27/03/2025
পেরেশানি, দুশ্চিন্তা ও কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কুরআন ও হাদিসে বেশ কিছু আমল নির্দেশিত হয়েছে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল উল্লেখ করা হলো:
১. আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা করা)
আল্লাহ বলেন:
"যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহ তাকে যথেষ্ট।" (সূরা তালাক: ৩)
➡ করণীয়: প্রতিটি কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করুন, মনে রাখুন—তিনি আমাদের সব সমস্যার সমাধানকারী।
---
২. ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
"যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তিগফার করবে, আল্লাহ তাকে প্রতিটি কষ্ট থেকে মুক্তি দেবেন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে রিজিক দান করবেন।" (আবু দাউদ)
➡ করণীয়: প্রতিদিন বেশি বেশি "আস্তাগফিরুল্লাহ" বলা।
---
৩. দোয়া করা (বিশেষ কিছু দোয়া)
রাসূল ﷺ বিভিন্ন সময়ে কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু দোয়া শিখিয়েছেন:
✅ ১ম দোয়া:
اللهم إني أعوذ بك من الهم والحزن، والعجز والكسل، والجبن والبخل، وضلع الدين وغلبة الرجال
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল-হাম্মি ওয়াল-হাজানি, ওয়াল-আযজি ওয়াল-কাসলি, ওয়াল-জুবনি ওয়াল-বুখলি, ওয়ালা-বালিদ্দাইনি ওয়াগালাবাতির-রিজাল।
➡ অর্থ: "হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা, অপারগতা ও অলসতা, কাপুরুষতা ও কৃপণতা, ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রভাব থেকে আশ্রয় চাই।" (বুখারি, মুসলিম)
✅ ২য় দোয়া:
حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
➡ উচ্চারণ: হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি'মাল-ওয়াকীল।
➡ অর্থ: "আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি সর্বোত্তম কার্যনির্বাহক।" (সূরা আলে ইমরান: ১৭৩)
✅ ৩য় দোয়া:
اللهم لا سهل إلا ما جعلته سهلا وأنت تجعل الحزن إذا شئت سهلا
➡ উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা লা সাহলা ইল্লা মা জা'আলতাহু সাহলা, ওয়া আন্তা তাজআলুল হাজনা ইজা শিতা সাহলা।
➡ অর্থ: "হে আল্লাহ! আপনি যা সহজ করেন তাই সহজ। আপনি চাইলে কষ্টও সহজ করে দিতে পারেন।" (ইবনে হিব্বান)
---
৪. সকালে ও রাতে সূরা পড়া
✅ সূরা আল-বাকারা:
রাসূল ﷺ বলেছেন:
"যে ব্যক্তি তার বাড়িতে সূরা আল-বাকারা তিলাওয়াত করবে, শয়তান সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে।" (মুসলিম)
✅ সূরা আল-ইখলাস, ফালাক, নাস (৩ বার করে) ও আয়াতুল কুরসি
➡ সকালে ও রাতে পড়লে পেরেশানি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
✅ সূরা আশ-শারহ (আল-ইনশিরাহ) পড়া
➡ এই সূরায় বলা হয়েছে, "নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে সহজি আছে" (সূরা ৯৪:৫-৬)। এটি পড়লে মন হালকা হয়।
---
৫. দরুদ শরীফ বেশি বেশি পড়া
রাসূল ﷺ বলেছেন:
"যে ব্যক্তি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেন।" (তিরমিজি)
✅ দরুদ ইবরাহিম (সালাতের মধ্যে যা পড়া হয়)
✅ ছোট দরুদ: اللهم صل على محمد وعلى آل محمد
---
৬. রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া
রাসূল ﷺ বলেছেন:
"তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে দুঃখ-কষ্ট দূর হয় এবং কল্যাণ লাভ হয়।" (তিরমিজি)
➡ করণীয়: রাতে উঠতে পারলে ২ বা ৪ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ুন, আল্লাহর কাছে কাঁদুন।
---
৭. গরিব-অসহায়দের সাহায্য করা
রাসূল ﷺ বলেছেন:
"যে ব্যক্তি অন্যের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তার কষ্ট দূর করবেন।" (মুসলিম)
➡ করণীয়: সদকা দিন, গরিবদের খাবার দিন, দুআ করুন।
---
৮. সর্বদা ধৈর্য ধরা ও আল্লাহকে স্মরণ করা
➡ "ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন" বেশি বলা।
➡ আল্লাহর যিকির করা (সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার)।
৯. আল্লাহর ৯৯টি নামের মাধ্যমে দোয়া করা
