31/08/2025
আচ্ছা আমরা কি জানি যে আল্লাহর তরফ থেকে একমাত্র নামাজ ব্যতীত কোন আদেশ আকাশে অবতীর্ণ হয়নি?
রোজা, হাজ্জ, হিজাব ইত্যাদি বিধানগুলো নাযিল হয়েছে পৃথিবীর মাটিতে, ফেরেশতা জিবরীল (আঃ) মারফত ওহীর মাধ্যমে। কিন্তু নামাজের আদেশ বান্দার জন্যে কার্যকরী করার সময় আল্লাহ স্বয়ং রসূল(সাঃ) কে মেহমান করে নিয়ে যান সাত আসমানের উপর!
বান্দা এবং আল্লাহর মধ্যকার সমস্ত দূরত্ব ভেদ করে রসূল (সাঃ) চলে যান তাঁর রবের দরবারে এই বিশেষ উপহারটি নিবার সময়!! কতটা সম্মান আর ভালোবাসায় মুড়িয়ে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্যে নামাজের বিধান নাযিল করেছেন!
সুবহানআল্লাহ কল্পনা করা যায় নামাজের মধ্যে প্রতিবার সরাসরি আল্লাহর সাথে আমাদের মুখোমুখি মিটিং হচ্ছে?
আমরা কি সেই মিটিংকে আমাদের রবের তরফ থেকে আসা ডিরেক্ট উপহার হিসেবে নিচ্ছি? নাকি "নামাজ" কেবল আমাদের শত কাজের লিস্টের মধ্যে একটি 'কাজ' মাত্র যেটাকে যন্ত্রের মত কোনমতে পালন করে আমরা পরের কাজে চলে যাই?
"নামাজে মন ফেরানো" সিরিজে আজকের পর্বে আমরা জানব নামাজে পঠিত সানা-র অর্থ এবং ব্যখ্যা
🔹নামাজে পড়া সানার অর্থ এবং ব্যাখ্যাঃ
"সুবহানাকাল্লাহুম্মা, ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারকাসমুকা, ওয়া তাআ'লা জাদ্দুকা, ওয়ালা ইলাহা গইরুকা"
অর্থঃ "আল্লাহ আপনি কতই না পবিত্র, আপনার কোনো ভুল নেই। আমি সারাজীবন আপনার প্রশংসা করেই যাবো, আপনার নামগুলি সবচেয়ে বরকতপূর্ণ, আপনার নির্ধারিত হুকুম সবচেয়ে উচ্চ, আমি কখনোই আপনি ছাড়া আর কারো ইবাদাত করবো না। (অর্থাৎ কাউকে আপনার থেকে বেশি গুরুত্ব দিবো না!)
🔹সুবহানাকাল্লাহুম্মা, ওয়া বিহামদিকাঃ
এর অর্থ আমাদের আল্লাহ সবচেয়ে পারফেক্ট, তিনি সমস্ত ভুল হতে পবিত্র এবং সমস্ত প্রশংসা কেবল তাঁরই জন্যে। একটু খেয়াল করি, আমরা মানুষরা জীবনে এই দুইটা জিনিসই খুব চাইঃ Perfection and Praise. অর্থাৎ নিজেদের জন্যে আমাদের সবকিছু পারফেক্ট হতে হবে; পারফেক্ট ক্যারিয়ার, পারফেক্ট বিয়ে, পারফেক্ট বাড়ি! আর অন্যের কাছে আমরা আশা করি, প্রশংসা বা এপ্রিশিয়েশান। আমরা খুব চাই যে, পরিবারে, সমাজে অন্যেরা আমাদের সমাদর করুক!
ইন্টারেস্টিং ব্যপার হচ্ছেঃ মানুষের জীবনের বেশির ভাগ কষ্ট আসে এই দুই এর অভাবে। হয়, নিজেরা পারফেক্টলি কিছু করতে পারিনি, তাই নিজের উপর হতাশ। নাহলে অন্যের কাছে যেই সমাদর আশা করেছি সেটা পাইনি, তাই অন্যের উপর হতাশ!
