04/08/2025
মাত্র ৩৫ রান বাকি ছিল ইংল্যান্ডের
ঠিকই শুনছেন, পঁইত্রিশ মাত্র!
ভারতের প্রয়োজন তখন ও চারখানা উইকেট।
পাল্লা কার ভারী লাগছে আপনার?
নব্বই শতাংশ মানুষ তখনই বলে দিয়েছে, ইংল্যান্ড এই ম্যাচ গিলে খাবে। প্রথম কুড়ি মিনিটেই এই রান অনায়াসে উঠে আসবে ইংল্যান্ডের খাতায়।
তাদের হাতে ‘বাজবল’,
তাদের ব্যাটে আগুন,
তাদের চোখে আত্মবিশ্বাস।
আর ভারতের?
শুধু একটা জিনিস... আবেগ।
ঠিক এক্সাক্টলি, এই আবেগ দিয়েই শুরু হলো ইতিহাসের নতুন লেখা।
একটা স্পেল, একটা মোচড়, একটা চিৎকার,
আর সেই আবেগে গড়ে উঠল এক মহাকাব্য।
লন্ডনের ওভাল ময়দান, ইংল্যান্ড বনাম ভারত, পঞ্চম এবং শেষ টেস্ট।
ম্যাচের বল পড়ার আগেই লড়াই শুরু।
ভারতের কোচ গৌতম গম্ভীর দাঁড়িয়ে, পিচের দিকে চেয়ে আছেন, চোখে আগুন।
পিচের সবুজ ঘাস আর শুকনো ফাটল দেখে পিচ কিউরেটরের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ।
বোঝা যাচ্ছিল, এটা ক্রিকেটের মাঠ নয়, এটা যুদ্ধের ময়দান।
ভারত এখানে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে আসেনি।
শুরু হলো সেই মুহূর্ত, পাঁচ ম্যাচের লম্বা টেস্ট সিরিজের শেষ ম্যাচের প্রথম দিন।
ভারত ব্যাট করতে নামল।
সেই গ্রিন টপে, যেখানে পিচ এবং মাঠ আলাদা করা যাচ্ছে না! যেন সাংঘাতিক ব্যাপার!
ইংল্যান্ডের পেসারদের আঘাতে ভারতের টপ অর্ডার একের পর এক ভেঙে পড়ল, মাঠ যেন তাসের ঘর।
কিন্তু সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন করুণ নায়ার। একটা লড়াকু অর্ধশতরান। একটা শেষ ফাইট ব্যাক! যে ইনিংস ভারতকে পৌঁছে দিল ২২৪ রানে।
এইবার ইংল্যান্ড ব্যাট করতে নামল আর শুরুতেই ঝড় ওপেনাররা যেন আগুন ঝরাচ্ছে। তাদের সো কলড বাজবল যেন শুরু হয়ে গিয়েছে!
দর্শকদের মনে প্রশ্ন, ‘এবার বুঝি শেষ!’
কিন্তু না। সিরাজ আর প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা তখনও বাকি ছিলেন।
দুজন মিলে ফিরিয়ে দিলেন ইংলিশ বাহিনীকে।
ম্যাচে ফিরল ভারত। এক অসামান্য শুরু থেকে ইংল্যান্ড কল্যাপস হয়ে গেল মাত্র ২৪৭ রানে।
এইবার ব্যাট করতে নামল ভারতের ভবিষ্যৎ, যশস্বী জয়সওয়াল। একটা কবিতার মতো শতরান। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন নাইট ওয়াচম্যান আকাশ দীপ, জাদেজা, আর ওয়াশিংটন সুন্দরের অর্ধশতরান।
ভারত দাঁড় করিয়ে দিল ৩৯৬ রানের পাহাড়। ইংল্যান্ডের লক্ষ্য ৩৭৪ রান, এটি করে দিতে পারলেই সিরিজ তাদের!
উত্তরে ইংল্যান্ড?
তারা তো আগেই বলে রেখেছে, ‘আমরা ভয় পাই না।’
রুট ও হ্যারি ব্রুক, এক ভয়ংকর জুটি।
তাদের প্রতিটা শটে ভারতীয় হৃদয় কেঁপে উঠছে।
ম্যাচ ভারতের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় আরেক অঘটন, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণার বলে ব্রুকের শটে বল আকাশে উঠে গেল, বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে সিরাজ, সবাই নিশ্চিত ক্লিন ক্যাচ হবে, সিরাজ টের পেলেন না তার পা ঠেকে গিয়েছে বাউন্ডারি রোপে, আম্পায়ার দু হাত তুলে জানালেন ছক্কা এটি!
