20/07/2025
মেয়েমানুষ যতই মুখ্যু হোক তাকে ঠকানো বড় শক্ত, সে সব জেনে বুঝেও চুপ করে থাকে, পাছে তার পাখির বাসাটুকু ভেঙে যায় !"
- আশাপূর্ণা দেবী।
আশাপূর্ণা দেবী। মেয়ের আশা পূর্ণ করায় নাম হল আশাপূর্ণা। কিন্তু অমন সুন্দর নামের পেছনের গল্পটা কিন্তু সুন্দর নয়।
অবহেলা নিয়ে জন্ম। আর মেয়ে সন্তান জন্মাক পরিবারের কেউ সেটা চায়নি। অনেকগুলো কন্যা সন্তান জন্মানোর পর ঘরে আবারো কন্যা সন্তান আসায় ঠাকুমা বলেছিলেন, ‘মেয়ের সাধ পূর্ণ হয়েছে, আর মেয়ে নয়!’ তাই থেকে অমন নাম। জন্মের পরেই অবহেলা, তৎকালীন সময়ে সমাজে নারীদের অবস্থান, তাদের পদে পদে হেনস্থা হতে দেখেছেন নিজের চোখে। চৌদ্দ বছর বয়সে রক্ষণশীল পরিবারে বিয়ে হয়ে যায়, তবুও কী তার লেখালেখি আটকানো গেছে? বাংলা সাহিত্যের নতুন মুকুল হয়ে ফুটেছিলেন তিনি, লেখক হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুলকথা’ দিয়ে।
কিশোরী আশাপূর্ণা একবার রবীন্দ্রনাথকে হঠাৎ চিঠি লিখে ফেলেন। কবি সেই চিঠি পড়ে বুঝেছিলেন, আগামীদিনে বাংলা সাহিত্যে এক সন্ধ্যাতারা ফুটতে চলেছে। মুগ্ধ হয়ে চিঠির জবাবে কবি বলেছিলেন, ‘আশাপূর্ণা, তুমি সম্পূর্ণা।
আশাপূর্ণা দেবীর ৩০-তম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আশাপূর্ণা দেবী
(৮ই জানুয়ারী,১৯০৯ - ১৩ই জুলাই,১৯৯৫)
--------------------------------------------
আশাপূর্ণা দেবী ছোটতে খুব ডাকাবুকো ছিলেন। ঘুড়ি যেমন ওড়াতেন, তেমনই বাধ্য মেয়েও ছিলেন। জন্ম উত্তর কলকাতায়, পটলডাঙায় তাঁর মামাবাড়িতে। আদি নিবাস ছিল হুগলীর বেগমপুর। সেখান থেকে পরে উওর কলকাতার বৃন্দাবন বসু লেনে গুপ্ত পরিবারে বসবাস শুরু করেন। পিতা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং মাতা সরলামুখী দেবী ছিলেন অত্যন্ত বিদূষী মহিলা, সাহিত্যপাঠে তীব্র আকর্ষণ বই-অন্ত তার প্রাণ। বাড়ির কত্রী ছিলেন নিস্তারিনী দেবী অর্থাৎ আশাপূর্ণার ঠাকুমা। উনার কঠোর নির্দেশেই গুপ্ত পরিবারের মেয়েদের বিদ্যালয় নির্ভর শিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তাই সাড়ে পাঁচ বছর বয়সেও আশাপূর্ণা দেবীকে কোনো বিদ্যালয়ের দরজা চেনানো হয়নি। শরিকি বাড়ি থেকে হরেন্দ্রনাথ যখন তাঁর পরিবার নিয়ে আপার সার্কুলার রোডে উঠে এলেন, আশাপূর্ণার বয়স তখন সাড়ে পাঁচ বছর।
১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে মাত্র ১৫ বছর ৮ মাস বয়সে তিনি কৃষ্ণনগর নিবাসী কালিদাস গুপ্তের সহিত বিবাহ হয়। বিয়ের পরের দিন শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় আশাপূর্ণা দেবী তাঁর প্রিয় বইয়ের একটি বড় বাক্স সঙ্গে নিলে আপত্তি করলেন শ্বশুর মহাশয়। সেই আপত্তি অবশ্য ধোপে টিকল না, ত্রাতা হয়ে নববধূর এগিয়ে এলেন স্বামী কালিদাস গুপ্ত, নতুন বউয়ের সঙ্গে বইয়ের বাক্স চলল তাঁর শ্বশুরগৃহে।
১৯২৬ – ১৯২৯ সালের মধ্যে একমাত্র কন্যা পুষ্পরেণু ও দুই পুত্র সন্তান প্রশান্ত ও সুশান্তের জন্ম দেন। এইভাবে তাঁর লেখিকা জীবনের সঙ্গে পরিবার জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এতোসবের মধ্যে দিয়েও তিনি পরিবারের প্রতি কর্তব্যটুকু সামলে রেখেছেন। দীর্ঘ চুয়ান্ন বছর সুখী দাম্পত্যের অসাধারণ ছবি, স্বামী-স্ত্রী'র পাশাপাশি পথচলা। একজন সুগৃহিণীর পক্ষ্যে সুলেখিকা হওয়া যে অসম্ভব নয় , তিনি তা প্রমাণ করে ছেড়েছেন।
আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটে ১৯২২ খ্রীস্টাব্দ থেকে। মাত্র সাড়ে তেরো কিংবা চদ্দো বছর বয়সে তিনি ‘শিশুসাথী‘ পত্রিকায় গোপনে ”বাইরের ডাক” নামে একটি কবিতা পাঠান, তা প্রকাশিত হবার পরই লেখিকা প্রতিভার বিচ্ছুরণ হয়। প্রথম গল্প লেখেন ”পাশাপাশি”। এরপর থেকে আর তিনি পিছন ফিরে তাকানোর সময় সময় পাননি।
