28/09/2025
ইসলামের ইতিহাসে বড়পীর শায়েখ আব্দুল কাদির জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর অবদান
( পর্ব ৫ - বাগদাদের পথে গওসুল আযম )
হুজুর গাউসে পাকের বয়স যখন ১৮ বছর, তখন তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য বাগদাদ শরিফ যাওয়ার ইচ্ছা করলেন সম্মানিতা জননীর কাছে। ততকালীন সময় সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে জ্ঞানচর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ছিল ইরাকের রাজধানী বাগদাদ। খলিফাগণ খুব আন্তরিকতার সাথে এই নগরীকে জ্ঞানবিজ্ঞানের রাজধানীতে পরিনত করেন।
হুজুর গওসুল আযম দাস্তেগীর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আম্মিজান প্রথম থেকেই জানতেন এই সন্তান সাধারণ কেউ নন, বরং মুসলিম উম্মাহর হিদায়তের জন্যই তার জন্ম। বেলায়তের মুকুট তারই শিরে শোভা পাবে। হুজুর গাউসে পাকের আব্বাজান অনেক আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, আম্মাজান বয়স্ক হয়েও নিজের দুঃখ কষ্টের দিকে না তাকিয়ে বৃদ্ধাবস্থার সম্বল আপন সন্তানকে ইসলামের খাতিরে বাগদাদ প্রেরণ করতে রাজি হয়ে যান। হুজুর সুলতানুল আউলিয়ার আম্মিজানের এই আত্মত্যাগকে লক্ষ কোটি সালাম। যখনই হুজুর গাউসে পাকের তাজকেরা হবে, তার সম্মানিতা জননীর আত্মত্যাগের কথা সসম্মানে স্মরণ করা হবে।
গাউসে পাক যখন যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তার সম্মানিত জননী অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, বাবা! তোমার সঙ্গে আমার হয়তো এটাই শেষ দেখা, তুমি বাগদাদ যাও, শিক্ষা অর্জন করো। আর একটা কথা সব সময় মনে রাখবে, যতই বিপদের মুখে পড় না কেন, সর্বাবস্থায় সত্য কথা বলবে। হুজুর গাউসে পাক সারাজীবন এই কথার উপর আমল করেছিলেন। হুজুর গাউসে পাককে তিনি ৪০ দিরহাম স্বর্ণমুদ্রা দেন৷
হুজুর গাউসে আযম একটা কাফেলার সাথে বাগদাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন৷ হামদান নামক এক জায়গা পেরিয়ে কাফেলা পড়ল ডাকাতদের কবলে। ডাকাতেরা শুরু করল যথেচ্ছাচার লুটপাট। সমগ্র কাফেলার মানুষদের চোখমুখে ভয়ের ছাপ, সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত। কেবল আঠারো বছরের যুবক হুজুর গাউসে আযম ব্যতীত।
ডাকাতদের ভিতর থেকে একজন এসে হুজুর গাউসে পাক কে জিজ্ঞেস করল তোমার কাছে কি কিছু আছে?
- গাউসে পাক নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। চল্লিশ দিরহাম স্বর্ণমুদ্রা।
- ডাকাত ভাবল হয়তো ছেলেটা মিথ্যা বলছে, কারণ সেই সময় চল্লিশ দিরহাম স্বর্ণমুদ্রা এখনকার লক্ষ টাকার চেয়েও বেশি এবং এতগুলো মুদ্রা কোনো কিশোরের কাছে থাকবে এটা অকল্পনীয়। তাই সে হেসে উঠলো।
- অন্য আরেকজন এসে জিজ্ঞেস করল, তোমার কাছে কি কিছু আছে?
- গাউসে পাক একই উত্তর দিলেন।
- এতে ঐ ডাকাতটিও হেসে উঠলো। এবার এই হইহট্টগোল ডাকাদের সর্দারের কাছে পৌঁছাল।
- ডাকাতদের সর্দার জিজ্ঞেস করল কী আছে তোমার কাছে?
- গাউসে পাক উত্তর দিলেন ৪০ দিরহাম স্বর্ণমুদ্রা।
- কোথায়?
- গাউসে আযম দেখিয়ে দিলেন কোথায় আছে।
- এই দৃশ্য দেখে ডাকাতদের সর্দার অবাক হয়েগেল আর বললো তুমি যদি আমাদেরকে না বলতে তাহলে আমরা জানতে পারতাম না, তুমি মিথ্যা বলতে পারতে। কিন্তু কেন সত্য বললে?
এবার গাউসে পাক এমন উত্তর দিলেন যে সেই ডাকাতের সর্দারের অন্তর পরিবর্তন হয়ে গেল। আল্লাহওয়ালাদের একটা কথা বা একটা নজর মানুষের হৃদয় পরিবর্তন করতে, সমস্ত পাপ মিটিয়ে দিতে সক্ষম।
- হুজুর গাউসে পাক বললেন, শোনো ! আমি আমার মায়ের কাছে কথা দিয়েছি, জীবনে কখনও মিথ্যা বলব না। এই সামান্য ৪০ দিরহাম স্বর্ণমুদ্রার জন্য কিভাবে সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারি?
হুজুর গাউসে পাকের এই কথাটি সেই ডাকাতের সর্দারের অন্তরে এমন প্রভাব বিস্তার করল যে সে কেঁদে ফেলল, আর বলল আপনি আপনার মায়ের কথার অবাধ্য হননি, কিন্তু আমরা প্রতিনিয়তই আমাদের খালিক ও মালিক আল্লাহ তায়ালার কতই না অবাধ্যতা করেছি। মানুষের সম্পদ লুঠ করেছি,তাদের উপর অত্যাচার করেছি, তাদেরকে মেরে ফেলেছি। আজ আমি তাওবা করতে চাই, ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাই৷
- হুজুর গাউসে আযমের হাতে হাত দিয়ে ডাকাতের সর্দারসহ ৬০ জন সদস্য সেই দিন তাওবা করে পরবর্তী জীবন মানুষের উপকারে এবং ইবাদত ও পরহেজগারিতে অতিবাহিত করেন৷
কবি বলেন,
" নিগাহে ওলি মে বো তাসির দেখি,
বাদালতি হাজারোঁ কি তকদির দেখি।"
এটা মাথায় রাখা দরকার, হুজুর গাউসে পাকের বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর। গাউসে পাকের কদম যত এগিয়েছে রাহাজানরা রাহবার হয়েছে, বেদ্বীনেরা ইমানদার হয়েছে, পথহারা পথ পেয়েছে। এটা তো ছিল বাগদাদ যাওয়ার পথের ঘটনা। এরপর যখন তিনি বাগদাদে যাবেন, সমস্ত ইল্ম অর্জনের পর যখন মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলবেন - আমার কদম সমস্ত ওলিদের গর্দানে, তখন গাউসে পাকের মর্যাদা কোন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে তা সাধারণ তো সাধারণ, অসাধারণ মানুষেরও কল্পনার বাইরে।