চমৎকার ব্যপার হচ্ছে, আল্লাহ বার বার নামাজে আমাদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ত্রুটিহীনতা এবং প্রশংসা - এই দুইটি বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি আল্লাহ রব্বুল আলামিনের আয়ত্বে। আমাদের আয়ত্বে না।
যেই আমরা নামাজে দাঁড়িয়ে বলছি, "সুবহানাকা আল্লাহুম্মা (আল্লাহ তুমি কত পবিত্র, ত্রুটিহীন), ওয়া বিহামদিকা (এবং আমি তোমার প্রশংসা সারাজীবন করেই যাবো) - সাথে সাথে আমরা আল্লাহর সামনে নিজেদের ত্রুটিপূর্ণ সত্তাকে কবুল করে নেই।
অন্য কোন সৃষ্টির কাছে সমাদর না খুঁজে একমাত্র আল্লাহর দিকে ফোকাস করি। এটা খুব পাওয়ারফুল। নামাজে দাঁড়িয়েই এটা একজন মুসলিমকে মেন্টালি স্ট্রং বানিয়ে দেয়। সে জানে যে, তার হতাশ হবার কিছু নেই। সে ভুলে ভরা হলেও আল্লাহ তাকে তার ঈমানের সহিত করা ছোট/বড় সকল আন্তরিক চেষ্টার জন্যে পুরষ্কৃত করবেন!
অন্য কারো কাছে প্রশংসা বা উপযুক্ত সমাদর না পেলেও তার কষ্টের কিছু নেই; সত্যিকার প্রশংসা তো কেবল আল্লাহর জন্যে, তার নিজের জন্যে তো না। ইম্পারফেক্ট বান্দার জন্য রয়েছে তার পারফেক্ট রব!
🔹ওয়া তাবারকাসমুকাঃ
অর্থ, "আল্লাহ তোমার নামগুলি কতই না বরকতপূর্ণ!" এখানে, আরবি "বারাকাহ" শব্দকে ইংরেজিতে "Blessing" এবং বাংলায় আশীর্বাদ বলা হয়। খুব কমনলি আমরা একে অন্যকে বলে থাকি, "May Allah Bless you", মানে "আল্লাহ তোমাকে বরকত দিক"। বরকত বলতে আমরা সাধারণত বুঝি কল্যাণ, মঙ্গল - জীবনে যা কিছু ভালো।
"বারাকাহ"-র আরেকটা ইন্টারেস্টিং অর্থ কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না। বারাকাহ মানে হচ্ছে, যখন আল্লাহ আমাদের জীবনে কল্যাণ এমনভাবে বাড়িয়ে দেন যে, আমরা অনেক কম সময়ে অনেক বেশি কিছু অর্জন করে ফেলতে পারি!
বারাকাহর একটা প্রাইম উদাহরণ দেই।
গেল রোজায় আমার এক বড় বোন কয়েকজন মুরব্বিদের ইফতারে দাওয়াত করবেন বলে নিয়ত করলেন। কিন্তু, আপুর হাতে ওইদিন সময় ছিল অনেক কম। সারাদিনের ঝড়-ঝাপটা শেষে সন্ধ্যার ঠিক আগে হাতে পেলো এক থেকে দেড় ঘণ্টা! এতগুলা মানুষের খাবার এত কম সময়ে সে কীভাবে করবে?
আপু তখন ভাবলো, "ইয়া আল্লাহ! আমি তোমার জন্যে নিয়ত করেছি যে তোমার বান্দাদের ইফতার খাওয়াবো। তুমি আমার জন্যে পথ করে দাও! মাগরিবের আযান পড়ার ৫ মিনিট আগে সে যখন টেবিলে দশটার বেশী আইটেম রেডি করে ফেললো, টেবিল ভর্তি খাবার দেখে আপুর বিস্ময়ে অস্ফুটে মুখ থেকে বের হলো - "এটা আমি করি নাই! এটা আল্লাহর বারাকাহ!"
যখন আল্লাহ সময়ে বারাকাহ দেন, তখন সেই সময় এমনভাবে প্রশস্ত হয়ে যায় যে, কম সময়ে অনেক বেশি কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব হয়, যেটা আল্লাহর বারাকাহ ছাড়া অসম্ভব!
নামাজ এমন একটা ইবাদাত, যেটা করতে খুব কম সময় লাগে, কিন্তু আমরা যদি সেটা সঠিকভাবে জীবনে পালন করতে পারি, তাহলে প্রতিদিনের কয়েক মিনিটের এই নামাজই আমাদের জীবনে অসম্ভব রকমের কল্যাণ এবং বরকত নিয়ে আসবে!
