20/10/2025
#জঙ্গলমহলের_মাটিতে_কাজ_নেই, #তাই_মাটি_ছাড়ছে_তরুণেরা
জঙ্গলমহলের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রকৃতি ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হলেও আজও দারিদ্র্য ও বেকারত্বে জর্জরিত। এখানকার তরুণেরা প্রতি বছর হাজারে হাজারে গুজরাট, কেরল, কর্ণাটক, দিল্লি, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে কাজের সন্ধানে চলে যায়—নির্মাণ শ্রমিক, সিকিউরিটি গার্ড, হোটেল কর্মী কিংবা কারখানা শ্রমিক হিসেবে। কারণগুলো বহুমুখী—অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, শিক্ষাগত ও পরিবেশগত সব দিকেই তাদের সুযোগ সীমিত।
পুরুলিয়ার ৮৭.২৬ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে, যেখানে কৃষিই একমাত্র জীবিকা। কিন্তু কৃষি মৌসুমি ও অনিশ্চিত। বাঁকুড়ায় প্রায় ৬৫ শতাংশ সেচ খালের উপর নির্ভরশীল, ফলে বৃষ্টির অভাব ঘটলে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। ICAR–CRIDA-র হিসাবে এই অঞ্চল রেইনফেড এলাকা, অর্থাৎ জলনির্ভর নয়—ফলে খরায় আয় থেমে যায়, কৃষকের হাতে কাজ থাকে না। সেই সঙ্গে মনরেগার কাজও অনিয়মিত; ২০২০–২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে ১.৩১ কোটি মানুষ কাজ পেয়েছিল, ২০২২–২৩-এ তা নেমে আসে মাত্র ২৪ লক্ষে। নিরাপত্তা-জাল দুর্বল হয়ে পড়েছে। তরুণেরা তাই মৌসুমি চাষ বা সরকারি প্রকল্পে কাজের আশা না রেখে বাইরে বেরিয়ে পড়ছে।
শিল্পের অবস্থা আরও করুণ। পুরুলিয়ার জেলা শিল্প প্রোফাইল বলছে, এখানে মাঝারি শিল্প ইউনিট হাতে গোনা কয়েকটি, নতুন MSME প্রস্তাবও মাত্র তিরিশের মতো—যেখান থেকে সম্ভাব্য কর্মসংস্থান পাঁচ হাজারের বেশি নয়। পুঁজির অভাব, ব্যাংকিং সেবার সীমাবদ্ধতা ও বাজার সংযোগের ঘাটতি মিলিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি হয় না। যে কয়েকটি খনিজ বা ইটভাটা খাত আছে, সেগুলোতেও কাজ অনিয়মিত ও ঝুঁকিপূর্ণ।
শিক্ষা ও দক্ষতার ঘাটতিই জঙ্গলমহলের সবচেয়ে বড় সমস্যা। পুরুলিয়ার সাক্ষরতা মাত্র ৬৫.৩৮ শতাংশ, বাঁকুড়ায় ৭০.৯৫ শতাংশ, পশ্চিম মেদিনীপুরে ৭৮–৮৫ শতাংশ হলেও সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে তা নেমে আসে ৫৪.৭ শতাংশে। নারী সাক্ষরতা আরও কম—পুরুলিয়ায় ৫০.৫, বাঁকুড়ায় ৬০.৪ শতাংশ। শিক্ষার এই ফাঁকই চাকরির সুযোগের দরজা বন্ধ করে দেয়। স্থানীয়ভাবে আইটি বা টেকনিক্যাল শিক্ষার কেন্দ্র প্রায় নেই, ভোকেশনাল প্রশিক্ষণও শহরমুখী। ফলে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ না পেয়ে তরুণেরা গুজরাট বা দক্ষিণ ভারতের শিল্পাঞ্চলে কাজ নিতে বাধ্য হয়।
ভাষা ও সংস্কৃতির কারণেও তারা পিছিয়ে পড়ে। ঝাড়গ্রামে প্রায় ১৮.৭ শতাংশ মানুষ সাঁওতালি ভাষাভাষী। বাংলা বা ইংরেজিতে দক্ষতা না থাকায় চাকরির পরীক্ষায় বা ইন্টারভিউয়ে তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। স্থানীয়ভাবে রোল মডেল বা ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং নেই, ফলে আত্মীয় বা দালালের হাত ধরে অন্য রাজ্যে যাওয়াই সহজ মনে হয়। নারী শ্রম অংশগ্রহণও আশঙ্কাজনকভাবে কম। NFHS–৫ অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের অ্যানিমিয়ার হার ৬৩ শতাংশের কাছাকাছি; দুর্বল স্বাস্থ্য ও পুষ্টির কারণে অনেকেই নিয়মিত কাজ করতে পারেন না। পরিবারের আর্থিক চাপ সামলাতে পুরুষ সদস্যই বাইরে যায়।
প্রশাসনিক পরিকাঠামোও অত্যন্ত দুর্বল। পুরুলিয়ায় প্রায় চার লক্ষের বেশি পরিবার ‘ডিপ্রাইভড হাউজহোল্ড’ হিসেবে চিহ্নিত। সড়ক, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা সবই ভঙ্গুর। বহু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই। বিদ্যুৎ অনিয়মিত, নেটওয়ার্ক দুর্বল। অনেক স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ইন্টারনেটই নেই, ফলে অনলাইন আবেদন বা ই-লার্নিং কার্যত অসম্ভব। গ্রামীণ জনঘনত্ব ৪৬৮ জন প্রতি বর্গকিলোমিটার, কিন্তু গ্রামগুলি দূরত্বে বিচ্ছিন্ন, বাজারে পৌঁছাতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। ছোট ব্যবসার জন্য এটি মারাত্মক ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়।
