07/08/2025
স্বেচ্ছায় ছেড়েছিলেন অভিনয়, অধুনা ‘মিম’ হয়েই কদর পান দাপুটে কমল মিত্র
স্টার থিয়েটারে একটি নাটকের মহড়া চলছে। নাটকে ছোটো ছোটো রোল করতেন এরকম দু-তিনজন অভিনেত্রী একদিন খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে কমলবাবুর কাছে এসে বললেন, কমলদা, এক ভদ্রলোক গত ছ’মাস ধরে আমাদের খুব বিরক্ত করছেন। আপনি এর একটা বিহিত করুন।
কমলবাবু মেয়ে তিনটির দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে উঠে বলেন, ভদ্রলোকের সঙ্গে মাখামাখি শুরু করবার সময় খেয়াল ছিল না? এখন আমার আছে এসেছো কেন?
একটি মেয়ে উত্তর দেয়, আমরা মাখামাখি করিনি কমলদা। মাস ছয়েক আগে উনিই আমাদের কাছে এসে বললেন, উনি একটা থিয়েটার গ্রুপ করতে চান। ভালো ভালো অভিনেত্রী চান ইত্যাদি…তাই ওঁকে খাতির করতাম।
এরপর আরেকটি মেয়ে অভিযোগ করে বলে, কিন্তু গত ছ’মাস ধরে উনি কেবল আমাদের সঙ্গে কথাই বলে যাচ্ছেন। কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। তার ওপর আমাদের তিনজনকেই আলাদা করে বলেছেন তাকেই হিরোইন করবেন। তাতেই আমাদের মনে সন্দেহ হচ্ছে।
তৃতীয় মেয়েটি বলে, ভদ্রলোকের খারাপ মতলব। আমাকে ওঁর সঙ্গে দিঘা যেতে বলছেন। দু’রাত্রি সেখানে থাকবেন। আর এ কথাটা কাউকে বলতে বারণ করেছেন। ওঁর প্রস্তাবে রাজি হলে আমার নাকি হিরোইনের রোলটা পাকা হবে!
ব্যাপারটা কী, তা বুঝতে আর বাকি রইল না কমলবাবুর। মেয়েগুলিকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বলেন, ঠিক আছে। তোরা মেক-আপ রুমে যা। আজকে ভদ্রলোক দেখা করার জন্য স্লিপ পাঠালে স্লিপটা আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। তারপর যা করবার আমি করব।
যথা সময়ে ভিজিটিং রুম থেকে ভদ্রলোকের স্লিপ এল। কমলবাবুর হাতেও পৌঁছল। তিনি ভিজিটিং রুমে গিয়ে ভদ্রলোককে বললেন, আপনি থিয়েটার পার্টি করবেন?
লোকটি মেয়েদের সঙ্গে গল্প করবেন বলে বেশ গুছিয়ে বসেছিলেন, কমলবাবুর হঠাৎ আগমন ও এমন প্রশ্নবানে আমতা আমতা করে বলতে লাগবেন, হ্যাঁ মানে না—না মানে—
কমলবাবু ধমকে উঠলেন, আর মানে মানে করতে হবে না! আপনার মতলব বোঝা গেছে। যদি সত্যিই থিয়েটার করতে চান তাহলে কাল ওদের তিনজনের জন্যে পাঁচশো টাকা করে দেড় হাজার টাকা অ্যাডভান্স আমার কাছে দিয়ে যাবেন। আমি ওদের লোকাল গার্জেন। …দিঘা ঘুরে আসার মতলব ছিল নাকি? ওরে আমার ফোতো কাপ্তেন। থিয়েটারের মেয়েরা খুব সস্তা, তাই না? ফের যদি কোনওদিন এ তল্লাটে দেখি তাহলে মেরে খাল খিঁচে দেব। উল্লুক পাজি ছুঁচো রাস্কেল কোথাকার…দূর হ এখান থেকে।
কোনও সিনেমার স্ক্রিপ্ট নয়। বাস্তবেও ঠিক এতটাই দাপুটে, আদর্শবান মানুষ ছিলেন অভিনেতা কমল মিত্র (Kamal Mitra)। কোনও মতলববাজ মানুষকে দেখলে তাঁর চোখ দিয়ে আগুন আর মুখ দিয়ে অনর্গল গালাগাল ছুটত। গালাগালের চোটে নাকি ভূত ভাগিয়ে দিতে পারতেন। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেই চেপে হেসে বলতেন, ‘স্বাস্থ্যটা ভালো রাখার জন্য করি। তাছাড়া আমি তো বরাবরই একটু বীররসের অভিনয় করতে ভালোবাসি। তবে যাকে-তাকে খিস্তি করি না, যারা এর যোগ্য তাদেরই করি। ঠোঁটকাটা বলে বদনাম আছে আমার।’
