11/08/2025
শহীদ ক্ষুদিরাম অমর রহে।.. "উকিল: তুমি কি কাউকে দেখতে চাও?
ক্ষুদিরাম: হ্যাঁ, আমি একবার মেদিনীপুর দেখতে চাই, আমার দিদি আর তাঁর ছেলেপুলেদের।
উকিল: তোমার মনে কি কোন কষ্ট আছে ?
ক্ষুদিরাম: না, একেবারেই না।
উকিল: আত্মীয় স্বজনকে কোন কথা জানাতে চাও কি? অথবা কেউ তোমায় সাহায্য করুন এমন ইচ্ছা হয় কি?
ক্ষুদিরাম: না, আমার কোন ইচ্ছাই তাঁদের জানাবার নেই। তাঁরা যদি ইচ্ছা করেন আসতে পারেন।
উকিল: জেলে তোমার সাথে কি রকম ব্যবহার করা হয়?
ক্ষুদিরাম: মোটামুটি ভালোই।
উকিল: তোমার কি ভয় করছে?
ক্ষুদিরাম: (স্মিতহাস্যে) ভয় করবে কেন?
উকিল: তুমি কি জানো আমরা রংপুর থেকে তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি? কিন্তু তুমি তো আমাদের আসার আগেই দোষ স্বীকার করেছো।
ক্ষুদিরাম: (স্মিতহাস্যে) কেন করবো না?" ...
ধরা পড়ার পর বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায় নিজের ওপর নিয়ে নেন ক্ষুদিরাম। অন্য কোন সহযোগীর নাম বা কোন গোপন তথ্য শত অত্যাচারেও প্রকাশ করেননি। মজফফরপুর আদালতে ক্ষুদিরামের বিচার কাজ শুরু হলো ০৮ জুন ১৯০৮। কিন্তু সারা পশ্চিম বাংলা থেকে কোন আইনজীবী মামলায় আসামী পক্ষের হয়ে কোন আইনজীবী আদালতে দাঁড়াতে সাহস পাননি। তখন পূর্ব বঙ্গ থেকে রংপুর বারের উকিল সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, কুলকমল সেন ও নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ক্ষুদিরামের পক্ষে মামলায় পরিচালনায় এগিয়ে আসেন। ইতোমধ্যে বিচারকের অনুরোধে কালিদাস বসু নামে স্থানীয় এক আইনজীবী এগিয়ে আসেন আসামী পক্ষে। ৬ দিন চললো বিচার অনুষ্ঠান। বিচারের শুরুতেই ক্ষুদিরাম স্বীকারোক্তি প্রদান করেন। কিন্তু বিচারক কর্নডফ এই স্বীকারোক্তিকে এড়িয়ে আদালতের প্রচলিত নিয়মেই বিচার করা হবে মর্মে ঘোষণা দিলেন। রংপুর থেকে যাওয়া তিন আইনজীবী সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, কুলকমল সেন ও নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী দুই দিন সরকারী সাক্ষীদের জেরা করলেন। কিন্তু ক্ষুদিরাম তখন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে নিজেকে দেশমাতৃকার হাতে সমর্পণ করেছিলেন।আইনজীবীদের তিনি সহযোগিতা করেননি। উকিলদের সাথে তাঁর উপরোক্ত সংলাপই প্রমাণ করে যে তিনি নিজের প্রাণ রক্ষায় ছিলেন খুবই নিঃস্পৃহ।
মামলার উকিলরা সওয়াল জবাবকালে যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই ঘটনার সময় ক্ষুদিরামের গায়ে একটা ভারী কুর্তা, কোর্ট, দুইটি পিস্তল এবং বেশ কিছু কার্তুজ ছিল তাই ঐ পরিমাণ ওজন নিয়ে তাঁর পক্ষে এতো ক্ষিপ্রতার সাথে বোমা ছুঁড়ে মারা সম্ভব নাও হতে পারে। তাছাড়া দীনেশ (প্রফুল্ল চাকীর ডাক নাম) ক্ষুদিরামের থেকে বলিষ্ঠ গড়নের এবং বোমা বানানো জানতো সে। তাই বোমাটি প্রফুল্ল চাকীর পক্ষেই ছোঁড়ার সম্ভাবনা বেশী। প্রফুল্লের আত্মহত্যাও এই দিকেই ইঙ্গিত করে। কেননা সে জানতো সে দোষী। আর দোষী বলেই ধরা পড়লে সাথে সাথে আত্মহত্যা করে সে। সুতরাং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করলে ক্ষুদিরামের পক্ষে সন্দেহের অবকাশ (Benefit of doubt) থেকেই যায়। কিন্তু সব কিছু বৃথা যায়। বৃথা যায় রংপুর থেকে মামলায় লড়তে যাওয়া আইনজীবীদের তৎপরতা। ঘটনার তিন মাস তের দিন পর ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করলেন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বিপ্লবী বীর ক্ষুদিরাম বসু।