নামাজের শুরুতেই যখন আমরা বলছি যে, "ওয়া তাবারকাসমুকা" - "আল্লাহর নামগুলি বরকতপূর্ণ" - তখন আল্লাহর কাছে আমরা সেই লেভেলের বারাকাহর আশা করছি! যেই সত্তার নামই এত বরকতপূর্ণ তিনি নিজে না জানি তাহলে কতটা বরকতপূর্ণ!
অকল্পনীয় এই বারাকাহর কল্যাণ আল্লাহ ছাড়া আমাদের জীবনে আসা সম্ভব নয় - এটাই আমরা প্রতিদিন পাঁচবার নামাজে মেনে নিচ্ছি।
সুবহানাল্লাহ! নামাজ যেমন বারাকাহ বাড়ায়, গুনাহ তেমনি বারাকাহ কমায়। সেজন্যে আমাদের গুণাহ থেকে অনেক দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে যেন জীবনের বারাকাহগুলো গুনাহ দিয়ে আমরা হারিয়ে না ফেলি। কষ্ট করে নামাজ পড়ে যে বারাকাহ পাচ্ছে, সে ঐ বারাকাহ প্রোটেক্ট করার জন্যে সমস্ত চেষ্টা দিয়ে গুনাহ থেকে দূরে থাকবে। এজন্যেই তো বলে,
"নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে।
(সূরা আনকাবুতঃ ৪৫)
তাহলেই নামাজের শুরুতেই একজন বান্দা মেন্টালি স্ট্রং হয়ে যাচ্ছে এই ভেবে যে দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে রব সে তাকে সমাদর এবং প্রশংসা করবেন এবং সেই রব তার বান্দার জন্যে অসম্ভব কল্যাণ এবং বারাকাহর দরজা খুলে দিতে সক্ষম! কেবল আমাদের মানুষের প্রশংসার আশা আর গুনাহগুলোকে ছুড়ে ফেলে রবের প্রতি আন্তরিক হবার অপেক্ষা!
মাঝে মাঝে কাজের চাপে খুব অস্থির লাগে। মনে হয় দশ দিক থেকে আমাকে টানা হচ্ছে আর মাঝখানে আমি তব্দা খেয়ে বসে আছি। কোন দিকেই যেতে পারছিনা! তখনই মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে শুনি নামাজের আহবান, "আল্লাহু আকবর ... আল্লাহু আকবর ..." আমাকে ডাকতে থাকে, "নামাজের দিকে আসো! কল্যাণের দিকে আসো!"
তখন এই অগোছালো আমি অন্তত একটা ডিরেকশানে যাবার পথ খুঁজে পাই! এলোমেলো টেবিলটা ওভাবেই ফেলে চলে যাই রবের কাছে নিজের আত্মাকে গুছিয়ে নিতে! এটা যে কতটা উপকারী এবং শক্তিশালী অনুশীলন - যে কোনদিন এর স্বাদ পায়নি তাকে বুঝানো কঠিন।
মুহাম্মদ ফারিস তার "প্রোডাক্টিভ মুসলিম" বইতে নিজের জীবনের এমন একটা ঘটনা লিখেছিলেন যে, একবার তাদের এলাকায় বড় ধরণের বন্যা হয় যার ফলে তাদের বাড়ির অনেকটা অংশই ডুবে যায়। লেখক হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে নিজের সাজানো ঘরটাকে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেতে দেখতে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠিক রাখা দায়!
ঠিক ঐ সময় তিনি শুনলেন যে আযান পড়ছে! সাথে সাথে তিনি মসজিদের দিকে হাঁটা দিলেন। ঐ ওলটপালট অবস্থা থেকে বের হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সাথে কথা বলে মনটা শান্ত করে নিলেন। মাথা ঠাণ্ডা হলে পরবর্তী কাজ সম্পাদনের একটা দিশা পেলেন!