‘বীররস’ প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ্য। অভিনয় শিক্ষার কোনও প্রথাগত পাঠ তাঁর ছিল না। তিনি নিজেই তাঁর স্মৃতিকথায় এমনই একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, “এক ছুটির দিন বৈঠকখানা ঘরে বসে ‘জনা’ নাটকের প্রবীরের অংশ ‘দাও মাগো সন্তানে বিদায়, চলে যাই লোকালয় ত্যাজি’ এই অংশটি বেশ জোরেই পড়ছিলাম। আমি যখন পড়ছিলাম, বর্ধমানের একমাত্র নাট্যশিক্ষক স্বর্গীয় প্রমোদীলাল ধৌন সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার নাটক পড়া শুনে আমাদের বৈঠকখানায় ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী পড়ছিস রে?’ আমার কাছে সব কথা শুনে বললেন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে, মায়ের সঙ্গে অভিমান করে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? মাকে মারতে যাচ্ছিস নাকি?’ কিন্তু তিনি অতকথা বল্লে কী হবে? আমার তো সে সময় বীররস ছাড়া অন্য কোনও রসে যে নাটক অভিনীত হতে পারে, সে ধারণাই ছিল না। এই প্রমোদবাবুই আমার সর্বপ্রথম নাট্যশিক্ষক।”
তাঁর পরিবারের কেউই কখনও অভিনয় শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবু বিগত শতকের বিশের দশক ধরে বহু চেষ্টায় কমল মিত্র চলচ্চিত্র ও রঙ্গালয়ের এক সাধারণ অভিনেতা থেকে অ-সাধারণ একজন চরিত্রাভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর স্থান হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্র, রঙ্গালয় ও যাত্রার প্রথম সারির অভিনেতাদের অন্যতম হিসেবে।
১৯১২ সালের ৯ ডিসেম্বর কমল মিত্রর জন্ম বর্ধমান শহরে। তাঁর পিতামহ ডাক্তার জগদ্বন্ধু মিত্র ছিলেন নামকরা চিকিৎসক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুরোধে যিনি হুগলি জেলার চাঁদরা গ্রাম থেকে বর্ধমানে এসে প্র্যাকটিস শুরু করেন। তাঁর খ্যাতি এতটাই ছড়িয়েছিল যে, পঞ্চম জর্জ ভারতে এসে তাঁকে ‘দরবারি মেডেল’ প্রদান করেছিলেন। সেই ‘চাঁদরার মিত্র’ বংশের কৃতি সন্তান কমল। তাঁর বাবা নরেশচন্দ্র মিত্র ছিলেন বর্ধমানের প্রখ্যাত আইনজীবী ও বর্ধমান মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। কমল মিত্রর পড়াশোনা বর্ধমান রাজ কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজে। ছাত্রাবস্থা থেকেই তখনকার বর্ধমান শহর ও তার আশপাশে ছোট-বড় নানা শৌখিন দলের নাটকে তিনি ছিলেন স্টার অভিনেতা। বিভিন্ন দল তাদের নাটকে অভিনয় করার জন্য তাঁকে সাদরে নিয়ে যেত।
কলেজ পাশ করার পরই চোখের অসুখে বাবা দৃষ্টিহীন হয়ে পড়লে কমল মিত্রকে চাকরির সন্ধানে বেরোতে হয়। বাড়ির কাউকে না জানিয়েই তিনি সামরিক বাহিনীতে নাম লেখান। যদিও বাবার তীব্র আপত্তিতে সে কাজ তাঁর আর করা হয়নি। কারণ, বড় ভাই মারা যান অল্প বয়সে। মিলিটারিতে যোগ দিলে ছোটো ছেলেও মারা যাবে, তাঁর মায়ের এমন একটা আশঙ্কা ছিল বলে, তাঁর বাবা বর্ধমান মহারাজাকে ধরে তাঁর নাম কাটিয়ে দেন। পরবর্তী কালে কমল মিত্র সরকারি কালেক্টরেটে চাকরি পান। দীর্ঘ এগারো বছর সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু তাঁর সেই চাকরি স্থায়ী ছিল না।