ক্ষুদিরামের উকিল কালিদাসবাবুর ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্টের চাক্ষুস বর্ণনা ছিল নিম্নরূপ,
"১১ আগস্ট ফাঁসির দিন ধার্য হইল। আমরা দরখাস্ত দিলাম যে, ক্ষুদিরামের ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিব এবং তাঁহার মৃতদেহ হিন্দুমতে সৎকার করিব। উডম্যান সাহেব আদেশ দিলেন দুজন মাত্র বাঙালি ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিবে, তাঁর শববহন করিবার জন্য বারোজন এবং শবের অনুগমনের জন্য বারোজন থাকিবে। ইহারা কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়া শ্মশানে যাইবে।
ভোর ছয়টায় ফাঁসি হইবে। পাঁচটার সময় আমি খাটিয়াখানি ও সৎকারের বস্ত্রাদি লইয়া জেলের ফটকে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম নিকটবর্তী রাস্তা লোকারণ্য, ফুল লইয়া বহু লোক দাঁড়াইয়া আছে। সহজেই আমরা জেলের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ঢুকিতেই এক পুলিশকর্মী প্রশ্ন করিল - বেঙ্গলী কাগজের সংবাদদাতা কে? আমি উওর দিলে হাসিয়া বলিলেন যান ভিতরে। জেলের আঙিনায় প্রবেশ করে আমরা দেখিলাম, ডান দিকে একটু দূরে ১৫ ফুট উঁচুতে ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে দুটি খুঁটি আর একটা মোটা লোহার রড, তারই মধ্যস্থানে বাঁধা মোটা একগাছি দড়ি, শেষপ্রান্তে একটি ফাঁস। একটু অগ্রসর হতেই দেখিলাম চারজন পুলিশ ক্ষুদিরামকে নিয়ে আসছেন। ক্ষুদিরাম আগে আগে দ্রুত পদে আসিয়া যেন পুলিশগুলোকে টেনে আনছেন। আমাদের দেখিয়া ক্ষুদিরাম হাসিল। তারপর দৃঢ়ভাবে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হইল। মঞ্চে উপস্থিত হইলে তাহার হাত দুখানি পিছন দিকে আনিয়া দড়ি দিয়ে বাধা হইল। একটি সবুজ রঙের পাতলা টুপি দিয়ে তাহার গ্রীবামূল অবধি ঢাকিয়া গলায় ফাঁসি লাগাইয়া দেওয়া হইল। ক্ষুদিরাম সোজা হয়ে দাঁড়াইয়া রহিল। উডম্যান সাহেব ঘড়ি দেখে একটি রুমাল উড়াইয়া দিলেন। একজন প্রহরী মঞ্চের অন্য প্রান্তে একটি হ্যান্ডেল টানিয়া দিল। ক্ষুদিরাম নীচে অদৃশ্য হয়ে গেল। কেবল কয়েক সেকেন্ড ধরিয়া উপরের দড়িটি নড়িতে লাগিল। তারপর সব স্থির। আধঘন্টা পর দুজন বাঙালি ডাক্তার আসিয়া খাটিয়া ও নতুন বস্ত্র নিয়ে গেল। নিয়ম অনুসারে ফাঁসির পর গ্রীবার পশ্চাদদিক অস্ত্র করিয়া দেখা হয়, পড়বার পর মৃত্যু হইল কিনা। ডাক্তার সেই অস্ত্র করা স্থান সেলাই করিয়া, ঠেলিয়া বাহির হওয়া জিহ্বা ও চক্ষু যথাস্থানে বসিয়া, নূতন কাপড় পড়াইয়া জেলের বাহিরে আনিলেন।"
শ্রী ক্ষুদিরাম বসু ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলা শহরের কাছাকাছি কেশপুর থানার অন্তর্গত মোহবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ত্রৈলকানাথ বসু ছিলেন নাড়াজোল প্রদেশের শহরে আয় এজেন্ট। তার মা লক্ষীপ্রিয় দেবী। তিন কন্যার পর তিনি তার মায়ের চতুর্থ সন্তান। তার দুই পুত্র আগেই মৃত্যুবরণ করেন। অপর পূত্রের মৃত্যুর আশঙ্কায় তিনি তখনকার সমাজের নিয়ম অনুযায়ী তার পুত্রকে তার বড় বোনের কাছে তিন মুঠি খুদের (শস্যের খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত শিশুটির নাম পরবর্তীকালে ক্ষুদিরাম রাখা হয়। ক্ষুদিরাম বসু পরবর্তিতে তার বড় বোনের কাছেই বড় হন।
