার আগেই রমেশ চলে গেলেন।
রাহুলের জীবন থমকে গেল। মা ছিলেন না, বাবাই ছিলেন তার সব। বাবার মৃত্যুর পর সে গ্রামের আত্মীয়দের কাছে বড় হলো। কিন্তু তার হৃদয়ে একটা শূন্যতা ছিল। সে পড়াশোনায় মন দিল, কারণ বাবার স্বপ্ন ছিল তাকে ডাক্তার দেখার। রাতের পর রাত সে সেই অসমাপ্ত চিঠি পড়ত, আর বাবার কথা মনে করে কাঁদত।
বছর কেটে গেল। রাহুল বড় হলো। সে ডাক্তার হলো, ঠিক যেমনটা রমেশ চেয়েছিলেন। কিন্তু তার মনে কোনো আনন্দ ছিল না। সে যত রোগীকে বাঁচাত, ততই মনে হতো, "কেন আমি আমার বাবাকে বাঁচাতে পারিনি?" প্রতি রাতে সে হাসপাতাল থেকে ফিরে সেই চিঠি হাতে নিয়ে বসত। চিঠির শেষ লাইনে বাবার হাতের লেখা অসম্পূর্ণ—যেন তার বাবার জীবনের মতোই।
একদিন, হাসপাতালে এক বৃদ্ধ রোগী এলেন। তিনি রাহুলকে দেখে বললেন, "তোমার চোখে আমি একটা পুরনো বন্ধুকে দেখছি। তুমি রমেশের ছেলে, তাই না?" রাহুলের হৃদয় কেঁপে উঠল। বৃদ্ধ বললেন, "তোমার বাবা আমাকে বলেছিল, তুই তার গর্ব হবি। সে তোকে ভালোবাসত, বাবা। তুই তার স্বপ্ন পূরণ করেছিস।"
সেদিন রাহুল বাড়ি ফিরে চিঠিটা হাতে নিল। সে প্রথমবার কাঁদল না। সে একটা কলম তুলে নিয়ে চিঠির শেষ লাইনটা লিখল: "বাবা, আমি তোমার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছি। কিন্তু আমার হৃদয়ে তুমি ছাড়া সবই অসম্পূর্ণ।"
রাতের নিস্তব্ধতায় রাহুল বুঝল, তার বাবা চলে গেলেও তাঁর ভালোবাসা তার মধ্যে বেঁচে আছে। সেই অসমাপ্ত চিঠি ছিল তাদের বন্ধনের সেতু, যা কখনো ভাঙবে না।
---
It's Humayun