যখন প্রচন্ড মন খারাপের দিনে কিছুই করতে ইচ্ছা করেনা, হতাশায় শুধু মনে হয় ঘরের এক কোণে গিয়ে বসে থাকি, তখনই একজন মুসলিম নামাজের জন্যে উঠে দাঁড়ায় নিজের রবের কাছে গিয়ে নিজেকে গুছিয়ে আনতে। আলহামদুলিল্লাহ এভাবেই নামাজ একজন মুসলিমের মনোবল চাঙ্গা করে এবং শক্তি বৃদ্ধি করে।
আসুন "নামাজে মন ফেরানো" সিরিজে আমরা আজকে সানার দ্বিতীয় অংশটুকু জেনে নেই ইনশাআল্লহ,
♦ওয়া তা আ'লা জাদ্দুকাঃ
"জাদ্দুকা" মানে "Determination, Decree", সহজ বাংলায় "ইচ্ছাশক্তি, আইন পাশ করে দেওয়া"। "আ'লা" মানে "Higher, উঁচু, মহান"। তাহলে এর অর্থ দাঁড়ালো - "আল্লাহর ইচ্ছা সবচেয়ে বড়"! আমাদের কত শত ইচ্ছা থাকে, কিন্তু আমাদের ইচ্ছামতন সবকিছু হয়না। তখন আমরা অনেকেই ভেঙ্গে পড়ি, কষ্ট পাই। অথচ, নামাজে প্রতিদিন আমরা সানায় স্বীকার করে নিচ্ছি যে - "আল্লাহ, আমার ইচ্ছার থেকে আপনার ইচ্ছা বড়!"
আমাদের সামান্য জ্ঞান দিয়ে আমরা কোন কাজের কী পরিণাম সেটা বুঝতে পারিনা। কিন্তু যেই রব মহান আল্লাহ, তিনি স্থান, কাল, পাত্র ভেদ করে সবকিছু জানেন। তাঁর থেকে ভালো আর কেউ জানবে না যে, এখন আমার জন্যে এই বিয়ে, চাকরি অথবা কাজ হয়ে যাওয়াটা আসলেই কতটা কল্যাণকর। যে ব্যক্তি "ওয়া তা আ'লা জাদ্দুকা"-র মর্ম বুঝে নামাজে এটা পাঠ করবে, না পাওয়ার কোন গ্লানি তাকে জেঁকে ধরতে পারবে না। তার অন্তর জুড়ে থাকবে প্রশান্তি ইন শা আল্লাহ।
♦ওয়া লা ইলাহা গাইরুকাঃ
"আল্লাহ, আমি আপনি ছাড়া আর কারো ইবাদাত করবো না" - এই পর্যায়ে এসে সানায় আমরা স্বীকার করি নেই যে, আল্লাহ আমাদের প্রভু। আমরা তাঁর গোলাম। আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে আমাদের মাথা নত করবো না। নিজেদের কামনা-বাসনা এবং নফসের সামনে না।
সমাজে সামনে না, শয়তানের ওয়াসওয়াসার সামনে না! আমরা আল্লাহর থেকে বেশি কোনকিছুকেই গুরুত্ব দিবো না।
আচ্ছা, একটু ভাবি, দিনের মধ্যে পাঁচবার করে যদি আমরা কাউকে নিজে থেকে গিয়ে বলে আসি যে, "তুমি আমার লাইফে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ"। এবং বলার সাথে সাথেই যদি এমন এমন কাজ তার চোখের সামনে করতে থাকি করি যা ঐ ব্যক্তি মোটেও পছন্দ করেন না, তাহলে পরবর্তীতে তার সামনে যেতে আমাদের অনেক লজ্জা লাগবেনা?
কষ্টের কথা কি জানেন, এই কাজটা আমরা দৈনিক আল্লাহর সাথে করে আসছি। এজন্যেই যে বুঝে নামাজ পড়ে, তারা জানেন যে আল্লাহর সাথে সে প্রতিশ্রুতি করেছে, সেই রবের দরবারে এখনি হাজিরা দিতে যেতে হবে। কীভাবে আল্লাহকে এতটা অসন্তুষ্ট করে তাঁর সামনে দাঁড়াই? কীভাবে তাঁর বান্দাকে কষ্ট দিয়ে, তাঁরই বান্দার হক মেরে এসে তাঁকে বলি যে, "ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা"?
আমরা নামাজ পড়ি আর আমাদের মনে হয় - "কই! নামাজ পড়েও তো খারাপ কাজ করেই যাচ্ছি!" এটা আমাদের নিজেদের দুর্বলতা, নামাজের না। আল্লাহ আমাদের ইবাদত, আখলাক এবং ইখলাস আরও বহুগুণে তাওফিক বাড়িয়ে দিক। আমিন।
নামাজে মন ফেরানো
শারিন সফি অদ্রিতা
© কপি পোস্ট ⬆️