কিশোর ক্ষুদিরাম ১৯০৩ সালে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে পড়াশুনা বন্ধ করে দেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন ক্ষুদিরাম বসু। এ সময় ক্ষুদিরাম পরিচিত হন সত্যেন বসুর সাথে এবং তাঁর নেতৃত্বে গুপ্ত সংগঠনে যোগ দেন। এখানে তিনি শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখানে পিস্তল চালনার শিক্ষাও হয়। এই গুপ্ত সংগঠনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্ষুদিরাম ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় জ্বালিয়ে দেন এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত লবণবোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দেন। এসব কর্মকান্ডে তাঁর সততা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে ধীরে ধীরে গুপ্ত সংগঠনের ভেতরে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
১৯০৬ সালের দিকে দেশপ্রেমের একটা ছোট বই ছাপা হয়, এগুলো বিক্রির জন্য তরুণদের উপর দায়িত্ব পড়ে। ক্ষুদিরাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মেদিনীপুর মারাঠা কেল্লায় প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে ক্ষুদিরাম বই হাতে বলছিলেন -
“আসুন পড়ুন। দেশের দুর্দশার খবর জানুন। অত্যাচারী রাজশক্তির নির্মমতার নজির - এই বই আপনাদের জন্য।"
এমন সময় একজন হাবিলদার এসে ক্ষুদিরামের হাত চেপে ধরেন। শক্তি ও বয়সে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি হলেও ক্ষুদিরাম হাবিলদারের মুখে এক ঘুষি মেরে দিলেন সমস্ত শক্তি দিয়ে। তৎক্ষনাৎ হাবিলদারের নাক ফেঁটে রক্ত বেরুলো। সত্যেন বসু ঠিক ওই সময় এসে হাজির হলেন। দেখলেন বিষয়টি। ছল করে সান্ত্বনা দিলেন হাবিলদারকে। ক্ষুদিরাম মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া। কয়েকদিন আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে রইলেন। তাতে কি আর একজন দেশপ্রেমিক শান্তি পায়? দেশ জোড়া বিপ্লবের ঢেউ। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে জড়িয়ে আছে দেশমাতৃকার কাজে। পুলিশের হাতে ধরা পরার ভয়ে আর কত দিন পালিয়ে থাকা যায়? মনস্থির করলেন পুলিশের কাছে ধরা দেবেন। তাই আলীগঞ্জের তাঁতশালায় চলে এসে ধরা দিলেন। পুলিশ মারা ও নিষিদ্ধ বই বিলির অপরাধে ক্ষুদিরামের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা করা হল। বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষ এই প্রথম ক্ষুদিরামকে চিনলো। ১৩ এপ্রিল ক্ষুদিরাম মুক্তি পেলেন।
১৯০৭ সালের শেষের দিকে কালী পুজার সময় একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে তিনি ডাকহরকরাকে ছুরি মেরে গুপ্ত সমিতির জন্য টাকা সংগ্রহ করে আনেন।
