05/11/2025
৪২ বছর পর কি ফের রাজ্য কাঁপাবে নেলি গণহত্যা!
বাৰ্তালিপি প্ৰতিবেদন, গুয়াহাটি, ৪ নভেম্বর : ২৫ নভেম্বর রাজ্য বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশন বসতে চলেছে৷ হিমন্তবিশ্ব শৰ্মার নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় এনডিএ সরকারের এটিই সম্ভবত শেষ পূৰ্ণকালীন অধিবেশন হতে চলেছে৷ আপাতদৃষ্টিতে এই অধিবেশন নিয়ে তেমন একটা কৌতূহল থাকার কথা ছিল না ৷ কিন্তু প্ৰায় চার দশক আগে এই রাজ্যে সংঘটিত সবচেয়ে অভিশপ্ত কালো অধ্যায় নতুন করে সবার সামনে খোলার যে ঘোষণা মুখ্যমন্ত্ৰী সম্প্ৰতি করেছেন, তাতে এই অধিবেশনের মেজাজই বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ নেলি-র সংখ্যালঘু মুসলিমদের গণহত্যার সেই তদন্ত রিপোৰ্ট বিধানসভায় পেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বৰ্তমান সরকার৷ এতে শুধু বিধানসভার নয়, ছাব্বিশের নিৰ্বাচনের আগে রাজ্যের পরিস্থিতিও নতুন মোড় নিতে পারে বলে অনুমান করছেন বিশ্লেষকরা ৷
হঠাৎ করে চার দশক আগের বীভৎস দাঙ্গার ওই কঙ্কালকে কবর খুঁড়ে বের করে নিয়ে আসতে চাইছেন কেন মুখ্যমন্ত্ৰী? তাঁর নিজের দাবি, ‘এই ভয়ঙ্কর ঘটনার তদন্তে যে তেওয়ারি কমিশন গঠিত হয়েছিল সেই কমিশনের রিপোৰ্ট এতদিন চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল ৷ গত চার দশকে কোনও সরকারই এই রিপোৰ্ট প্ৰকাশ্যে আনার সাহস দেখায়নি৷ আমার সরকার সেই সাহস দেখিয়ে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সেই তথ্য রাজ্যের মানুষের সামনে তুলে ধরবে৷’
পুরনো সেই অভিশপ্ত ঘটনার তথ্য এতটা
বছর পর রাজ্যের সামনে তুলে ধরলে এর আইনি লাভ কী হবে, এ ব্যাপারে কোনও ব্যাখ্যা মুখ্যমন্ত্ৰী দেননি৷ অন্যদিকে বিরোধী দল সহ রাজ্যের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ, জুবিন আবেগে নিৰ্বাচনের আগে প্ৰচণ্ড বেকায়দায় বৰ্তমান সরকার৷ তাই এখন চার দশক আগের ক্ষতকে খুঁচিয়ে তুলে ধৰ্মীয় মেরুকরণের শেষ মরিয়া চেষ্টা চালানো হচ্ছে৷ এই রিপোৰ্ট পেশ করে লাভের লাভ কিছুই হবে না৷ উল্টে অশান্তি আর হিংসাই ছড়াবে৷
মুখ্যমন্ত্ৰী দাবি করেছিলেন, তাঁর সরকারই প্ৰথম এই রিপোৰ্টটি বিধানসভায় পেশ করার সাহস দেখাবে৷ তিনি বলেছিলেন, রিপোৰ্টের কপিতে কোনও স্বাক্ষর ছিল না৷ ফলে তাঁরা এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন৷ পরে সেই সময়কার সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে রিপোৰ্টের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পৰ্কে নিশ্চিত হন৷ ফরেন্সিক পরীক্ষাতেও নিশ্চিত হয়, এটি সেই তদন্ত কমিশনেরই আসল রিপোৰ্ট । এরপরই এটি বিধানসভায় পেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার৷
সত্যিই কি প্ৰথমবার এই রিপোৰ্ট বিধানসভায় পেশ করা হচ্ছে?
