11/10/2025
মাত্র ছ মাসেই যে ফল পেয়ে যাবে ভাবতে পারেনি জয়তী! প্রদীপ্ত কি নিজেও ভাবতে পেরেছিল বাষট্টি থেকে চুরানব্বই হবে! বেশ লম্বা বলে বাইরের লোকরা পার্থক্যটা অতটা ধরতে না পারলেও জয়তী জানে পুরনো প্যান্টগুলো আর কোমর অব্দি উঠতে চাইছে না। দুটো নতুন প্যান্ট কিনেছে। আকবর মিয়াকে দিয়ে পুরনো তিনটের কোমরের সেলাই খুলিয়েছে। ....এসবের জন্য কম কষ্ট করতে হয়নি জয়তীকে! রান্নার মাসিকে ছাড়িয়ে দিতে হয়েছে। রান্নার হাত খুবই খারাপ ছিল রান্নার মাসির। একগাদা তেল দিয়ে রান্না করত। তেলটা আবার গরম না ক'রে ওই কাঁচা তেলেই মশলা ঢেলে সবজি , মাছ বা মাংস রান্না করত। খাবার সময় প্রতিটি পদ থেকে কাঁচা তেলের গন্ধ বেরত। প্রদীপ্তর তাতে কিছু অসুবিধে না হলেও জয়তী খেতে পারত না।
রুকুর ভাত তরকারি এবং যেকোনো ঘরোয়া খাবারদাবারের প্রতি চরম অনীহা। কদিন পরপর জয়তী বা প্রদীপ্তর ফোন থেকে পিৎজা,বার্গার, রোল ইত্যাদি অর্ডার করে। বারণ করলে শোনে না। ক্লাস এইটের ছাত্র রুকু। ভীষণ জেদি, অবাধ্য এবং রাগী.... ঠিক ওর বাবার মতই! রান্নার মাসিকে ছাড়িয়ে দেওয়ার পর প্রথমদিকে জয়তী খুব অসুবিধার মধ্যে পড়েছিল। তিনবেলা রান্না করার অভ্যেস ওর কখনও ছিল না।নিজে চাকরি না করলেও বাড়ির নিচেরতলায় একটা বুটিক খুলেছে সে। প্রিয়দর্শিনী বুটিক। তাও অনেকদিন হল। চারশ থেকে চারহাজার পর্যন্ত দামের শাড়ি রাখে সে। ভালই চলে । মধ্যবিত্ত পাড়া। বেশিরভাগ মহিলা শাড়ি পরে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাস্টমারদের পছন্দ পাল্টে যাওয়ায় জয়তী এখন পলশাড়ির সঙ্গে সালোয়ার কামিজের পিস, কাফতান রাখে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বুটিক খুলে বসে। বন্ধ করে সন্ধের পরে। ততক্ষণে প্রদীপ্ত অফিস থেকে চলে আসে। রুকুও প্রাইভেট মাস্টারের কাছ থেকে পড়ে বাড়ি ফিরে আসে। দুলালদার মেয়ে মাম্পি বুটিকে জয়তীর সঙ্গে বসে। কাস্টমার এলে জয়তীকে সাহায্য করে। জয়তী মাস গেলে ওর হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়।
জয়তীর কাছে ইনস্টলমেন্টে শাড়ি কেনার সুযোগ আছে বলে পাড়ার বৌরা ঘনঘন আসে। পছন্দের শাড়ি নিয়ে যায় । আস্তে আস্তে টাকা শোধ করে। কেউ কেউ শাড়ি কেনার আগে বা পরে খানিক গল্পটল্প করে। বেশিরভাগটাই পরনিন্দা পরচর্চা। আগে রান্নার মাসির কাছে পাড়ার অনেকের হাঁড়ির খবর পেয়ে যেত জয়তী। এখন কাস্টমাররাই ভরসা।
জয়তীকে প্রায় সকলেই পছন্দ করে তার ব্যবহারের জন্য। খুব মিষ্টি ব্যবহার। বয়সে যারা ছোট ,তাদেরকে সোনা বা বাবু সম্বোধন করে জয়তী। জয়তী লক্ষ্য করে দেখেছে কোনো একটা বাক্যের আগে বাবু বা সোনা বসিয়ে দিলে খুব কাজ হয়। বয়স্ক মহিলাদের কক্ষনো মাসিমা বলে না । ঢোলা ম্যাক্সি এবং বুকের ওপরে গামছা ফেলে রাখা বৌদিকেও ম্যাম বলে জয়তী।
জয়তীর ব্যবহারের জন্যই প্রিয়দর্শিনী বুটিকে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত মেয়েদের ভিড় লেগে থাকে।