১৯০৮ সালের ২৫ এপ্রিল ক্ষুদিরাম কলকাতায় এসে পৌছালেন। গোপীমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়ি ছিলো বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র। এখানে বসেই হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর শক্তিশালী 'book bomb' তৈরী করলেন। এ বোমা বইয়ের ভাঁজে রাখা যেত। বেশ কৌশলে একটি বই কিংসফোর্ডের কাছে পাঠানো হলো। কিন্তু কিংসফোর্ড বই না খোলার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলন।
১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে, প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম প্রথম মিলিত হলেন রেলস্টেশনে। এর আগে কেউ কাউকে চিনতেন না। কিংসফোর্টকে হত্যা করার জন্য ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প করলেন তাঁরা। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম কলকাতা রেলস্টেশনে পৌঁছোবার পর বারীণ ঘোষ তাঁদের কাছে কিংসফোর্ডকে মারার জন্য বোমা পৌঁছে দিলেন। বোমার সঙ্গে রিভলবার কেনার জন্য কিছু টাকা ও মজঃফরপুরে যাওয়ার মানচিত্র দেয়া হলো তাঁদেরকে। কারণ গোয়েন্দা সূত্রে কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা জানার পরে তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থে এখানেই বদলি করা হয় কিংসফোর্ডকে। প্রতিদিন ক্লাব হাউজ থেকে সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িতে করে নিয়মিত বাড়ি ফিরে আসে কিংসফোর্ড। পাঁচ দিন অতিবাহিত হল, কিন্তু তাঁকে হত্যা করার উপযুক্ত সুযোগ পেলেন না। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল, রাত ৮টায় এল সেই সুযোগ। ক্লাব হাউজ থেকে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত যে পথ, সেই পথের মাঝখানে ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা একটি জায়গায় ওঁত পেতে ছিলেন তাঁরা। সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িটি তাঁদের কাছে পৌঁছোন মাত্র গাড়িটি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করলেন। প্রচণ্ড শব্দে বোমাটি ফাটে গাড়ির উপর। ভারতের বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে ইংরেজ শক্তির উপর এটাই ছিল প্রথম বোমা হামলা। হামলার নায়ক ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল কাজ শেষ করে ছুটতে থাকেন। কিন্তু তখনও তাঁরা জানেন না যে ভুলবশতঃ বোমা গিয়ে যে গাড়িতে পড়েছে সেই ফিটন গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন দু'জন বিদেশিনী। নিহত হন মিসেস কেনেডি আর তাঁর কন্যা ও চাকর।
এরপরের ঘটনা উপরে বর্ণিত এবং আজ ইতিহাসের পাতায়।
ইতিহাসের মূল সূত্র নানা তথ্য, নথি। গবেষকদের কাছে যার মূল্য অসীম। অথচ বহুব্যবহৃত গ্রন্থাগার বা লেখ্যাগারের বাইরে পড়ে থাকা নানা তথ্য অনেক সময়ই নজর এড়িয়ে যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের এমনই বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি অবহেলায় পড়ে রয়েছে আলিপুর জজ কোর্ট-এর ‘স্মরণীয় বিচার সংগ্রহ’-এ। গবেষকদের চোখে পড়লে সে সব হয়তো নানা ঐতিহাসিক বিতর্কে আলোকপাত করতে পারত।
