11/08/2025
বীর সন্তান অগ্নি পুরুষ খুদিরাম বসু:
উনিশ শতকের শুরু। বাংলার আকাশে তখনও ব্রিটিশদের কালো ছায়া। এই ছায়ার ভেতরে উঁকি দিয়ে ওঠে এক শত্রু—ডগলাস কিংসফোর্ড। প্রথমে তিনি রংপুরে জেলা বিচারপতি। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি একের পর এক দমননীতি চালু করেন।
জাতীয়তাবাদী সভা ভেঙে দেওয়া, হিন্দু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করা, আর সবচেয়ে অপমানজনক—“বন্দে মাতরম” ধ্বনি নিষিদ্ধ করা। এই মন্ত্র শুধু রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না—এটি ছিল হিন্দু মাতৃভূমির কাছে প্রণাম, স্বাধীনতার আহ্বান, আর দেবীর প্রতি ভক্তির ধ্বনি। এই ধ্বনি উচ্চারণকারীদের তিনি কারাগারে পাঠাতেন।
রংপুরে তাঁর নিষ্ঠুরতা এত বেড়ে যায় যে সাধারণ মানুষ ও বিপ্লবীদের রক্ত ফুটে ওঠে। বিপদ বুঝে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে তড়িঘড়ি করে মুজাফ্ফরপুরে বদলি করে দেয়। কিন্তু শত্রু যেখানে যায়, সেখানে প্রতিশোধের অঙ্গারও পৌঁছে যায়।
---
বিপ্লবীদের প্রতিজ্ঞা
যুগান্তর দলের নেতারা স্থির করলেন—এই শত্রুকে ধ্বংস করতেই হবে। প্রথমে অন্য কয়েকজন বিপ্লবীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু বিপ্লবীদের নেতা বারিন ঘোষ লক্ষ করলেন দুজন যুবকের ভীষন মন খারাপ,মন খারাপের কারন জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, "আমরা কি এতোই অযোগ্য দেশ মাতার শত্রুকে ধ্বংস করার মতো মহৎ কাজের সুযোগ আমরা পেলাম না"। তারা দুজন হলেন খুদিরাম এবং রংপুরের প্রফুল্ল চাকি।
তখন দায়িত্ব এল খুদিরাম বসুর ও প্রফুল্ল চাকির হাতে। বয়স আঠারো হয়নি, তবু তাঁদের চোখে তখন অর্জুনের লক্ষ্যভেদী দৃঢ়তা আর হৃদয়ে ভগবান রামের মতো ন্যায়ের আগুন।
---
শিকারের অপেক্ষা
খুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি মুজাফ্ফরপুরে পৌঁছে কিংসফোর্ডের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে তারা শহরের প্রান্তে, ইউরোপিয়ান ক্লাবের কাছে ও তাঁর বাসভবনের আশেপাশে লুকিয়ে থাকেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাঁরা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন—হাতে বোমা, মনে মাতৃভূমির নাম, ঠোঁটে নীরব “বন্দে মাতরম”।
---
অগ্নির রাত
৩০ এপ্রিল ১৯০৮। রাত সাড়ে আটটা। ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকে একটি গাড়ি বেরোল। খুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকি তৎক্ষণাৎ বুঝলেন—এটাই সেই মুহূর্ত, যার জন্য এতদিন অপেক্ষা।
খুদিরামের চোখে বজ্রের দীপ্তি, হাতে মৃত্যুর বজ্রাস্ত্র। তিনি শ্বাস নিলেন গভীরভাবে, মনে ভগবানকে স্মরণ করলেন—তারপর নিক্ষেপ করলেন বোমা!
প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। ধুলো, ধোঁয়া আর আগুনে আকাশ কেঁপে উঠল। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় কিংসফোর্ড সেদিন অন্য গাড়িতে ছিলেন। বিস্ফোরণে নিহত হলেন দুই ইংরেজ মহিলা—। ঘটনা বুঝতে পেরে দুইজন দুইদিকে দৌড় দেয়। খুদিরাম ধরা দেয় পুলিশের কাছে এবং প্রফুল্লচাকি দৌড়ে একটি ট্রেনে উঠে পরেন। ততক্ষণে ঘটনাটি যানা জানি হয়ে যায়। ট্রেনে একজন হিন্দু পুলিশ অফিসার হরপ্রসাদ মন্ডল তাকে দেখে বুঝজে পারেন পারেন এই ছেলে হয়তো সেই ঘটনার সাথে জড়িত। তার চোখে তখন ব্রিটিশদের প্রসংশা আর চাকরিতে প্রমোশনের প্রত্যাশা জ্বলজ্বল করছে৷ তিনি গোপনে খবরটি ইংরেজদের পৌছে দেন এবং পরবর্তী ষ্টেসন পুলিশ ঘিরে ফেলে। প্রফুল্ল চাকি তাদের কাছে ধরা না দিয়ে নিজের রিভালবার দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করেন।
এই কিশোর বিপ্লবীদের মুখে ভয় নয়—ছিল বিজয়ের হাসি।
---
শেষ যাত্রা
১১ আগস্ট ১৯০৮ সকাল। মেদিনীপুর জেলখানা। গায়ে গেরুয়া পোশাক, কপালে তিলক, হাতে অদৃশ্য তরবারি যেন। ফাঁসির মঞ্চে উঠতে উঠতে তিনি উচ্চারণ করলেন—
“বন্দে মাতরম! জয় হিন্দ!”
মৃত্যু খুদিরামকে থামাতে পারেনি—বরং তাঁর আত্মত্যাগ হয়ে উঠল হিন্দু জাতীয় চেতনার জ্বালানি, যা আজও ভারতের যুবকদের হৃদয়ে আগুন জ্বালায়।
কিংসফোর্ড হয়তো তাঁদের হাতে প্রাণ হারাননি, কিন্তু সেই বোমা ছিল এক বজ্রনিনাদ—“আমরা হিন্দু, আমরা স্বাধীন হবই!” খুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকির আত্মত্যাগ প্রমাণ করে, হিন্দু যুবকের প্রতিজ্ঞা যখন ধর্ম, সংস্কৃতি ও মাতৃভূমির জন্য হয়, তখন মৃত্যুও তাকে জয় করতে পারে না।