তবে যতোই মুখমিষ্টি করে কথা বলুক,জয়তী জানে আড়ালে অনেকেই তাকে মুটকি বলে। সেদিন বাসস্ট্যান্ড থেকে রতনের রিকশায় উঠেছে। হাতে সময় থাকলে বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটেই বাড়ি আসা যায়। সেদিন সময় ছিল না। তারওপর শাড়ি ভর্তি বড় ব্যাগ ছিল হাতে।
রতন রিকশা চালাতে চালাতে বলল "বৌদি আপনি থাইরয়েডটা একবার চেক করিয়ে নিন। আমার বউয়েরও থাইরয়েড আছে। ওরটা রোগা হয়ে যাওয়ার থাইরয়েড। আপনারটা মোটা। গেলবার যখন আপনাকে নিয়ে গেলুম,তখনকার থেকে আরও মোটা লাগছে আপনাকে।"
লক্ষ্মীভাণ্ডারে আলু একটা কিনতে গিয়েছিল একদিন। দোকানের বর্ষীয়ান মালিক মন্টুকাকু আচমকা বললেন... "আলু খাওয়া ছেড়ে দাও মা। ভাত এবং আলু একসঙ্গে খেলে শরীর কিন্তু ফুটবলের মত গোল হয়ে যাবে!"
সেদিন খড়গপুর থেকে দাদা এসেছিল। গাছের আম নিয়ে প্রতিবারই আসে। বাবা ,মা চলে যাওয়ার পরেও দাদার সঙ্গে সম্পর্ক একটুও নষ্ট হয়নি। সেও রুকুকে নিয়ে বছরে একবার খড়গপুর যায়।
খড়গপুর আগের মত ছিমছাম আর নেই। বাবার রেলের চাকরিসূত্রে তারা গোলবাজার রেল কোয়ার্টারে থাকত। কাছেই রেলের গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করেছে জয়তী। দাদা ছোট থেকেই বড় বড় স্বপ্ন দেখত। চাকরি করার ইচ্ছে দাদার কোনোকালেই ছিল না। বাবার কথাতেও দাদা রেলের চাকরির পরীক্ষায় একবারও বসেনি। অল্প বয়স থেকে ব্যবসার দিকে নজর ছিল। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন দাদা বৌদি রেলের কোয়ার্টারেই থাকত । পরে প্রেমবাজার এলাকায় অনেকটা জায়গা কিনে বিশাল একখানা বাড়ি করে দাদা। সেই বাড়ির বাগানের মিষ্টি আম দিতে আসে প্রতিবার।
এবার এসে জয়তীকে বলল " জয়ী ,একটু আধটু ব্যায়াম করতে তো পারিস! শরীরটা ফিট থাকবে।"
ছোট থেকেই দোহারা গড়ন জয়তীর। চল্লিশ পেরোনোর পরে চেহারাটা অনেকটা ঢিলে হয়ে গিয়েছে। উঠতে বসতে কষ্ট হয়। ভাত ,রুটি সে কম পরিমাণেই খায় ! কিন্তু ওজন কমার নামটি নেই।
কিছুদিন আগেই চেনা ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশন ফলো করে কয়েকটা ব্লাডটেস্ট করালো,কিছুই ধরা পড়েনি। কোনো রোগ ধরা পড়লে ভালো হতো। ওষুধ খেলে হয়ত বা কিছুটা সুরাহা হতো!
মাম্পি বলছিল পাড়ায় একটি নতুন ফ্যামিলি সাহাদের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে এসেছে। স্বামী,স্ত্রী আর একটা মেয়ে। বউটা মাম্পিকে বলেছে জয়তীকে নাকি প্রদীপ্তর ওয়াইফ মনেই হয় না! দিদি মনে হয়!
প্রদীপ্তও কায়দা করে দিনে অনেকবার মনে করিয়ে দেয় জয়তী ঠিক কতটা মোটা!
" সোফার যেখানটাতে বসো, দেখেছ জায়গাটা কতটা দেবে গিয়েছে ! কতবার বলেছি কাঠের টুলটায় বসবে! কথা তো শোনো না! "
ওপাশের বাড়ির মেজ বউটা ছাদে উঠলে প্রদীপ্ত জানলার কাছে চলে যাবেই! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবে নির্লজ্জের মত। জয়তীর দিকে তাকিয়ে বলবে "ফিগারখানা দ্যাখো! বাঙালি মেয়েদের এমন ফিগার দেখা যায় না। বয়স বোঝা যায় না একদম!"