যেমন প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু-রহস্য। প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেছিলেন, না কি ব্রিটিশের হাতে খুন হয়েছিলেন, সে ধন্দ আজও কাটেনি। আলিপুর জজ কোর্টের সংগ্রহালয়ে পড়ে আছে মৃত্যুর পর প্রফুল্লর সামনের ও পাশের দিকের দুষ্প্রাপ্য ছবি। খাটিয়ার সঙ্গে দেহটি বেঁধে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে তোলা হয়েছিল সেই ছবি। তাতে গুলির ক্ষত পরিষ্কার। ভালই বোঝা যায় নাক ও বাঁদিকের কান দিয়ে রক্ত বেরোনোর দাগ বা ঠোঁটের ডান দিকের ক্ষতটি। রক্ত গড়িয়ে পড়ার কোনও চিহ্ন নেই, অতএব ধরে নেওয়া যায়, ছবি দুটো মৃত্যুর বেশ পরে রক্ত জমাট বাঁধার পর তোলা হয়েছিল। এই ছবি প্রফুল্লর মৃত্যু রহস্য উন্মোচনে গবেষকদের কতটা সহায়ক হতে পারে, তার সাম্প্রতিক নজির নির্মলকুমার নাগের প্রফুল্ল চাকী: নিহত নায়ক (বুনোহাঁস)।
সংগ্রহালয়ে তিনটি ঘরের আনাচেকানাচে এমন অনেক নিদর্শন। অনাদরে পড়ে আছে ক্ষুদিরাম বসু মামলার নানান নথি। মজফ্ফরপুরের ধর্মশালা থেকে প্রফুল্ল ‘দীনেশচন্দ্র রায়’ ছদ্মনামে বারীন ঘোষকে (‘সুকুদা’ সম্বোধনে) সাংকেতিক ভাষায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাতে কিংসফোর্ডের কথা বলতে গিয়ে লেখেন, ‘আজও বর দেখি নাই। তবে বাড়িটা একরকম দেখা হইয়াছে। বরের বাড়ি সব মন্দ নহে।’ ক্ষুদিরাম মামলায় সে চিঠি পেশ করা হয়েছিল। রয়েছে ক্ষুদিরামের ধরা পড়ার ছবি, ফাঁসির আগের ছবি, তাঁর ধরা পড়ার টেলিগ্রাম, প্রফুল্লর মৃতদেহের সদগতির জন্য তাঁর দেহ শনাক্তকরণের জন্য এসপি-র পাঠানো টেলিগ্রাম, জেলে বসে ক্ষুদিরামের নানা লেখা বা প্রফুল্ল চাকীর মৃতদেহ শনাক্ত করার বিষয়ে ক্ষুদিরামের বিবৃতি, ক্ষুদিরামের স্বাক্ষর ইত্যাদি। কিংসফোর্ড হত্যার জন্য অকুস্থলের যে মানচিত্রটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটিও পড়ে আছে এক কোণে। মামলায় এগুলিই ছিল সরকারপক্ষের হাতিয়ার। প্রফুল্ল চাকীর দেহতল্লাশিতে পাওয়া গিয়েছিল মোকামা-হাওড়া পর্যন্ত ট্রেনের টিকিট, সেটি দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। এই মামলায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় মজফ্ফরপুরের ধর্মশালার ম্যানেজার কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। তাঁর বিরুদ্ধে আনা মামলার কাগজপত্রও রয়েছে এখানে।
নথিগুলি এক বাতিল দেরাজে বন্দি হয়ে পড়েছিল বহু দিন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আলিপুরের অতিরিক্ত জেলা জজ পিয়ারিলাল দত্ত নতুন কিছু করার জন্য আইনজীবী কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ন্ত মুখোপাধ্যায় ও মৌ চট্টোপাধ্যায়কে উদ্যোগী হতে বলেন। তখন আলমারিটি নজরে আসে। ফৌজদারি আইনজীবীদের সাহায্যে ঝানু চোর দিয়ে সেই আলমারির তালা খোলা হয়। তাতেই মেলে গুরুত্বপূর্ণ সব মামলার নথি। সে সব নিয়েই তৈরি হয় ‘স্মরণীয় বিচার সংগ্রহ’ (উদ্বোধন: ১৫ অগস্ট ১৯৯৮)।
ধরা যাক রাইটার্স বিল্ডিংসে অলিন্দ যুদ্ধের মামলাটি। এখানে রয়েছে বিনয়-বাদল-দীনেশ ব্যবহৃত মানচিত্র, মৃত সিম্পসন ও বিপ্লবীদের ছবি, সুরতহাল রিপোর্ট-সহ নানা নথি। এ সব কাজে লাগিয়ে অলিন্দ যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হবে না? বিপ্লবীদের জন্মদিন মৃত্যুদিনে মাল্যদানেই আমাদের কাজ শেষ?