বর্ধমান, আসানসোল, রানিগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় নাটকে অভিনয় করে বেড়াতেন। এই সময়ে একদিন আসানসোলের ব্যারেট ক্লাব-এ ‘আলমগীর’ নাটকে জয়সিংহর ভুমিকায় তাঁকে অভিনয় করতে দেখে আসানসোলের এস ডি ও (আই সি এস) ম্যাক ইনার্নে সাহেব তাঁকে কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। কমল মিত্রকে তিনি বলেছিলেন, “কেন এখানে পড়ে আছ? তুমি নিজেই জানো না তোমার মধ্যে কী জিনিস লুকিয়ে!”
বিশের দশকে ছাত্র অবস্থাতেই কমল মিত্র কলকাতায় আসা-যাওয়া শুরু করে দেন। উদ্দেশ্য, সাধারণ রঙ্গালয় বা চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ খোঁজা। সেই সময় কলকাতায় এলে তিনি উঠতেন দর্জিপাড়ায় তাঁর দিদির বাড়িতে। পাশে কাশী বোস লেনে থাকতেন নামকরা অভিনেতা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। কমল মিত্রর ডাক্তার ভগ্নিপতির সঙ্গে দুর্গাদাসবাবুর বন্ধুত্ব ছিল। সেই সুবাদে কমল গিয়েছিলেন দুর্গাদাসের কাছে একটা সুযোগের আশায়। তখন ‘চিত্রা’ সিনেমায় (আজকের ‘মিত্রা’) দুর্গাদাসের ‘কপালকুণ্ডলা’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। কমলের অভিনয় করার ইচ্ছের কথা শুনে দুর্গাদাস বলেছিলেন, “এ জগতে কোনও ভদ্রসন্তানের আসা উচিত নয়। আমার এখন ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই, তাই পড়ে আছি, তবু মাঝে মাঝে মনে সন্দেহ হয় যে আমি নিজে ভদ্রসন্তান কিনা? বাড়ি গিয়ে লেখাপড়া করোগে, মন দিয়ে অন্য কাজ কর্ম করো। তাতে ইজ্জত পাবে কিন্তু এখানে পাবে না।’’
কমল মিত্র হাল ছাড়েননি। বর্ধমানে থাকতে চলে যেতেন দামোদর নদীর তীরে গলা ছাড়তে। চিৎকার করে সংলাপ বলা অভ্যেস করতেন মঞ্চে অভিনয়ের উপযুক্ত কণ্ঠস্বর তৈরি করতে। যত দিন না তাঁর গলা একই মাত্রায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসত দামোদরের নির্জন চরের ওপার থেকে, তত দিন এই অধ্যবসায় জারি ছিল।
বর্ধমান কালেক্টরেটের অফিসে কমলবাবুর সহকর্মী ছিলেন কবি কনক মুখোপাধ্যায়। তাঁর মাধ্যমে ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োর চিত্রপরিচালক গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কমল মিত্রর পরিচয় হয়। কিন্তু তাঁদের মুখ থেকে স্তোকবাক্য শোনা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বোমা পড়ার আতঙ্কে অনেকের মতো চিত্রপরিচালক দেবকীকুমার বসুও কলকাতা ছেড়ে কালনায় তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে চলে আসেন। বর্ধমান শহর থেকে কালনার দূরত্ব খুব বেশি নয়। খবর পেয়ে কমলবাবু হাজির হলেন। কমলকে তিনি হতাশ করেননি। পরামর্শ দিয়েছিলেন, কালেক্টরেটের চাকরিটা না ছেড়ে তাঁর ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে।
