02/08/2025
শ্রাবণের শুরু। উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতা প্রবল বর্ষণে জলমগ্ন। এক একজন রাস্তা পেরোচ্ছেন জল-কাদা ডিঙিয়ে অতি সন্তর্পণে। কার কারও মনে পড়ছে ছোট বেলার কাগজের নৌকা ভাসানোর দিন। কেউ কেউ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চলছেন, কাঁধে অতি গুরুগম্ভীর কাজের গুরুভার। এক হাঁটু জল পেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন ড. লোপামুদ্রা সেনগুপ্ত। অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষের দিকে এগোচ্ছেন তিনি। কিন্তু গাড়িতে বসতেই যেন ধাক্কা এল ভিতর থেকে। কাজ! সারাজীবন, নানা খাতে, নানা সময়ে এই কাজই করে গিয়েছেন । অক্লান্তভাবে। তবে প্রবল ক্লান্তিতেও তিনি কখনওই নিজের স্বপ্নকে, শখ-আহ্লাদকে কেবল মনের গহীনে ফল্গু ধারার মতো ছেড়ে দেননি। জেদের সঙ্গে, জোরের সঙ্গে, বিপুল উদ্যমের সঙ্গে অঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে রেখেছেন। স্বাভাবিকভাবেই, বর্ষার দিনে কাজ যতই থাকুক, যতটুকু সময় পেয়েছেন, কাজের সঙ্গেই এখন গান শুনবেন, চোখ বুজে। নিজের গান। পছন্দের। আরামের। গান শুনতে গুনতেই একটা সময় কি গাড়ি ঘুরিয়ে দিতে বলবেন? বলবেন, ‘ঠিকানা বদলে নাও আজ। চলো সালংকারায়’?
বলতেই পারেন। এতগুলো বছর। একদিকে ঘর-সংসার, পড়াশোনা, অধ্যাপনা, বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব সব সামলে তো এভাবেই দিনের পর দিন গিয়ে দাঁড়িয়েছেন সালংকারার কাছে। সবদিন হয়তো বর্ষা হয় না আকাশ ভেঙে, কিন্তু সালংকারায় পৌঁছতে বেশিরভাগ দিনেই লোপামুদ্রাকে ডিঙিয়ে যেতে হয় কাজের পাহাড়। পঞ্চান্নর গণ্ডি পেরিয়ে, অনায়াসে সেই পাহাড় ডিঙিয়ে যান তিনি। কীভাবে পান এই জীবনশক্তি? প্রশ্ন করলেই ব্যাস! গম্ভীর মুখে বড় দের ক্লাস নেওয়া দিদিমণির তখন আর চোয়াল শক্ত থাকে না। মুখে-চোখে নিমেষে ফুটে ওঠে কিশোরী বেলার সরলতা। এক নাগাড়ে বলে যান, ছোট বেলা, বড় বেলা, কৈশোর, যৌবনের গল্প। বলেন সব সামলে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার মূল মন্ত্রের কথা, আর বলেন, কতটা জরুরি সালংকারার মতো প্রতিষ্ঠান কিংবা অঙ্কিতার মতো দিদিমণি।
আগেই বলেছি দক্ষিণ কলকাতার লোপামুদ্রা, পেশায় অধ্যাপক। বছর দুই হল, সালংকারার সঙ্গে যুক্ত তিনি। নাচের কথা শুরু হলেই, পঞ্চান্ন থেকে তিনি এক লহমায় এগিয়ে যান বাহান্ন বছর আগে। যখন তার বয়স সবে তিন। সেই খুদের রবীন্দ্রসদনে নৃত্যানুষ্ঠানের দিন, পরে কিচুটা বড় হয়ে ভারতনাট্যম, কথকের তালিম নেওয়ার দিন, ভারতীয় লোক নৃত্য নিয়ে দীর্ঘ কাজ, নিজের নাচ শেখানো সেসব ছবির মতো ফুটে ওঠে। একটা সময় পর্যন্ত সবকিছু সামলে নাচের ধারা বজায় রেখেছিলেন তিনি। তবে নেশা আর পেশার ঠকাঠুকিতে, মাঝে কিছু বছিরের বিচ্ছেদও সইতে হয়েছে তাঁকে। অধ্যাপনা, গবেষণা, সংসারের দায়দায়িত্ব, ছেলেকে বড় করা সব মিলিয়ে মাঝের কয়েকবছর ঘুঙুর কেবল আলমারির এক কোণে তোলা ছিল। যেমন তোলা থাকে প্রিয় কোনও শাড়ি, আর কখনও পরা হবে না ভেবে।
তবে ওই যে, যেমন সব পাখি ঘরে ফেরে, তেমনই কারও কারও জেদের কাছে, অপেক্ষার কাছে হার মেনে ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া সবকিছু। আর যদি তিনি হন লোপামুদ্রার মতো ‘নাছোড়বান্দা মেয়ে’? তাহলে? দীর্ঘ বিরতি আর সালংকারার অধ্যায়, এর মাঝেও তিনি ভালবাসার নাচের কাছে ফিরে যেতে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তও হন। তবে কোথাও গিয়ে তিনি সেই শিকড়ের খোঁজ পাননি, যা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন হন্যে হয়ে। ফলে কোনও যাত্রাই দীর্ঘমেয়াদী হয়নি। তারপরেই একদিন মুখোমুখি হন সালংকারার সঙ্গে।