কলকাতা ও আশপাশের বহু বাড়ি বিপ্লবী কার্যকলাপের ঘাঁটি ছিল। এই নথি ঘেঁটে সেগুলির তালিকা তৈরি হয়। সে সব বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বর্তমান বাসিন্দারা সেই সব ইতিহাস কিছুই জানেন না। আছে ‘নবশক্তি’, ‘সন্ধ্যা’, ‘হিন্দুস্তান’, ‘যুগান্তর’, ‘বন্দেমাতরম’ প্রভৃতি পত্রিকার সংখ্যা, যেগুলি কোনও না কোনও মামলায় প্রদর্শিত হয়। এ সব পত্রিকা গ্রন্থাগারেও দুর্লভ। ‘লিবার্টি’ পত্রিকা প্রকাশের দায়ে প্রেসে খানাতল্লাশিতে বাজেয়াপ্ত মুদ্রণ প্লেট বা রাজাবাজার বোমার মামলায় ব্যবহৃত বোমার খোলটিরও দেখা মেলে এখানে।
আলিপুর বোমার মামলার নথি, অর্ডার শিট, সাক্ষ্য, অরবিন্দ ঘোষের লিখিত জবাব, অতিরিক্ত দায়রা বিচারক সি পি বিচক্রফ্ট-এর রায় এখানে ফাইলবন্দি। ঘরে ঢুকলেই হঠাৎ যেন পিছিয়ে যেতে হয় সেই মামলার শুনানির সময়ে। পিছনের সারিতে অরবিন্দ, তার আগে পর পর বসে আছেন নলিনীকান্ত গুপ্ত, সুধীরকুমার সরকার, শিশিরকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রমুখ। সে দিনের অনুসরণে বিভিন্ন সারিতে অভিযুক্ত বিপ্লবীদের ছবি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যে চেয়ারে বসে সওয়াল করতেন বা বিচারক বিচক্রফ্টের বসার জায়গা বা সেই সময়ে ব্যবহৃত আসবাব, সবই আজও অক্ষত।
১৯৪০-এর ২২ ফেব্রুয়ারি হরিশ পার্কে বক্তৃতা দিয়ে মামলার কবলে পড়েন সুভাষচন্দ্র বসু। মিউজিয়মে রয়েছে তাঁর সই করা ওকালতনামা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, অসুস্থতার রিপোর্ট, অন্তর্ধানের পর কোর্টে দাখিল করা তাঁর সম্পত্তির হিসেব। এক একটি আলমারি স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এদের আয়ু আর কত দিন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। জানা যায় যে, বেশ কয়েক বছর আগে মিউজিয়ম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় অনুদান এসেছিল। রাজ্য সরকারের ‘ম্যাচিং গ্র্যান্ট’ না পাওয়ায় সে অনুদান ফেরত চলে যায়।
স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে মুখরিত হয় শহর। কিন্তু এ শহরেরই এক প্রান্তে অবহেলায় পড়ে আছে স্বাধীনতা আন্দোলনের এমন সব গুরুত্বপূর্ণ নথি। ফি-বছর স্বাধীনতা দিবসে কিছু অনুষ্ঠান হয় সংগ্রহালয় চত্বরে। সে সময় কিছু মানুষ উঁকিঝুঁকি দেন আলমারি শোকেসের ধুলোমাখা কাঁচে। ব্যস, এইটুকুই। বিচারের বাণী সত্যিই এখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
(তথ্যসূত্র:
১- Sarfarosh: A naadi Exposition of the lives of Indian Revolutionaries by K.Guru Rajesh.
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬শে জানুয়ারি ২০১৫ সাল।