ভরসা দিয়েছিলেন আরও একজন। নাট্যচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী স্বয়ং। শিশির ভাদুড়ী নাট্টনিকেতন থিয়েটারের নাম বদলে শ্রীরঙ্গম দিয়ে (পরে বিশ্বরূপা) জীবনরঙ্গ নাটক মঞ্চস্থ করতে তখন উদ্যোগী। নতুন অভিনেতা চেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। সেই বিজ্ঞাপনের সূত্রেই কমল মিত্র নাট্যাচার্যের সামনে হাজির হলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘পণরক্ষা’ কবিতাটি আবৃত্তি করতে বলা হল তাঁকে। কমলের আবৃত্তি শুনে শিশিরবাবু বলেছিলেন, “কমল, ইউ পোজেস আ ভেরি রিচ ভয়েস।” অথচ, তার পরও কমল মিত্র-কে লিখতে হয়েছিল ‘এখানেও ইতি হয়ে গেল’।
পথের সন্ধান প্রথম এসেছিল চলচ্চিত্র জগৎ থেকে। গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নীলাঙ্গুরীয়’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। চরিত্রটি ছিল নায়কের বন্ধুর। একটি মাত্র সংলাপ। নায়কের টেব্লে গিয়ে বলতে হবে, ‘আপনি তো দেখছি মশাই একটি বর্ণচোরা আম!’ এটাই ছিল কমল মিত্রের জীবনে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলা প্রথম সংলাপ ও শট। অবশ্য তার জন্য কোনও পারিশ্রমিক তিনি পাননি। পারিশ্রমিক প্রথম পেয়েছিলেন দেবকী বসুর হিন্দি ‘রামানুজ’ ছবিতে একজন সৈন্যর ভুমিকায় অভিনয় করে। এখানেও হিন্দি সংলাপ ছিল একটি, ‘মুঝে মাফ কিজিয়ে মহারাজ। ম্যায় নেহি জানতা।’ সংলাপ বলতে-বলতে তাঁকে মহারাজরূপী ধীরাজ ভট্টাচার্যর হাতে চাবুক খেতে হয়েছিল। এই শট দিতে গিয়েই জীবনে প্রথম টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ার লাঞ্চ খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। পরে অবশ্য এই ধীরাজ ভট্টাচার্যর পিতার ভুমিকায় কমল মিত্র অভিনয় করেছিলেন ‘সতী’ ছবিতে। ‘নীলাঙ্গুরীয়’ তাঁর জীবনের প্রথম ছবি বলে ধরা হলেও, ১৯৪৩ সালে দেবকী বসুর ‘শ্রীরামানুজ’ ছবি দিয়েই তাঁর চলচ্চিত্র অভিনয়ের যাত্রা শুরু। ১৯৪৫ সালে দেবকী বসুর পরের হিন্দি ছবি ‘স্বর্গ সে সুন্দর মেরা দেশ’ ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। ওই বছরই নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত ‘বনফুল’। এটিও হিন্দি ছবি। দেবকীবাবুর ছবিতেই কমল মিত্রকে হিন্দি ভাষা শিখতে হয়। হিন্দি তাঁর একদমই জানা না থাকায় প্রথম দিকে মুশকিলে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি শিক্ষক রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে হিন্দি ও উর্দু ভাষা রপ্ত করেন। কারণ, তখন কলকাতা থেকেই হিন্দি ছবি তৈরির রেওয়াজ ছিল। আর সে সব ছবির দর্শক সারা ভারতব্যাপী।
১৯৪৫ সালের পর থেকে কমল মিত্র বাংলা চলচ্চিত্রের পরিচালকদের কাছে নতুন প্রতিভা হিসেবে গণ্য হতে থাকেন। দেখা যাচ্ছে দেবকী বসুর সঙ্গে-সঙ্গে নীরেন লাহিড়ী, অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় (‘সংগ্রাম’ ১৯৪৬), অপূর্বকুমার মিত্র (‘তুমি আর আমি’ ১৯৪৬) হেমেন গুপ্ত (‘অভিযাত্রী’ ১৯৪৭), অগ্রদূত (‘সমাপিকা’ ১৯৪৮) ও তাঁদেরই ছবি ‘সব্যসাচী’তে একেবারে নামভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। ১৯৪৪ সালে অভিনেতা বিপিন গুপ্তর সুপারিশে তিনি স্টার থিয়েটারে যোগ দেন। স্টারের নিয়ম মেনে সেই সময়ে অভিনেতাদের চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় বের করা শক্ত ছিল। স্টারে তখন মহেন্দ্র গুপ্ত রচিত ও পরিচালিত ‘টিপু সুলতান’ নাটক অভিনীত হচ্ছিল। সে নাটকে তিনি ব্রেথওয়েট চরিত্রে অভিনয় করতে সর্বপ্রথম কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয় মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন। ওই বছরেই বিপিন গুপ্ত হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করতে মুম্বই চলে গেলে কমল মিত্র সুযোগ পান নাটকের নামভূমিকায় অভিনয় করার। টানা ১১৯ রজনী তিনি ওই নাটকে টিপুর ভুমিকায় অভিনয় করেন। এই নাটকই তাঁকে সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনেতার সম্মান এনে দেয়। এর পরই তিনি কালেক্টরেটের সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা করে নেন। কাজটি করার আগে অবশ্য দেবকী বসুর অনুমতি নিয়েছিলেন।
চলচ্চিত্র ও থিয়েটারে অভিনয়ের কারণে কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পিতৃবন্ধু রায়বাহাদুর হৃষীকেশ বিশ্বাসের কলকাতার ১ নং শিবশঙ্কর লেনের বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন কমল মিত্র। খাওয়া বলতে কলকাতার পাইস হোটেলের কম পয়সার দু’বেলার খাবার। কখনও পয়সা না থাকলে একবেলা শুধুই চপ আর জল খেয়ে রাত কাটিয়ে দিতেন। ইকমিক কুকারে রান্না করে খেয়েও চালিয়েছিলেন দীর্ঘ তিন বছর। এই সংগ্রামী জীবনের দিনগুলো কমলবাবু চিরকাল মনে রেখেছিলেন।
১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কমল মিত্র একাধারে যেমন ‘নীলাঙ্গুরীয়’, ‘শ্রীরামানুজ’, ‘বনফুল’, ‘সংগ্রাম’, ‘তুমি আর আমি’, ‘পূর্বরঙ’, ‘অভিযাত্রী’ ইত্যাদি ছবিতে কাজ করেছেন, তেমনই ওই একই সময়ে ‘টিপু সুলতান’, ‘কেদার রায়’, ‘গৈরিক পতাকা’, ‘সীতারাম’ নাটকে অভিনয় করে একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই খ্যাতির কারণেই স্টার থিয়েটারের অভিনেতা হলেও সুকুমার দাশগুপ্ত তাঁকে ‘সাত নম্বর বাড়ি’-তে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। এই ছবিতেই কমল মিত্র প্রথম ও শেষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্লে-ব্যাকে দু’টি গানে লিপ দিয়েছিলেন।