সেসময়কার নগাঁও বৰ্তমান মরিগাঁও জেলার নেলিতে গণহত্যা হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্ৰুয়ারি৷ এর পাঁচ মাস পর জুলাই-র ১৪ তারিখ এই ঘটনার তদন্তে এক সদস্যের একটি কমিশন গঠন করে তৎকালীন হিতেশ্বর শইকিয়ার নেতৃত্বাধীন কংগ্ৰেস সরকার৷ অবসরপ্ৰাপ্ত প্ৰবীণ আইএএস আধিকারিক ত্ৰিভুবন প্ৰসাদ তেওয়ারিকে কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ৷ সময়মতো তদন্ত রিপোৰ্ট সরকারের কাছে জমাও দিয়ে দেন ওই আমলা৷
১৯৮৪ সালের মে মাসে বিধানসভা অধিবেশনে রিপোৰ্টটি পেশ করার কথা ছিল৷ কিন্তু এই স্পৰ্শকাতর রিপোৰ্ট পেশ করা হলে রাজ্যে নতুন করে সাম্প্ৰদায়িক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে সেই আশঙ্কায় রিপোৰ্ট প্ৰকাশ্যে আনা থেকে বিরত থাকে হিতেশ্বর শইকিয়া সরকার ৷ পরবৰ্তীতে অসম চুক্তি হল৷ রাজ্যে হিতেশ্বর শইকিয়া সরকারকে ভেঙে দিয়ে নতুন করে নিৰ্বাচন করালো কেন্দ্ৰ ৷ ক্ষমতায় এল আসুর নেতৃত্বাধীন বিদেশি খেদা আান্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া আঞ্চলিক দল অসম গণ পরিষদ বা অগপ ৷ মুখ্যমন্ত্ৰী হলেন প্ৰফুল্লকুমার মহন্ত ৷ রাজ্য বিধানসভার নথি বলছে, ১৯৮৭ সালের ৩১ মাৰ্চ প্ৰফুল্ল মহন্ত সরকার বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে এই তেওয়ারি কমিশনের রিপোৰ্ট পেশ করে৷ সেদিন বিধানসভার কাৰ্যসূচির ক্রমিক সংখ্যা চারে ছিল এই রিপোৰ্ট পেশের বিষয়৷
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্ৰী মহন্ত বিধানসভায় এই রিপোৰ্ট পেশ করার পর নিৰ্দল বিধায়ক বিনয় খুংগুর বসুমাতারি রিপোৰ্টের কপি সব সদস্যের কাছে বিলি করার দাবি জানান৷ কিন্তু মহন্তের সাফাই ছিল, রিপোৰ্টের কপির মুদ্ৰণ চলছে ছাপাখানায়৷ সেই কাজ সম্পূৰ্ণ হলেই সব বিধায়ককে তেওয়ারি কমিশনের রিপোৰ্টের কপি সমঝে দেওয়া হবে৷ কিন্তু পরবৰ্তী বিয়ল্লিশ বছরেও সেই কপি আর কোনও বিধায়কই পাননি৷
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একবার কোনও কমিশনের রিপোৰ্ট সদনে পেশ করা হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার তা পেশ করার কোনও সুযোগ নেই ৷ এমন কোনও উদাহরণও দেশের সংসদ বা কোনও বিধানসভায় নেই ৷ যদিও বৰ্তমান সরকার দাবি করছে, ওই রিপোৰ্ট অতীতে কখনও পেশই করা হয়নি৷
কীভাবে ঘটেছিল নেলির সেই গণহত্যা?
তখন রাজ্যে বিদেশি খেদা আন্দোলন তুঙ্গে ৷ বিশেষ করে বঙ্গ মূলের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে টাৰ্গেট করেই রাজ্য জুড়ে আসুর নেতৃত্বে চলছিল আন্দোলন৷ এরইমধ্যে রাজ্যে বিধানসভা নিৰ্বাচনের প্ৰস্তুতি শুরু হয়ে যায়৷ আসুর নেতৃত্ব এই নিৰ্বাচন বয়কটের ডাক দেয়৷ কিন্তু স্থানীয় কংগ্ৰেস নেতারা তখন সেইসব সংখ্যালঘু মানুষকে বোঝান, যদি তাঁরা ভোট না দেন তবে এ রাজ্যে তাঁদের আর ভোটাধিকার থাকবে না৷ তালিকা থেকে নাম বাদ পড়বে৷
সেই আতঙ্কেই তৎকালীন নগাঁও জেলার ওই সংখ্যালঘু মানুষ বিধানসভা ভোটে শামিল হয়ে ভোট দিয়েছিলেন৷ ভোট বয়কটের ডাক উপেক্ষা করার পরিণতি যে এতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি৷
১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্ৰুয়ারি৷ বিধানসভা নিৰ্বাচনের ঠিক চারদিন পর সেইদিন সকাল থেকে নেলির প্ৰায় চোদ্দোটি গ্ৰাম ঘিরে শুরু হয় হামলা৷ অভিযোগ, নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদী শিবিরের নেতারাই৷ এদের পেছন থেকে মদত দিয়েছিল আরও বেশকিছু শক্তি ৷ টানা ছ’ঘণ্টা ধরে এই গ্ৰামগুলি ঘিরে অস্ত্ৰশস্ত্ৰ নিয়ে নৃশংস গণহত্যা চালায় উগ্ৰ জাতীয়তাবাদীরা ৷ নারী, বৃদ্ধ, শিশু, অন্তঃস্বত্তা...কেউই উগ্ৰ জাতীয়তাবাদের নৃশংস থাবা থেকে রেহাই পাননি৷ সরকারি হিসেবে ওই ছ’ঘন্টার তাণ্ডবে সেদিন প্ৰাণ হারিয়েছিলেন মোট তিন হাজার মানুষ ৷ যদিও পরবৰ্তীতে বিভিন্ন বেসরকারি ও স্বাধীন সংগঠনের তদন্তে দাবি করা হয়, মৃতের সংখ্যা ছিল দশ হাজারের বেশি৷
কী পেয়েছিলেন নেলির হতভাগ্যরা?