শুধু সিরাজ নয়, গোটা ভারতীয় ক্রিকেটার ও ফ্যানদের মুখে হতাশার ছবি! ব্রুক এর এই ক্যাচটি কতটা দামী হতে পারে? হলো ও তাই, ১০০ রানের জোরালো ইনিংস খেলে দিলেন হ্যারি ব্রুক, যেন ভারতের সব আশা শেষ!
ঠিক সেই সময়, সেই গল্প ঘোরানো মোড়!
আকাশ দীপ এলেন।
এক ডেলিভারি, আর বিদায় নিলেন হ্যারি ব্রুক, ক্যাচ সেই সিরাজের হাতেই, কিন্তু তখনও প্রশ্ন বড্ড কি দেরি হয়ে গেল?
ম্যাচে প্রাণ ফিরল।
প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা আর সিরাজ তখন একেকটা আগুনের গোলা ছুঁড়ে দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে সাথে সাথে আরও উইকেট পড়তে থাকলো, যেন অদ্ভুত টার্ন নিল সেই ম্যাচ, দর্শকের উল্লাস ফেটে পড়ার মতো।
কিন্তু ওই যে বলে না সবকিছু যখন আপনার পক্ষে যায়, তার পরবর্তী মুহূর্তেই এমন কিছু অপেক্ষা করে যা পুরোটাই আনএক্সপেক্টেড। কালো করে এলো আকাশ, যেন ইংল্যান্ডের শিবিরের প্রতি ছবি এটি, নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আম্পায়ার জানালেন আজকের দিনের জন্য খেলা সমাপ্ত। খেলা হবে আগামীকাল।
চতুর্থ দিনের শেষে, ইংল্যান্ডের দরকার মাত্র ৩৫ রান, হাতে ৪ উইকেট। পুরো থ্রিলার!
পঞ্চম দিন, গোটা এত লম্বা টেস্ট সিরিজের শেষ দিন, শুরু হলো ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে, গতকাল পিচ যেখানে ভেঙে গিয়েছিল, সকালবেলা দেখা যায় সেই পিচ কিউরেটর ভারী রোলার চালিয়ে পিচ সপাট করছেন। ফলে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং আরো সুবিধাজনক মনে হবে এটি আশা করাই যাচ্ছিল।
পঞ্চম দিনের শুরু।
প্রথম দুটো বলেই আক্রমণাত্মক আবার ইংল্যান্ড!
জেমি ওভারটন দুটো বাউন্ডারি এমন ভাবে মেরে ম্যাচটা শুরু করলেন যেন তারা বলে দিলেন আর দশ মিনিট লাগবে খেলাটা শেষ হতে। ‘খেলা বুঝি শেষ!’
তখনই এলেন সিরাজ, কি লাইন কি লেন্থ!
প্রথমে ফিরিয়ে দিলেন স্মিথকে। কট বিহাইন্ড।
তারপর সেই জাদুকরী মুহূর্ত, ওভারটনের বিরুদ্ধে ডিআরএস! বড় স্ক্রিনে ভেসে উঠল, আউট! যেন শেষ কাঁটা তুলে নেওয়া হল!
প্রসিদ্ধ তুললেন নবম উইকেট। ক্লিন বোল্ড করে দিলেন টাং কে। ভারতীয় গ্যালারি উচ্ছসিত, সাহেবরা নিঃশব্দ।
ঠিক তখনই মাঠে নামলেন এক আহত যোদ্ধা, ক্রিস ওক্স।
হাত বাঁধা, চোখে যন্ত্রণা। মাঠে নামলেন দেশের জন্য।
মনে পড়ে গেল, ঋষভ পন্থও জাস্ট আগের টেস্ট ম্যাচ ভাঙা পা নিয়ে নেমেছিলেন। তখন ইংল্যান্ড দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছিল।
আজ ভারত দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল ওক্সকে। হাততালির আওয়াজে আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না স্টেডিয়ামে।
এই এক মুহূর্তে দল, দেশ, প্রতিপক্ষ, সব মিলিয়ে এক হয়ে গেল টেস্ট ক্রিকেটের আত্মা।
তারপর শেষ টুইস্ট ইন দ্যা টেল।
গাস অ্যাটকিনশন মারলেন একটা বড় ছক্কা! এইবার হৃদপিন্ডের গতিবেগ যেন কাউন্ট করা আর যাচ্ছিল না, প্রতি মুহূর্তে ভয় কি হবে এবার!