কমল মিত্র অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে আছে ‘কংস’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘দেয়ানেয়া’, ‘আনন্দমঠ’, ‘জিঘাংসা’, ‘সব্যসাচী’, ‘লৌহকপাট’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘সবার উপরে’, ‘বন্ধু’, ভানু পেল লটারী’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘পিতাপুত্র’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘বর্ণালী’ ইত্যাদি। দেবকীকুমার বসু থেকে শুরু করে বাংলা সিনেমার আদি যুগের বহু খ্যাতিমান পরিচালকের ছবিতে যেমন কাজ করেছেন, তেমনই পরবর্তী কালে অজয় কর, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, রাজেন তরফদার এমনকী সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ ছবিতে ছোটো একটি পার্টির দৃশ্যেও তিনি ছিলেন স্ব-মহিমায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, সত্যজিৎ রায় ‘পরশপাথর’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিতে তাঁর প্রোডাকশন ম্যানেজারকে পাঠান কমল মিত্রের বাড়িতে। সব শুনে কমল মিত্রের স্পষ্ট জবাব, “মাথা খারাপ, আমি যাব সত্যজিৎবাবুর ছবিতে কাজ করতে! আমার ভাই খুব মুখ খারাপ। কখন কী বেরিয়ে যাবে!” কিন্তু সত্যাজিৎ হাল ছাড়েননি। কমল মিত্রকে তাঁর চাই-ই। বলেছিলেন, “শুটিংয়ের সময় না হয় একটু সামলে থাকবেন।”
নাট্যচার্য শিশিরকুমার তাঁকে বলেছিলেন, “কমল নোট মুখস্ত করে এম এ পাশ করা যায়, কিন্তু যে লাইনে তুমি ঢুকেছ, এখানে শেখার শেষ কোনও দিন হবে না, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে শিখতে হবে।” কথাটা কমল মিত্র আজীবন মনে রেখেছিলেন। দেশ বিদেশের নানা বই জোগাড় করে অভিনয়কলাকে তিনি আয়ত্ত করেছিলেন আশ্চর্য নিষ্ঠায়। চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা। শেষ বয়সে তাঁর সারা জীবনে সংগৃহীত বহু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিশাল ভাণ্ডার কলকাতার নন্দনের লাইব্রেরিতে দান করে দেন, কেবল চ্যাপলিনের আত্মজীবনীটি ছাড়া।
শেষ দিকে কমল মিত্র ক্রমশ একা হয়ে পড়েছিলেন। বলতেন, “প্রায় সব সহশিল্পী চলে গেল। এমনকী যারা বয়সে আমার ছোট তারাও রইল না। ছবি, পাহাড়ি, জহর (গাঙ্গুলি), অসিতবরণ, বিকাশের সঙ্গে অনেক বছর ধরে কাজ করেছি। সেটে আর তারা আসবে না, এই কথা যখন ভাবি তখন নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ লাগে। এমনকী উত্তম, ভানু, জহরও চলে গেল। একদিন স্টুডিয়োতে দেখি পরিচালক অজয় কর ঢুকছেন, তাঁকে দেখে একজন অপরজনকে জিজ্ঞেস করছে ‘লোকটা কে রে?’, সে কথা শুনে মনে হয়েছিল, আমারও স্টুডিয়ো পাড়া ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।”
কাউকে কিছু না জানিয়েই কমল মিত্র সরে দাঁড়িয়েছিলেন অভিনয় জগৎ থেকে। যেমন অনাহুতের মতো তাঁর আগমন ঘটেছিল বাংলার চলচ্চিত্র ও রঙ্গালয়ে, তেমনই অনাড়ম্বর ছিল তাঁর প্রস্থান। হয়তো এই প্রস্থানবেলায় তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল অভিনয় জীবনের শুরুতেই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সাবধানবাণী। বাংলা সিনেমার ‘রাগী পিতা’ বড় অভিমানে ক্যামেরার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের মৃত্যুর মুহূর্তকে কমল মিত্র আশ্চর্য ক্ষমতায় বুঝতে পেরেছিলেন। নিজের শ্রাদ্ধশান্তির যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের উপর কড়া নির্দেশ ছিল, কোনও ভাবেই যেন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া না হয়। তাঁর মৃত্যুশয্যার পাশে উপস্থিত স্ত্রী, মেয়ে, জামাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে, শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে উপস্থিত সকলের কাছে জীবনে স্বকৃত কোনও অজানা অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে, মৃত্যুর কোলে যেন সজ্ঞানেই ঢলে পড়েছিলেন। ঠিক যেমনটি বাংলা সিনেমায় হয়! ২ অগস্ট ১৯৯৩ সালে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর ৮ মাস।
‘ফ্ল্যাশব্যাক’
নাটক ও সিনেমা জগতে আজীবন যা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখেছিলেন সহস্তে লেখা আত্মজীবনী ‘ফ্ল্যাশব্যাক’-এ। প্রথমে বইটির নাম রেখেছিলেন ‘ফেলে আসা দিনগুলি মোর মনে পড়ে গো’ (যা আসলে “সাত নম্বর বাড়ি” ছবির একটি গান। যে গানে ‘লিপ’ দিয়েছিলেন কমল মিত্র, গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)। পরে যখন তিনি জানতে পারেন ওই নামে আর একটি বই রয়েছে, পাল্টে দেন নাম। “ফ্ল্যাশব্যাক” নামটির পরামর্শ পেয়েছিলেন পরিচালক শ্রীদেবনারায়ণ গুপ্ত’র থেকে। বইটি প্রকাশ করেছিল ‘মণ্ডল অ্যান্ড সনস্’ নামে একটি প্রকাশনী, যা পরবর্তীকালে বন্ধ হয়ে যায় এবং বইটিও বহুদিন ‘আউট অফ প্রিন্ট’।
যখন লকডাউন চলছিল, করোনা সংক্রমণ রুখতে সকলকে বাড়িতে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল, সেই সময় কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াই করে যাচ্ছিলেন পুলিশকর্মীরা। কখনও গান গেয়ে, কখনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আবার কখনও ‘মিম’ বানিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করেছিল কলকাতা পুলিশ। সেই সময় নিজেদের ফেসবুক পেজে লকডাউনে বাড়িতে থাকার আবেদন জানিয়ে মিম শেয়ার করা হয় তাদের ফেসবুক পেজে। ওই মিমটিতে উত্তম কুমার এবং কমল মিত্র অভিনীত ‘দেয়া-নেয়া’ ছবির দৃশ্য ব্যবহার করা হয়। তাতে ‘স্পিচ বাবল’ ব্যবহার করা হয়। যেখানে উত্তম কুমারের সংলাপ ছিল, “তা হলে আপনি বলতে চান যে, লকডাউনে জরুরি দরকার ছাড়া বাইরে বেরলে কলকাতা পুলিশ আমার বারোটা বাজিয়ে দেবে?” কমল মিত্রের ‘স্পিচ বাবল’-এ লেখা ছিল, “বলতে চান নয়, বলছি!
মুহূর্তে ভাইরাল হয় সেই মিম। যদিও এর আগেও ওই একই ছবির দৃশ্য নিয়ে বিভিন্ন সংলাপ ব্যবহার করে বানানো মিম সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে বহুবার। দেয়া নেয়া ছবিটি বা সেখানে কমল মিত্র'র উপস্থিতি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, দুইই তুলনাহীন এবং জনপ্রিয়। সেটা অন্য প্রসঙ্গ কিন্তু, কমলবাবু তো বাঙালির ম্যাটিনি আইডল ছিলেন, কীভাবে তিনি শুধু ‘মিম’ হয়ে উঠতে পারেন! আমাদের দুর্ভাগ্য, কমল মিত্রের মতো একজন উচ্চ প্রতিভার সঠিক কদর করতে পারিনি আমরা। আমরা মানে, নব্য বঙ্গ সমাজ।
[ FROM AN ARTICLE PUBLISHED IN BONGODORSHON]