এই গণহত্যার পর প্ৰায় সাতশোটি মামলা হয়েছিল৷ ২৯৯-টি মামলার চাৰ্জশিটও দাখিল করে পুলিশ৷ কিন্তু পরবৰ্তীতে প্ৰফুল্ল মহন্তের অগপ সরকার নেলি গণহত্যা সম্পৰ্কিত সব মামলাই প্ৰত্যাহার করে নেয় ৷ এতজন লোক প্ৰাণ হারালেন, কিন্তু একজনেরও শাস্তি হল না ৷ উল্টে উগ্ৰ জাতীয়তাবাদের সুনামিতে তাঁরা রাজ্যের মন্ত্ৰী হলেন, শাসনভার পেলেন৷ আর নেলিতে যাঁরা হামলায় প্ৰাণ হারিয়েছিলেন, তাঁদের পরিবার পিছু নগদ পাঁচ হাজার টাকা আর ঘর বানানোর জন্য কয়েকটি সিআই শিট দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছিল তৎকালীন সরকার ৷ পরবৰ্তী সময়ে এই অগপই রাজ্যের সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক আশ্ৰয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ আজকের দিনেও রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় যথেষ্ট ভিত রয়েছে অগপর ।
তেওয়ারি কমিশন তদন্তে কী পেয়েছিল?
নেলি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ করে মোট ছ’শ পাতার একটি বিশাল রিপোৰ্ট দাখিল করেছিল তেওয়ারি কমিশন৷ এই রিপোৰ্টের সরকারি শীৰ্ষক ছিল ‘রিপোৰ্ট অব দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন আসাম ডিস্টাৰ্বেন্সেস, ১৯৮৩)’৷ ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে হিতেশ্বর শইকিয়া সরকারকে রিপোৰ্ট দাখিল করা হয়েছিল৷
রিপোৰ্টে ওই বছরের জানুয়ারি থেকে মাৰ্চ পৰ্যন্ত সংখ্যালঘুদের উপর প্ৰায় ৫৪৫-টি হামলা এবং একশোটির বেশি অপহরণের ঘটনাকে নথিভুক্ত করা হয়েছিল৷ বলা হয়, নিৰ্বাচনের মুখে থাকা রাজ্যে এমন হিংসাই মূলত নেলির ঘটনার ভিত গড়ে দিয়েছিল ৷
সেই অভিশপ্ত দিনটিতে এমন নারকীয় ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পেছনে কয়েকজন পুলিশ আধিকারিককে মূলত দায়ী করা হয় ৷ ওই এলাকায় এমন একটা হিংসা হতে যাচ্ছে, গুয়াহাটি থেকে ওয়ারল্যাসে নিৰ্দিষ্ট সতৰ্কবাৰ্তা যাওয়ার পরও নগাঁও সদর থানার তৎকালীন ওসি বিষয়টিকে পাত্তা দেননি৷ উল্টে তিনি ওই বাৰ্তা নষ্ট করে দেন বলে কমিশনের রিপোৰ্টে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ এছাড়া, সতৰ্কবার্তাকে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য মরিগাঁও-র তৎকালীন এসডিপিও প্ৰমোদ চেতিয়া এবং জাগিরোড থানার তৎকালীন ওসি ভদ্ৰকান্ত চেতিয়াকেও দায়ী করে কমিশন৷ তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ সুপার পৰ্যায়ের অফিসাররা যথেষ্ট প্ৰশংসার কাজ করেছিলেন বলেও রিপোৰ্টে উল্লেখ করা হয়৷
হিংসায় উসকানি দেওয়ার জন্য কমিশনের রিপোৰ্টে সরাসরি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে দায়ী করা হয়৷
সেই রিপোৰ্টের কঙ্কালই কবর থেকে বের করে নতুনভাবে বিধানসভায় পেশ করতে যাচ্ছে হিমন্তবিশ্ব সরকার৷ সেসময়কার মতোই গত কয়েকমাস ধরে এই রাজ্যে ‘মিঞা’ বিরোধী একটা অভিযান চলছে৷ গত কয়েকদিন ধরে প্ৰকাশ্যে মুখ্যমন্ত্ৰী বলছেন, তিনি যতদিন ক্ষমতায় আছেন মিঞাদের শান্তিতে থাকতে দেবেন না৷ ফলে এই রিপোৰ্ট প্ৰকাশের পর আগামী রাজনীতি বা বিধানসভা ভোটে কোনও প্ৰভাব পড়ে কি না অথবা ব্যুমেরাং হয় তা সময়ই বলবে৷ ( বার্তালিপি, ৫ নভেম্বর, ২০২৫)