
18/06/2025
মহান মার্ক্সবাদী সাহিত্যিক গোর্কি স্মরণে
এই পরিবর্তনশীল প্রকৃতিজগতে যে প্রতিটি ব্যক্তিমানবই পরিবর্তনশীল এবং মানুষ যে সংগ্রামের দ্বারাই তাঁর পরিস্থিতিকে জয় করে ধীরে ধীরে নিজেকে পরিবর্তিত করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়,তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে স্থাপন করে গেছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন পৃথিবী জয়ী সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি। সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে বিশ্বের সর্বকোণে বিখ্যাত হওয়ার মাত্র ১৯ বছর আগে তিনি আত্মঘাতী হতে চেয়েছিলেন। তরুণ বয়স থেকেই কুলি হিসেবে, গুণ টানিয়ে হিসেবে সাধ্যাতীত পরিশ্রম করেছিলেন তিনি, তাই দারিদ্র্যের সাথে তাঁর সখ্যতা ছেলেবেলা থেকেই। কোন মর্মপীড়া তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল অনন্য সাধারণ সাহিত্য সৃষ্টির পথে? গোর্কি কিছু বইপত্র পড়ার মাধ্যমে বুঝেছিলেন, মানুষের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব এবং সেই স্বাধীনতা বোধের দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত করবেন তাঁরই সাথে খেটে চলা শ্রমজীবী মানুষগুলিকে। ঠিক সেইসময়তেই যখন কাজানে ছাত্র আন্দোলোন ফুঁসছে তাঁর এই সঙ্গীরাই ছাত্রদের পেটানোর জন্য উদ্যত হয়। মানুষের এই হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতা তাঁকে বিহ্বল করে তুলেছিল। যন্ত্রণায় পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের বুকে গুলি চালানোর পরেই যখন হাসপাতালে চোখ খুলে দেখেছিলেন সেই সঙ্গীদের ব্যাথায় বিবর্ণ মুখ, নিজের প্রতি ধিক্কারে ভরে উঠেছিল মন। সেদিনই বুঝেছিলেন, মানুষ আসলে খারাপ নয়, পরিস্থিতিটাই খারাপ যা মানুষকে নিষ্ঠুর করে দিচ্ছে। তাই হতাশা-লজ্জার কথা ভুলে নতুন করে জানতে হবে মানুষকে, জীবনকে, দেশকে এবং এমন একটা আদর্শকে যা মানুষকে উপহার হিসেবে দেয় সংগ্রাম।সেই থেকেই নবজন্ম হল তাঁর।
ম্যাক্সিম গোর্কি যার পুরো নাম আসলে আ্যলেক্সেই ম্যাক্সিমভিচ পেশকভ, জন্মেছিলেন ১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ নিঝনি নভগোরদে। গোর্কির রাজনৈতিক জীবন বহু বিচিত্রময়তায় ভরা। গোর্কি রাজনৈতিক পরিমন্ডলে প্রথম পদার্পণ করেন পপ্যুলিস্টদের মাধ্যমে যাদের সাথে তাকে প্রথম পরিচয় ঘটায় এ.এস ডেরেনকভ। এই ডেরেনকভের বাড়িতে গোর্কি সন্ধান পান বহু নিষিদ্ধ বইপত্রের। পরবর্তীকালে গোর্কি লিখেছিলেন তার সাথে ডেরেনকভের দেখা হওয়ার প্রয়োজনীয়তাঃ "For the first time I saw people whose interest lay beyond the everyday care to satisfy their own needs,people who know the life of the toiling masses,and who believed in the necessity and possibility to change that life". কিন্তু কিছুদিন বাদেই গোর্কি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে পপ্যুলিস্টরা যে চিন্তাভাবনা নিয়ে চলে সেগুলির বাস্তব প্রয়োগ আসলে অসম্ভব। তিনি দেখলেন পপ্যুলিস্টরা যা আলোচনা করে তা আসলে কাজে করেনা। যে কৃষি কমিউনের ধারনা নিয়ে পপ্যুলিস্টরা চলত তা আসলে বাস্তব বর্জিত। তিনি স্বেচ্ছায় পড়াশোনা শুরু করলেন একটি পাঠচক্রের মাধ্যমে। তারপর তিনি একটি মিটিংয়ে প্লেখানভের বক্তব্য শুনলেন। সেই মিটিংয়েই তাঁর সাথে সাক্ষাত হয় এন.ই. ফেডেসিভ (Fedaseev) -এর, যে প্রথম কাজানে মার্কসবাদী চক্রের সম্ভাব্য প্রবর্তক। কিছুদিন বাদে তিনি অনুধাবন করতে পারেন একজন ব্যাক্তির পরিবর্তন একমাত্র সম্ভব গোটা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে। ১৮৯২ সাল নাগাদ তিনি সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করলেন তার সাহিত্যিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে। পরবর্তীতে ১৮৯৫ সালে গোর্কি একজন সাংবাদিক হিসেবে লেখা শুরু করলেন সামারা গেজেট ( Samara Gazette) -এ এবং "Iegudiel Khalamida" ছদ্মনামে লিখতে শুরু করলেন। তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে তুলে ধরতে শুরু করলেন শ্রমিকদের করুণ অবস্থা, প্রশাসনের দুর্নীতিপরায়নতা। শ্রমজীবী মানুষের হয়ে তিনি লড়াই শুরু করলেন তাঁর কলমের মাধ্যমে। প্রায় ১৪ মাস সময়ের মধ্যে গোর্কি লিখলেন প্রায় ৩০ খানা গল্প ও কবিতা, ৪১৬ টি আলোচনা, ১৮৫ টি হাস্যরসাত্মক প্রবন্ধ এবং বহু আর্টিকেল। ১৮৯৫ এর ৫ মার্চ গোর্কির "Song of the Falcon" সামারা গেজেটে প্রকাশিত হয়, যা পরবর্তীকালে বিপ্লবীদের প্রিয় কবিতায় পরিণত হয়। এই লেখালেখি করতে গিয়ে তাকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে বহু অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর জায়গায় ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অটল। তাঁর লেখা গল্পগুলি কিছুদিনের মধ্যেই গোটা ইউরোপের শ্রমজীবী মানুষের মনে জায়গা করে নেয়।ইতিমধ্যেই তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয় RSDLP-র (যা থেকেই পরবর্তিকালে বলসশভিক এবং মেনসেভিক-এ বিভাজন হয়)— তিনি পার্টির কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হন। তাদের পত্রিকা ইস্ক্রাতে আর্থিক সাহায্য শুরু করেন। ১৮৯৮ থেকে ১৯০৪ গোর্কির সাহিত্য জীবনের চরম উন্নতির যুগ। এই সময় তাঁর লেখার মাধ্যমে তিনি পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন গোটা ইউরোপের জনসাধারণের কাছে। এই সময় শ্রমজীবী মানুষকে তিনি উপহার দেন দুটি উপন্যাস এবং তিনটি নাটক যেগুলি বিপ্লবের ক্ষেত্রে বহু ভূমিকা পালন করেছিল, পরবর্তীতে যখন RSDLP বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, তিনি ধীরে ধীরে বলশেভিকদের সাথে যুক্ত হন। ২৭ নভেম্বর ১৯০৫ সালে Novaia Zhizn - এর এডিটোরিয়াল অফিসে লেনিনের সাথে তাঁর প্রথম কথা -বার্তা শুরু হয়। আদর্শগত দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁদের সম্পর্ক এগোতে থাকে, যা এক আদর্শ বন্ধুত্বের রূপ পায়। মার্কসবাদ সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান বৃদ্ধি পেতে থাকে লেনিনের সাহচর্যে। ধীরে ধীরে লেখার মাধ্যমে তিনি আত্মনিয়োগ করতে থাকেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে।
গোর্কির রাজনৈতিক জীবনে যত উথ্থান পতনই থাক না কেন, তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে ছিল পরস্পর পরিপূরক দুটি প্রধান প্রসঙ্গ, যাতে উদ্ঘাটিত হয় তাঁর বিশ্ববোধের গহীনতম রহস্য, বাস্তবতার সাথে তাঁর রসসৃষ্টি। সমাজের একেবারে নিচুতলা থেকে বেরিয়ে এসেছে তাঁর সৃষ্টি। শৈশবে যত দুঃখ কষ্ট তিনি সয়েছেন তারই ক্ষতিপূরণ হিসেবে যেন তাঁর লেখাগুলি উঠে এল। প্রথম থেকেই গোর্কির লেখায় ছিল সমাজের বাস্তবতা। তারপর লেনিনের সঙ্গে তারঁ সাক্ষাত ঘটল। তাঁর মাধ্যমে পরিচিত হতে শুরু করলেন মার্কসবাদী আদর্শধারার সঙ্গে। তাঁর লেখার মাধ্যমে মেনে না নেওয়ার বিপ্লবী সংগ্রামী মানবতা যা মানুষকে ভেতর এবং বাইরে থেকে মুক্ত করে। তারপর থেকেই লেখার মাধ্যমে গেয়েছেন মানুষের জয়গান সেই মানুষ যা দুনিয়াকে পরিবর্তন করার শক্তি রাখে।।