জঙ্গলমহলের মাটি মূলত লালমাটি ও ল্যাটেরাইট; জলধারণ ক্ষমতা কম, তাই চাষাবাদে ঝুঁকি বেশি। বনজ ও খনিজ সম্পদ প্রচুর থাকলেও স্থানীয়রা তার থেকে ন্যায্য আয় পায় না। বড় প্রকল্পে বাইরের শ্রমিকদের অগ্রাধিকার থাকে, স্থানীয়রা পায় সামান্য মজুরির অনিরাপদ কাজ। পাথরখাদান, ইটভাটা, খনি—সব ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রবল। ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, দুর্ঘটনার আশঙ্কা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ—সব মিলিয়ে তরুণেরা অন্য রাজ্যে পাড়ি দেয়।
এই অঞ্চলের অনেক পরিবার এখন পরিযায়ী শ্রমিকের পাঠানো টাকায় বেঁচে থাকে। একবার কেউ বাইরে গেলে পরিবারে সেটিই পথচলার দিশা হয়। PLFS–এর তথ্যে দেখা যায়, গ্রামীণ বেকারত্বের হার ২.৪ শতাংশ হলেও কর্মসংস্থানের মান খারাপ—বেশিরভাগই আংশিক বা স্বল্প মজুরির কাজ। সেই বাস্তবতাই তরুণদের শহরমুখী করে। পশ্চিমবঙ্গে মনরেগা বা সরকারি নিয়োগ প্রায় বন্ধ, নতুন শিল্প আসছে না, বেসরকারি বিনিয়োগও নগণ্য। এই অবস্থায় বাইরে গিয়ে কাজ নেওয়াই তাদের কাছে টিকে থাকার একমাত্র উপায়।
সমাজে সফল রোল মডেল কম, সরকারি অফিসে ঘুষের সংস্কৃতি প্রচলিত, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নিষ্ক্রিয়। মদ্যপান, হতাশা, কাজের অভাবে সামাজিক ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। নারীরা শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাবে ঘরবন্দি, তরুণ পুরুষেরা নির্মাণ শ্রমিক বা সিকিউরিটি গার্ড হয়ে বাইরে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, পুরুলিয়ার জনসংখ্যার ঘনত্ব ৪৬৮, সাক্ষরতা ৬৫ শতাংশ, নারী সাক্ষরতা ৫০ শতাংশ, সাঁওতাল সাক্ষরতা ৫৫ শতাংশের নিচে, মহিলা অ্যানিমিয়া ৬৩ শতাংশ, মনরেগা আবেদন ১.৩১ কোটি থেকে নেমে ২৪ লক্ষে। এই প্রতিটি সংখ্যাই এক একটি বাস্তবতার প্রতিফলন—একটি অঞ্চলের ক্রমাগত অবনতি ও প্রান্তিকীকরণের চিত্র।
তবু সমাধানের পথ রয়েছে। ছোট জলাধার, মাইক্রো সেচ ও হর্টিকালচার বাড়ানো গেলে কৃষিতে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। স্থানীয় কাঁচামাল ঘিরে MSME ক্লাস্টার, টেরাকোটা, ল্যাক ও খনিজ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তোলা দরকার। প্রতিটি ব্লকে আইটি-ভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র ও ডিজিটাল ক্যারিয়ার হাব তৈরি করতে হবে। নারীস্বনির্ভর গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পকে বাজারের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। স্কুলে নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট ও ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। পর্যটন, সংস্কৃতি ও হস্তশিল্প ঘিরে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও স্থানীয় যুবশক্তিকে নীতি প্রণয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।
জঙ্গলমহলের তরুণেরা কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে যায় কারণ তাদের মাটিতে কাজের মর্যাদা ও স্থায়িত্ব নেই। তারা যে মাটিতে জন্মেছে, সেই মাটির উন্নয়নের জন্য তাদের শ্রমই যদি অন্য রাজ্যে চলে যায়, তাহলে সেই অঞ্চল চিরকাল পিছিয়ে থাকবে। জঙ্গলমহল ভারতের উন্নয়নের মানচিত্রে আজও প্রান্তে, কিন্তু এখানকার প্রতিটি তরুণ যদি নিজের মাটিতে জীবিকা পায়, তবেই ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের মানে সম্পূর্ণ হবে। এই প্রবন্ধের প্রতিটি সংখ্যা, প্রতিটি কারণ একটাই কথা বলে—জঙ্গলমহলকে উন্নয়নের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে হলে শিক্ষা, দক্ষতা, সেচ, শিল্প ও ন্যায়সংগত প্রশাসনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলেই হয়তো একদিন আর কেউ বলবে না, জঙ্গলমহলের যুবকরা মাটি ছেড়ে যেতে বাধ্য।