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইস্কুলের ভেতর যাওয়া দূরে থাক, চৌকাঠেও পা রাখতে পারেননি। কিন্তু পরে তিনিই আবার তিন হাজার ছোট গল্প, আড়াইশো উপন্যাস, ষাটেরও বেশি ছোটদের কাহিনি, অসংখ্য প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন। বিশ্বভারতীর শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ থেকে অজস্র সম্মানিক ডক্টরেট আর সোনার মেডেল পেয়েছিলেন। এমনকী সর্বভারতীয় স্বীকৃতি ‘জ্ঞানপীঠ’ও হাতে তুলেছিলেন। এমন মানুষই বোধ হয়, নিজেকে অনায়াসে আখ্যা দিতে পারেন – ‘‘আমি মা সরস্বতীর স্টেনোগ্রাফার।’’
তেরো – চোদ্দ বছর বয়স থেকে লেখালেখি করলেও তাঁর আটত্রিশ বছর বয়সে তিনি এক পুরস্কার বিতরনী সভায় যোগ দিয়ে সেখান থেকেই গৃহ ছেড়ে বাইরের জগতে আসেন। এরপর বিভিন্ন সাহিত্যিকদের অর্থাৎ তারাশঙ্কর, সুনীতিকুমার, বিভূতিভূষণ প্রমূখের সহিত পরিচিত হোন।
আশাপূর্ণা দেবী চলে যাওয়ার দু’তিন মাস আগেও লিখেছিলেন। হঠাৎ করেই শরীরটা ভেঙে পড়েছিল। বোঝা যেত, লিখতে কষ্ট হচ্ছে। তবু লিখতেন। কোলের উপর প্যাড নিয়ে লেখার চেষ্টা করতেন। লাইনগুলো ছেড়ে ছেড়ে যেত। অক্ষর কেঁপে যেত। একটা গল্প ওইভাবেই শেষ করেছিলেন। শেষের দিকে শুয়েই থাকতেন।
১৯৯৫ সালের যে দিন চলে গিয়েছিলেন, সেটা ছিল ১৩ই জুলাই। গহন রাতে ঘুমের মধ্যেই কখন যে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল তা কেউ বুঝতে পারেননি।
মেয়ে মানেই ধোয়া তুলসী পাতা নয়। মেয়েরাই কিভাবে মেয়েদের কষ্টের কারণ হয়, তাঁর শক্তিশালী স্পষ্ট লেখাই বুঝিয়ে দেয়। আধুনিকা, নারীবাদী, নারী স্বাধীনতা এসবের কথা বললে যাঁর কথা মনে পড়ে, আজ তাঁর প্রয়াণদিবস।
আশাপূর্ণা দেবীর প্রয়াণ দিবসে তাঁকে অন্তরের শ্রদ্ধা..
"আপনারে দীপ করি জ্বালো,
আপনার যাত্রাপথে --
আপনিই দিতে হবে আলো।"
** স্ফুলিঙ্গ **
# রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
================
আশাপূর্ণা দেবীর বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত কথামালা দেওয়া হল পাঠকের জন্য।
১। চোখকে যদি মনের দর্পন বলা হয়, তো চিঠিকে বলা যেতে পারে মনের ফটোগ্রাফ।
২। যাকে সামনে সমীহ করতে বাধ্য হতে হয়, তাকে আড়ালে নিন্দে করতে না পেলে বাঁচবে কেমন করে মানুষ?
৩। এতো আলো পৃথিবীতে, তবু পৃথিবীর মানুষগুলো এতো অন্ধকারে কেন?
৪। সুখের বদলে সম্মান বিকাইয়া দেওয়া যায় না। সুখ বিদায় হোক — সম্মান থাক জীবনে।
৫। মলাটের চেহারা কতোটা চিত্তাকর্ষক করতে পারলে বই কতোখানি চিত্তাকর্ষক হতে পারে, সেই চিন্তায় মাথা ঘামাচ্ছি আমরা। অবশ্য সারা পৃথিবী জুড়ে তো এখন মলাটেরই যুগ চলছে।
৬। উঁচুতে উঠতে হলে কত নীচুতে নামতে হয়। কিন্তু সেটা সত্যি উঁচু নয় বলেই তো। অথচ এই পৃথিবী ওইটাকেই সত্যি উঁচু ভেবে অবিরত নীচে নেমে চলেছে।
৭। নারী ছলনাময়ী, নারী জন্ম অভিনেত্রী। কিন্তু সে কি শুধু পুরুষজাতিকে মুগ্ধ করবার জন্যে? বিভ্রান্ত করবার জন্যে? বাঁচবার জন্যে নয়? আশ্রয় দেবার জন্যে নয়?
৮। মেয়েমানুষ যতক্ষণ না নিজের স্বার্থ কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায়, ততক্ষণ তাকে কে চিনতে পারে।
৯। সংসার মানুষকে চেপে পিষে ফেলে, বিশেষ করে মেয়ে মানুষকে। তার ভিতরকার যা কিছু মাধুর্য, যা কিছু কোমলতা, যা কিছু ছাঁচ, সব যেন ঘষে ক্ষইয়ে ভোঁতা করে শুকিয়ে চারটি ধুলোবালি করে ছেড়ে দেয়।
১০। আপাতদৃষ্টিতে যাকে সুখী মনে হয় সে হয়তো আদৌ সুখী নয়, আবার যাকে নেহাৎ দুঃখী মনে হয় যে সত্যিকারের দুঃখী নয়। বাইরের চেহারা আর ভেতরের চেহারা দুটোর মধ্যে হয়তো আকাশ পাcollected
pic👉👉zee Bangla..
collected