ইংল্যান্ডের জিততে দরকার মাত্র সাত রান, আর একটা ছয় যদি মেরে দেয় তাহলে ম্যাচ ড্র, ভারত আর সিরিজকে ড্র করতে পারবেনা, ইংল্যান্ডের সিরিজ নিশ্চিত হবে।
তারপর, ঠিকই ধরেছেন! মিয়া ম্যাজিক!
শেষ স্ট্রাইক।
সিরাজ দৌড় শুরু করলেন।
এক নিখুঁত ডেলিভারিতে গাস অ্যাটকিনসনের স্টাম্প ছিটকে গেল। অদ্ভুত এক ডিপিং ডেলিভারি।
ভারত জিতল মাত্র ৬ রানে! সিরিজ ২-২!
চারপাশে উল্লাস, চিৎকার, চোখের জল।
গম্ভীরের আগুন, যশস্বীর শিল্প, সিরাজের গর্জন, ওক্সের হেঁটে আসা...
এই সবকিছু মিলেই টেস্ট ক্রিকেট এক অসামান্য দৃশ্যে পরিণত হলো।
শেষ হল পাঁচ ম্যাচের এক অসাধারণ সিরিজ, কত কিছুই না শেখালো আমাদের এই সিরিজ! আমরা কেউ স্টুডেন্ট, কেউ কর্মজীবনে ব্যস্ত এমপ্লয়ি, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ আমরা বিভিন্ন জায়গায় প্রত্যেকদিন ক্রমাগত লড়াই করে চলেছি,
একবার বলুন তো যদি আপনি সত্যিকারের মনের থেকে ক্রিকেট ভক্ত হন, তাহলে এই সিরিজ যে কতটা উপলব্ধ করেছেন আপনি আমি নিশ্চিত যে আপনি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবেন না!
নতুন ইন্ডিয়ান টিম এত ভালো প্রদর্শন করবে পুরোটাই আনএক্সপেক্টেড ছিল যেন সবার কাছে! শুধু তারা প্রদর্শন করল না, আমাদেরকে এক অসাধারণ শিক্ষাও দিয়ে গেল! হার না মানার শিক্ষা, লড়াই করার শিক্ষা! জেতার খিদে রাখার শিক্ষা।
কারণ, টেস্ট ক্রিকেট আমাদের শেখায়, জীবন কখনোই একটা টি-টোয়েন্টি নয়। এখানে সব কিছু তাত্ক্ষণিক হয় না। এখানে ধৈর্য লাগে, লড়াই লাগে, বারবার ব্যর্থ হয়েও আবার দাঁড়িয়ে পড়ার মানসিকতা লাগে। একটা ক্যাচ, একটা স্পেল, একটা ইনিংস বদলে দিতে পারে পাঁচদিনের গল্প। এই খেলাটা ঠিক যেন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
আর ঠিক এই কারণেই টেস্ট ক্রিকেটকে ভালোবাসতে হয়। কারণ এটা শুধু স্কোরবোর্ডের খেলা নয়, এটা হৃদয়ের খেলা। এখানে ব্যথা লুকিয়ে চোখে জল নিয়েও কেউ বল করে যায়, কেউ ব্যাট তুলে নেয় শুধু দেশের নামে। যেখানে ‘নায়ক’ শুধু রান করা কেউ নয়, নায়ক সেই, যে এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে না দিয়ে লড়াই চালিয়ে যায়। এটাই টেস্ট। এটাই ক্রিকেট। এটাই ভালোবাসা।
এরকম জিনিস আমাদের কোন বইও শেখাতে পারে না। যেভাবে ক্রিকেট আমাদের শেখায়, টেস্ট ক্রিকেট শেখায়।
এই খেলাকে ভালো না বেসে থাকা যায় এখনো? আপনিই বলুন তো!
এই জন্যই তো বলি বারবার,
টেস্ট ক্রিকেট, ইউ বিউটি ❤️✨