সেই শুরু। এক বছর পেরিয়ে দু’ বছর। কেন সালংকারাই? কেন বহু পথ পেরিয়ে এখানেই থামলেন তিনি? উত্তরে খুব ঝটপট করেই বলেন, ‘সালংকারা তো অঙ্কিতা ম্যাডামকে ঘিরেই। তাঁর যে নাচের ক্রিয়েটিভিটি, কোরিওগ্রাফি এবং সবথেকে বড় কথা, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে, একযোগে চলার যে চেষ্টা, পরিবারের মতো উদযাপনের যে আন্তরিক প্রচেষ্টা, সহনশীলতার সনে সকলকে গ্রহণ করা, সেটা শেখার মতো। সবাইকে শুধু নিয়ে চলা তো নয়, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সকলের থেকে ভালটা খুঁজে বের করে আনা। এই সময়ে এর থেকে বড় আর কী। আমি তো চাই, যতদিন পারি যেন অঙ্কিতার কাছে যেতে পারি। নাচ শিখতে পারি। যেন কোনও না কোনওভাবেই আমি যেন থেকে যেতে পারি সালংকারার সঙ্গে। নাচের কথা বলি যদি, আমি তো অঙ্কিতার কাছে রবীন্দ্রনৃত্য শিখি, আমি অবাক হই। এমন অনবদ্য ভঙ্গিমা, অভিব্যক্তি এত অসাধারণ কোরিওগ্রাফি, আমি শেখার আগে মুগ্ধ হয়ে দেখি।‘
একদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা, লিঙ্গ বৈষম্য-মানবাধিকার নিয়ে চর্চা আর একদিকে রবীন্দ্র নৃত্যে আকুল পরিবেশনা, একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই বিষয়কে কীভাবে একসঙ্গে জুড়ে রাখেন লোপামুদ্রা? উত্তর দিতে গিয়ে ভাবাতুর হন। বলেন- ‘রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা-উপন্যাস, দেখবেন একদিকে রয়েছে গভীর দর্শন, আর একদিকে মানব মনের নানা দিক। কখনও হাহাকার-কখন বেদন, রোদন আবার কখনও ওপার আনন্দ, প্রেম ভালবাসা ছড়িয়ে। এসব আমাদের সুক্ষ্ম অনুভূতিকে নাড়া দেয় বারেবারে। আমাকে তো দেয়ই। আমি নান ধরনের কাজ যখন করি বাইরে, আর যখন রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা নিয়ে ভাবি, এত প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাই। মনে হয়, আমার দু’ দিক দুই বিপরীতের হলেও, কোনও এক কারণে, দুটো দিক মিলে যায় গভীরভাবে। আমি যখন রবীন্দ্রনাথের গানে চান করি, আমি জানি তাতে আমার গোটা জীবনের অভিজ্ঞতাও যেন ফুটে উঠছে।‘
সপ্তাহভর দাঁড়ান টেবিলের একদিকে,দিদিমণি হয়ে। একদিন দাঁড়ান অন্য প্রান্তে, একান্ত বাধ্য ছাত্রী হয়ে। মনে করেন, গুরুর প্রতি সম্মান থেকেই আসলে শেখার শুরু। মনে করেন জীবনের একেবারে প্রথমভাগ থেকে পারফর্মিং আর্টস-এর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পেরেছেন এবং এখনও সেই চর্চা চালিয়ে যেতে পারছেন বলেই হয়তো বাকি নানা খাতের নানা জটিল সমস্যার সমাধান করেছেন সহজে।
কথা যখন শেষের মুখে, এক পৃথিবী কাজের মাঝে তখন যেন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লোপামুদ্রার কৈশোর, যৌবন আর বার্ধক্যে উপনীত হওয়া মন। যেমন অঙ্কিতা এক লাইনে দাঁড় করান নানা বয়সের নানা মানুষকে, যাঁরা ডুবে থাকেন নাচের প্রতি, শিল্পের প্রতি আকন্ঠ ভালবাসায়। শহরে তখন ঝড়। শ্রাবণের অযাচিত ঝড়। লোপামুদ্রা ভাবছেন, এবার তিনি একদিন নাচবেনই, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি…।‘ সামনে কে? মঞ্চে পাশে কে? ব্যাকগ্রাউন্ডে কী? কিছু যায় আসে না। শুধু একটু আলো চান। যে আলোয় ফুটে উঠবে নারীর চেষ্টা, ইচ্ছা, জেদ, ধৈর্যের প্রতিচ্ছবি। কখনও সেই প্রতিচ্ছবি দেখতে হবে অঙ্কিতার মতো, কখনও লোপামুদ্রার মতো, কখনও বা আরও কারও মতো। যাঁরা জিতে যাচ্ছেন এক একটা লড়াই, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে।
কলমেঃ সালংকারা এডিটোরিয়াল টিম
#আমাদের_কথা