13/05/2025
রবীন্দ্র প্রিভিলেজড কোহর্টের গাঁইয়া অহংকার
ফ্রিডেরিশ নিটশের "ম্যান এন্ড সুপারম্যান" আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "ঘরে বাইরে" আমার প্রিয় দুই পাঠ্য। ম্যান এন্ড সুপারম্যানে নিটশে অনুসন্ধান করেছেন উতকৃষ্ট মানুষের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে বাইরে একইভাবে উতকৃষ্ট মানুষের খোঁজ করেছেন।
নিটশের দুর্ভাগ্য তার রচনা নাতসিদের হাতে পড়েছিলো; রবীন্দ্রনাথের দুর্ভাগ্য তার রচনা আওয়ামীদের হাতে পড়েছিলো। নিটশের উতকৃষ্ট মানুষের অহম নিকৃষ্ট নাতসিরা গলায় পরে নিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও তার উতকৃষ্ট মানুষের অহম নিকৃষ্ট আওয়ামী বরণ করেছে।
নিটশের "উবারম্যানে"-র যে ধারণা; সেটিকে জোর করে হিটলার নিজের ওপর আরোপ করেন। নাতসি পার্টির ছেলে-মেয়েরা নিটশে চর্চা করে অ-নাতসিদের ক্ষুদ্র, ইনফেরিয়র ভাবতে শুরু করে। উবারম্যান মানেই নীলরক্ত, এমন একটি কল্পনা নিয়ে নাতসি নারী-পুরুষের কৌতুকের বিষয় হয় অনাতসিরা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম; নাতসি মেয়ে ফেসবুকে অনাতসি আইনস্টাইনকে নিয়ে খাট্টা তামাশা করে বলছে, ছাগুরে ছাগু। তখন অন্য নাতসি ছেলে-মেয়েরা কমেন্টে এসে আইনস্টাইনের বেডরুমের কাহিনী নিয়ে রগড় করছে। বলছে, বাপের দেশ আম্রিকা চইলা যাও।
ব্যাপারটা হচ্ছে ছাপড়ি নাতসিরা নিটশে বগলদাবা করে নিজেদের অভিজাত কল্পনা করতে থাকে। তখন তারা ইহুদি ও বামপন্থী কর্মীদের যত্রতত্র অপমান করতে থাকে। কোথাও ইহুদি বা বামপন্থী গ্রেফতার হলে নাতসিরা দাঁত কেলিয়ে বলতো, অরে ডিম দেও; অরে নিয়া অস্ত্র উদ্ধারে যাও। আবার পিয়ানো বাজিয়ে হিটলারকে নিয়ে কোরাস গাইতো, হিটলারের সরকার, বারবার দরকার।
এই যে ছাপড়ির আভিজাত্যের কল্পনা; এই কাজে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত হয়েছেন আওয়ামী লীগের হাতে। প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মে নিজেকে একটু প্রিভিলেজড কোহর্ট ভেবে দিনমান রবীন্দ্র সংগীত শোনা; আর ভিন্নমতের মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা; জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের কস্টিউম পরে ঘাড় কাত করে ফেসবুক প্রোপিক দেয়া; জুলাই হত্যাকাণ্ডে অনুশোচনা না আসা; অথবা জুলাই মাসে নীরব থেকে; ১-২ অগাস্টে হাসিনা পড়ে যাবে এটা বুঝে পথে নেমে আসা। আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি মামা-খালাদের এ টিম ৫ অগাস্টের পর পালিয়ে গেলে ৬ অগাস্ট থেকে ঐ শূন্যস্থান পূরণে সাংস্কৃতিক বি-টিম হিসেবে নেমে পড়া ছিদ্রান্বেষণে। এই এ টিম ও বিটিমের সেতুবন্ধ রবীন্দ্রনাথ। কারণ কল্পনায় নিজেকে প্রিভিলেজড কোহর্ট ভাবতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একটা সেলফি লাগে। নিজস্বগুনে এলিট দেখাবে; এমন চেহারা সুরত তো নেই তার। হিটলারের যেমন চেহারা সুরতে কুলায় না, তবু নীল রক্তের অহংকার তার।
একই গ্রামের মোকলেস আর খোরশেদের মধ্যে মোখলেস কৃষিকাজে থেকে যায়; খোরশেদ কেরানির চাকরি নিয়ে ঢাকায় আসে। মোকলেসের নাতি মাদ্রাসায় পড়ার কারণে; আর খোরশেদের নাতনি অপাংতেয় অনুসূয়া বাংলা মিডিয়ামে পড়ায়; কয়েকটি ইংরেজি শব্দ শেখায়; আর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির কস্টিউম পরে গুন গুন করায় মাদ্রাসার ছেলেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মাঝ দিয়ে সে যেন খোদ রবীন্দ্রনাথের নাতনি হয়ে পড়ে।
নিটশে আর ঠাকুরের দিব্যি দিয়ে দিনের পর উন্নাসিকতা প্রদর্শন করেছে নাতসি ও আওয়ামী ঘরানার ছাপড়ি ছেলে-মেয়েরা। ফলে অন্য ছেলে-মেয়েদের পুরো ক্রোধ গিয়ে পড়েছে নিটশে ও রবীন্দ্রনাথের ওপর।
অনভিজাত লোকের আভিজাত্য নির্মাণের টুল হওয়ায় নিটশে ও রবীন্দ্রনাথ অজনপ্রিয় হয়েছেন সমাজের বড় একটি অংশের মাঝে। বানরের হাতে খুন্তির মতো অপব্যবহৃত হয়েছেন ঐ দুই দার্শনিক। অথচ নিটশে বলছেন, পার্থিব ছোট খাট চাওয়া ফেলে মহৎ কোন উদ্দেশ্যে জীবন নিবেদিত করাই উতকৃষ্ট মানবের শক্তি। আর রবীন্দ্রনাথ বলছেন, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ভবঘুরের সম্পদ অর্জনের ও স্বাস্থ্যবান হবার কূটকৌশল।
