26/06/2025
" পিরিয়ড যেন মৃত্যু উপত্যকা"
মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক একটি প্রক্রিয়ার নাম মাসিক, বা যাকে আমরা বলি "পিরিয়ড"। অথচ এই স্বাভাবিক জৈবিক অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াটি আজও সমাজে অস্বস্তি, লজ্জা, অবহেলা আর কুসংস্কারের দেয়ালে বন্দী। অনেক সমাজে, বিশেষত গ্রামীণ ও রক্ষণশীল পরিবেশে, পিরিয়ড যেন মৃত্যু উপত্যকা— যেখানে একটি মেয়ের প্রতিটি দিন কাটে অসহ্য যন্ত্রণায়, শারীরিক কষ্টে, এবং সমাজের নিষ্ঠুরতা ও অজ্ঞতার ছায়ায়।
🌑 এক রক্তাক্ত নীরবতা
মেয়েরা যখন প্রথমবার পিরিয়ডে প্রবেশ করে, তখন সেটি তাদের জীবনে এক বিশাল পরিবর্তন এনে দেয়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের জন্য আমরা সমাজ হিসেবে প্রস্তুত নই। অনেকেই জানেই না কীভাবে একজন কিশোরীকে সঠিকভাবে মানসিক ও শারীরিক সমর্থন দিতে হয়।
পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা যেন এক নিষিদ্ধ বিষয়। এই "নিষিদ্ধতা" মেয়েদের করে তোলে চুপচাপ, আত্মগোপনে অভ্যস্ত। অনেকেই জানে না কীভাবে প্যাড ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হয়, এমনকি কীভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হয়। এই অজ্ঞতার ফলেই অনেক কিশোরী ও নারী আক্রান্ত হন ইউরিনারি ইনফেকশন, পিসিওএস, কিংবা দীর্ঘমেয়াদী জরায়ুর জটিলতায়।
🔥 পিরিয়ডে মৃত্যু— বাস্তবতার নির্মমতা
আমরা পিরিয়ডকে যতই “লজ্জার” বা “গোপন” বিষয় বানাই না কেন, বাস্তবতা আরও নির্মম। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অঞ্চল, বিশেষত নেপালের কিছু পাহাড়ি এলাকায় ‘ছৌপাদি’ নামে এক প্রথা চালু আছে যেখানে পিরিয়ডকালীন নারীদের গরুর গোয়ালঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। খাদ্য, নিরাপত্তা বা তাপমাত্রার অভাবে তারা মৃত্যুবরণ করে— হ্যাঁ, মেয়েরা সত্যিই মারা যায়, শুধু এই প্রাকৃতিক রক্তপাতের সময় ‘অপবিত্র’ হওয়ার অভিযোগে।
বাংলাদেশেও দেখা যায়, স্কুলে শৌচাগারের অভাব, প্যাড না পাওয়া, কিংবা সমাজের বিদ্বেষের কারণে অনেক মেয়েই স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৪০ শতাংশ কিশোরী পিরিয়ড চলাকালে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। কেউ কেউ চিরতরে পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়।
💔 পিরিয়ড মানেই কেন অবহেলা?
পিরিয়ড একটি স্বাভাবিক বায়োলজিকাল প্রক্রিয়া— যেটা নারী শরীরকে মাতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করে। অথচ এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকেই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়। পরিবারে, সমাজে, এমনকি কিছু মসজিদ-মন্দিরে আজও নারীকে ‘অপবিত্র’ বলা হয় এই সময়ে।
যেখানে উন্নত বিশ্বে পিরিয়ড হাইজিন নিয়ে গবেষণা হয়, মেয়েরা ফ্রি প্যাড পায়, সঠিক শিক্ষা পায়, সেখানে আমাদের দেশে এখনও অনেক মেয়ে পুরনো কাপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে লজ্জা পায়। কেন? কারণ সমাজে এখনও এই বিষয়টি “লুকাতে হবে” বলে শেখানো হয়।
🌸 আশা ও আলো: পরিবর্তনের ইশারা
তবে আশার কথা, সময় বদলাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় পিরিয়ড নিয়ে কথা বলছে। কিছু উদ্যোগ, যেমন “পিরিয়ড ক্যাম্পেইন”, “ফ্রি প্যাড প্রজেক্ট” বা স্কুলে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রকল্প— সমাজে আলো ফেলছে। পিরিয়ড যেন আর মৃত্যু উপত্যকা না হয়, বরং হোক নারীর জীবনের প্রাকৃতিক এক অধ্যায়— সে দাবিতে আমরা সবাইকে সচেতন হতে হবে।
📢 সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার— সবার দায়
নারীর প্রতি ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হলে পিরিয়ড-সংক্রান্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। স্কুলে স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ টয়লেট ও প্যাড সরবরাহ রাখতে হবে, আর পরিবারে মা-বাবার উচিত সন্তানদের সাথে এই বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে আলোচনা করা।
পরিশেষে বলা যায় যে,
পিরিয়ড কোনো অভিশাপ নয়, কোনো অপবিত্রতা নয়, এটা এক নারীর শক্তির পরিচয়, তার জীবনের স্বাভাবিক সঙ্গী। সমাজ যতদিন এটাকে মৃত্যু উপত্যকা বানিয়ে রাখবে, ততদিন নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকবে, তার মর্যাদাও প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। তাই এখনই সময়— লজ্জা নয়, কথা বলার। চুপ থাকা নয়, সময় এসেছে পরিবর্তন আনার।
তাই,ভয়কে জয় করুন, অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে সুষ্ঠু সবল স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকুন।
゚