➡ আস্মা-উল-হুসনা (আল্লাহর সুন্দর নামগুলো) তিলাওয়াত করা।
➡ বিশেষ করে "ইয়া হাইয়্যু, ইয়া কাইয়্যুম, বিআ রহমাতিকা আসতাগীস" বেশি বেশি বলা।
➡ অর্থ: "হে চিরঞ্জীব, হে বিশ্বচালক! আমি আপনার রহমতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করছি।" (তিরমিজি)
---
১০. নিজের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া
➡ কোনো বিপদ আসলে প্রথমে নিজের আমল পর্যালোচনা করা উচিত।
➡ আল্লাহ বলেন: "যে ব্যক্তি তওবা করে, আমি তার সব দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেই।" (সূরা হূদ: ৩)
➡ প্রতিদিন "আস্তাগফিরুল্লাহ" অন্তত ১০০ বার বলা।
---
১১. রিজিক বৃদ্ধির আমল
➡ "বিসমিল্লাহিল্লাহি লা ইলা-হা ইল্লা হুয়া" পড়া (আবু দাউদ)।
➡ ফজরের পর সূরা ওয়াকিয়া পড়া (রিজিকের সংকট দূর হয়, ইবনে মাজাহ)।
➡ সকাল-বিকেলে "লা হাওলা ওয়া লা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ" বেশি বেশি বলা (বুখারি)।
---
১২. ঘুমানোর আগে বিশেষ কিছু দোয়া পড়া
➡ সূরা আল-মুলক পড়লে বিপদ ও কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যায় (তিরমিজি)।
➡ আয়াতুল কুরসি পড়লে সারারাত নিরাপদ থাকা যায় (বুখারি)।
➡ সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস (৩ বার করে) পড়া।
---
১৩. জুমার দিনে বেশি বেশি দোয়া ও আমল করা
➡ রাসূল ﷺ বলেছেন, "জুমার দিনে একটি বিশেষ মুহূর্ত আছে, যেখানে দোয়া কবুল হয়।" (বুখারি)
➡ জুমার দিনে সূরা কাহফ পড়া (মুসলিম)।
➡ দরুদ শরীফ বেশি বেশি পড়া।
---
১৪. সালাতুত হাজত নামাজ পড়া (প্রয়োজনের নামাজ)
➡ কোনো বড় সমস্যায় পড়লে ২ রাকাত সালাতুত হাজত নামাজ পড়ুন।
➡ তারপর আল্লাহর কাছে নিজের সমস্যার কথা বলুন এবং সাহায্য চান।
---
১৫. দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য এই দোয়াটি বেশি পড়ুন
✅ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللَّهُ الْعَظِيمُ الْحَلِيمُ، لَا إِلٰهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، لَا إِلٰهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ السَّمٰوَاتِ وَرَبُّ الْأَرْضِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ
➡ উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল আজিমুল হালিম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রব্বুল আরশিল আজিম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রব্বুস সামাওয়াতি ওয়া রব্বুল আরদি ওয়া রব্বুল আরশিল কারিম।
➡ অর্থ: "আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি মহান ও পরম সহনশীল। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি মহাপরাক্রমশালী আরশের প্রতিপালক। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি আসমান-জমিন ও মহিমান্বিত আরশের প্রতিপালক।" (বুখারি, মুসলিম)
---
১৬. দান-সদকা করা (সদকা কষ্ট দূর করে)
➡ রাসূল ﷺ বলেছেন, "সদকা বিপদ-আপদ দূর করে।" (তিরমিজি)
➡ গোপনে বা প্রকাশ্যে গরিব-অসহায়দের সাহায্য করুন।
---
১৭. অধিক পরিমাণে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' পড়া
➡ "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ও হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির"
➡ ১০০ বার পড়লে পেরেশানি দূর হয়। (বুখারি, মুসলিম)
---
সংক্ষেপে করণীয়:
✅ বেশি বেশি ইস্তিগফার করুন।
✅ আল্লাহর ৯৯ নামের মাধ্যমে দোয়া করুন।
✅ আয়াতুল কুরসি, সূরা ওয়াকিয়া ও সূরা মুলক পড়ুন।
✅ সালাতুত হাজত নামাজ পড়ুন।
✅ দরুদ শরীফ বেশি পড়ুন।
✅ গরিবদের সাহায্য করুন।
✅ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: ধৈর্য ধরুন এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
আল্লাহ আমাদের সকল পেরেশানি ও দুশ্চিন্তা দূর করুন। আমিন!
---
শেষ কথা:
➡ সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আল্লাহর উপর ভরসা রাখা।
➡ সবর করুন, ইবাদত করুন, কুরআন পড়ুন, আর বেশি বেশি দোয়া করুন।
➡ যত কষ্টই আসুক, মনে রাখুন—আল্লাহ আপনার দোয়া শুনছেন এবং আপনাকে সাহায্য করবেন।
আল্লাহ আপনাকে সকল পেরেশানি থেকে মুক্তি দান করুন! আমিন।