এই রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেসের গান্ধী ও নেহেরুকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। রাজনীতি সচেতন মানুষ তিনি; কিন্তু দলবাজি ও উগ্রজাতীয়তাবাদ অপছন্দনীয় ছিলো তার কাছে। সেই মানুষটি মৃত্যুর অনেক পরে আওয়ামী লীগের উগ্র জাতীয়তাবাদ নির্মাণের টুল হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ বিরোধী মানুষ ছিলেন; কিন্তু তবুও ভারত স্বাধীন হবার ক্ষণে তার গীতিকবিতাকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতারা।
শিলাইদহ-শাহজাদপুরের রবীন্দ্রনাথ দুই বিঘা জমিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের নিষ্ঠুরতার ছবি এঁকেছেন। কুষ্টিয়ার বাউল গানের প্রেমে পড়েছেন। তিনি হ্যাভস সমাজের একজন হলেও হ্যাভস নটের মাঝেই নিজেকে সমর্পণ করেছেন। কলকাতায় বেঙ্গল রেনেসাঁর হিন্দুত্ববাদী কর্কশতার ভুল শিক্ষার বিপরীতে শান্তি নিকেতন গড়েছেন শিষ্টাচার ও বিনয় শেখাতে।
রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম ধর্ম চর্চা করেছেন; যা সুফি চর্চার সঙ্গে তুলনীয়। তার পরিবার মুসলমান পীরের সঙ্গে সম্পর্কিত পীরালি ব্রাহ্মণ বলে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করতেও অস্বীকার করেছে। ২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় এলে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য পর্যন্ত ভাঙ্গা হয়েছে ভারতে।
ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা রবীন্দ্রনাথকে অপছন্দ করলেও ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের সমর্থক বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদীরা আবার এক একজন রবীন্দ্র দূত। একইসঙ্গে আওয়ামী দূত।
হুমায়ূন আজাদের লেন্সের পাকিস্তান রবীন্দ্র বিরোধী হলেও; পাকিস্তান সমাজে রবীন্দ্র চর্চা সবসময় বহাল থেকেছে। অনুবাদের মাঝ দিয়ে রবীন্দ্রপাঠ ছাড়া বাংলায় দু'কলি রবীন্দ্র সংগীত গাইবার চেষ্টা পাকিস্তান সমাজে লক্ষ্য করা যায়। টিভি নাটকে রবীন্দ্র সংগীতের ব্যবহার, ভালো কোন রবীন্দ্র সংগীত গাইয়েকে হাতের কাছে পেলে টিভি শোতে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশনের চল রয়েছে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ এশিয়ার ঐ অংশে কিছুকাল অবস্থান করেছেন। সুতরাং ষাটের দশকে পাকিস্তানের ক্ষমতা-কাঠামোর রবীন্দ্র বিরোধিতাকে উপজীব্য করে যারা পাকিস্তান সমাজেই রবীন্দ্রনাথ পরিত্যাজ্য বলে বর্ণনা করেছেন; তারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বয়ান নির্মাণ করেছেন। ক্ষমতা কাঠামো আর সমাজ আলাদা ব্যাপার। নাগরিক সমাজ গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ওগো মা বলে পায়ে পড়ে যাওয়াটা আওয়ামী কালচার মাত্র। অন্য কোন সমাজে এসব সিনক্রিয়েট নেই।
বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ দ্বারা নিঃগৃহীত সমাজ ও রবীন্দ্র প্রিভিলেজড কো-হর্টের গাঁইয়া অহংকার প্রদর্শনে যারা রবীন্দ্রনাথকে অপছন্দ করতে শুরু করেছেন; তারা আসলে বানের ওপরে রাগ করে ধান ডুবানোর সংকল্প করেছেন।
ফুল থেকে মৌমাছি নেয় মধু, মাকড়সা নেয় বিষ। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষেরা তেমনি রবীন্দ্রনাথ থেকে মধু নিয়েছেন। আর আওয়ামী লীগ ও কথিত রবীন্দ্র প্রিভিলেজড কোহর্ট রবীন্দ্রনাথ থেকে বিষ নিয়েছে।
আমি অনুরোধ করবো, রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিত রায় নির্মিত চলচ্চিত্র অবশ্যই দেখার জন্য। আওয়ামী লীগ ও রবীন্দ্র প্রদর্শকদের যখন জন্ম হয়নি; তখনি কি করে রবীন্দ্রনাথ আওয়ামী লীগের হিপোক্রেসির মুখোশ উন্মোচন করেন; তা ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়।