ঝগড়াঝাঁটির সময়েও জয়তীর চেহারা নিয়ে খোঁটা দেয় প্রদীপ্ত। কান্না পায় জয়তীর। তাহলে চেহারাই সব! মনের কোনো দাম নেই! মানুষটার কোনো মূল্য নেই!
রান্নার মাসি আসার আগে ছেলের টিফিন, প্রদীপ্তর ভাত, ডাল , মাছভাজা করে দিতে হয় জয়তীকে। সকালের দিকে এত তাড়া থাকে যে ঠিকমত ব্রেকফাস্ট করা হয় না জয়তীর। চা আর দুটো বিস্কুট। কোনোদিন রাতের বেঁচে যাওয়া রুটি গরম ক'রে নিয়ে খায়। আরও দু বাড়ির কাজ সেরে বেলার দিকে রান্নার মাসি আসে। তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাকি কাজ সেরে চান,পুজো ইত্যাদি সব ক'রেট'রে যখন দুপুরের খাওয়া খেতে বসে তখন বেলা দুটো আড়াইটে বেজে যায়। খিদেও পায় খুব। অনেকটা ভাত খাওয়া হয়ে যায়। খড়গপুরে ছোট্টবেলার এক বন্ধুর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে জয়তীর। স্বাতী মল্লিক। ডায়েটিশিয়ান। একটা নামকরা নার্সিংহোমে যুক্ত। সে ফোনে জয়তীকে নানারকম পরামর্শ দেয়। বলে সকালের ব্রেকফাস্ট ঠিকমত না খেলে দুপুরে খাওয়াটা এমনিতেই খুব বেশি হয়ে যাবে এবং শরীরে তার প্রভাব পড়বে। স্বাতী আরও বলে চল্লিশে পা দিলেই মেয়েদের নিজেদের প্রতি বেশি করে যত্ন নেওয়া উচিত। কাজের চাপে জল খেতে ভুলে যায় মেয়েরা। ইউরিনারি ইনফেকশন হয় তাতে। ত্বকের উজ্জ্বলতা কমে যায়।
স্বাতীর পরামর্শে নিজের যত্ন নেওয়া শুরু করেছে জয়তী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত জল খায় এখন। মুখে বেসন,গোলাপজল লাগায়। কদিন আগে ডেন্টাল ক্লিনিকে গিয়ে দাঁতে স্কেলিং করিয়ে এসেছে। সকালে চা বিস্কুট খাওয়ার পরে রুকু স্কুলে আর প্রদীপ্ত অফিসে বেরিয়ে গেলে হেলদি ব্রেকফাস্ট করে। সকালে পেট ভ'রে জলখাবার খায় বলে দুপুরে রাক্ষসের মত খিদে পায় না। গাদাগাদা ভাত তরকারি খায় না আর।
বুটিকে বসার আগে চোখে কাজল দেয়। সুন্দর করে চুল বেঁধে খোঁপায় অথবা বিনুনিতে মরশুমি ফুল গোঁজে। যতক্ষণ বুটিকে থাকে হালকা মিউজিক চালিয়ে রাখে। এখন কাস্টমাররা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মাম্পি বলে " মুখে কী মাখছেন বৌদি? খুব গ্ল্যামার বেড়েছে। চোখ ফেরানো যায় না।"
হাসে জয়তী। সে জানে তার গ্ল্যামার নয়,আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। মনেমনে একশোবার ধন্যবাদ দেয় স্বাতীকে।
বিগত মাস ছয়েক থেকে প্রদীপ্তর খাওয়াদাওয়ার মেনুটা অন্যরকম করে সাজিয়েছে জয়তী। অফিস বেরোনোর আগে খুব সুন্দর করে সাজিয়েগুছিয়ে প্রদীপ্তকে খেতে দেয়। গরমভাতে দু চা চামচ খাঁটি গাওয়া ঘি ঢেলে দেয়। গরমভাতে ঘি পড়ার পর এমনই খোশবাই বেরোয় যে প্রদীপ্ত লোভে পড়ে এক্সট্রা আরও দু হাতা ভাত নিয়ে ফ্যালে। শিয়ালদহ থেকে বোম্বাই মরিচ এনে মুগডালের মধ্যে আস্ত লঙ্কা দিয়ে ডালটা ফুটিয়ে নেয় একটু। স্নান করতে করতে বোম্বাই মরিচের ঘ্রাণে প্রদীপ্তর ঘোর লাগে। অনেকটা ভাত খাওয়ার পরেও এক্সট্রা একবাটি ডাল সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে খায়।
আগে অফিস থেকে ফিরলে প্রদীপ্ত চিঁড়েভাজা বা মুড়ি বাদাম খেত। এখন দুপুরের আগেই প্রদীপ্তর জন্য টিফিন বানিয়ে রাখে জয়তী। কোনওদিন আলুর পরোটা, কোনওদিন ছোলার ডালের কচুরি, কোনওদিন চপ বা চাউমিন। একেকদিন মোমো তৈরি করে জয়তী। মোমোর পেটে কুচোচিংড়ি অথবা খাসীর চর্বি ঠুসে দেয়। প্রদীপ্ত আসার পর খাবারগুলো গরম ক'রে সার্ভ করে। জয়তী নিজে খায় একমুঠ মুড়ি অথবা ছোলা ভাজা। কোনওদিন অল্প রোস্টেড মাখানা। প্রদীপ্ত খেতে খেতে আরামে চোখ বন্ধ করে। চোখ না খুলেই বলে "তুমি যে এত ভালো রান্না করো, জানতামই না ! রান্নার মাসিকে ছাড়িয়ে দিয়ে ভালই করেছ।"
জয়তী কিছু বলে না। নিঃশব্দে হাসে।
রাতে গরমজলে ময়দা সেদ্ধ করে তুলতুলে নরম রুটি বানায় জয়তী। একেবারে ছটা সাতটা রুটি খেয়ে নেয় প্রদীপ্ত। শেষে গাজরের হালুয়া বা সাবুর পায়েস খেয়ে ঘুমোতে যায়।
এসব রান্নার ঝামেলায় জয়তীর কষ্ট বাড়লেও মনের ভেতরকার জ্বলুনি অনেকটাই কমেছে। চোখের সামনে ফলাফল দেখে একটা আলাদা
রকমের আনন্দ অনুভব করছে জয়তী। আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগে এখন। আয়নার জয়তীর সঙ্গে চোখে চোখ রাখতে এখন ওর আর অস্বস্তি হয় না।
এতদিন ধ'রে ফিগার মেইনটেন করে আসা প্রদীপ্ত এখন থপথপ করে হাঁটে। খায়। কাজে যায়।বাড়ি আসে। খায়। ঘুমোয়। যখন পাশের বাড়ির মেজবউটা শরীর বাঁকিয়েচুরিয়ে ছাদে একঘণ্টা ধরে কাপড় ম্যালে, তখন প্রদীপ্ত আগের দিনের বেঁচে যাওয়া পায়েস মুড়ি দিয়ে মেখে খায় অথবা আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সেদিন রবিবার। দুপুরে চরম খাওয়া খেয়ে প্রদীপ্ত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জয়তী বুটিকে বসে শাড়ির ওপরে দামের স্টিকার লাগাচ্ছিল। এসব কাজ মাম্পির সামনে করে না জয়তী। হঠাৎ সদর দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে জয়তী ভাবল এখন কি কারোর আসার কথা ছিল! নিচেরতলায় ছিল বলে জয়তী বুটিকের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সদর গেটের কাছে গিয়ে দেখল একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।
জয়তী অবাক হয়ে বলল কাউকে খুঁজছেন?
"প্রদীপদাকে একটু ডেকে দেবেন !"
এখানে প্রদীপ নামের তো কেউ থাকে না!
"এই ঠিকানাই তো বলল...."...জয়তীর হাতে একটুকরো কাগজ ধরিয়ে দিল লোকটি।
জয়তী প'ড়ে দেখল এই বাড়িরই ঠিকানা। কিন্তু নামটা তো মিলছে না! অবশ্য এই পাড়াতে প্রদীপ নামের তিনচারজন মানুষ বাস করে। তাদের মধ্যেই একজন হবে হয়তো!
জয়তীকে চুপ করে থাকতে দেখে লোকটি বলল
"যাঁকে খুঁজছি তিনি বিশাল মোটা।"
জয়তী বলল নামটা ভুল বললেও আপনি ঠিক বাড়িতেই এসেছেন। আপনি দাঁড়ান,আমি প্রদীপ্তকে ডেকে দিচ্ছি।
প্রতিশোধ
Sabina Yasmin Rinku
( একদা বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত)