04/04/2023
‘ইউরোপীয়দের চোখে বিদেশী নবাব’
__________________________
পলাশী যুদ্ধের আগে বঙ্গদেশ থেকে কোন ইংরেজ যে ধনশালী হয়ে স্বদেশে ফিরে যাননি, তা নয়; অনেকেই ফিরেছিলেন। কিন্তু তাতে কোন বৈচিত্র্য ছিল না, সেসব কারো দৃষ্টি আকর্ষণও করেনি। সেইসব ইংরেজরা অন্য দশজন ইউরোপীয় গ্রাম্য ব্যবসায়ীর মত নিজেদের দেশে ফিরে জমিজমা কিনেছিলেন। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পরে তাঁরা বাংলা থেকে রীতিমত ‘নবাব’ হয়ে নিজেদের দেশে ফিরতে শুরু করেছিলেন। পলাশীর যুদ্ধ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীকে আমূল পরিবর্তিত করে দিয়েছিল। তখন তাঁদের শুধু ধনী হলেই চলছিল না, মান প্রতিপত্তি খেতাব - এসবেরও দরকার ছিল।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল, আর ১৭৬৮ সালে দেখা গিয়েছিল যে, সেই ‘সাহেব-নবাবেরা’ নিজেদের দেশে ফিরে দলবদ্ধভাবে পার্লামেন্টে প্রবেশ করছেন, এবং তার মাত্র তিন বছর পরে, অর্থাৎ ১৭৭১ সালে দেখা গিয়েছিল যে, ‘হিউফুটের’ ব্যঙ্গ-নাটক ‘দি-নাবুব’ গ্রন্থে নবাব-চরিত্র নিন্দিত ও উপহসিত হচ্ছে। নাটকীয় ক্ষিপ্রতায় সেই পট-পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। পলাশী-যুদ্ধ ইংরেজদের বাংলা তথা ভারতবর্ষের একেবারে অন্তঃস্থলে ঠেলে দিয়েছিল। তখন তাঁরা বাংলার বিপুল ধনসম্পদের মুখোমুখি হয়েছিলেন, আর সামান্য একটু পরিশ্রম করলেই তো একেবারে ‘শ্যাংগ্রিলা’। ফলে তখন যাঁরা ‘ছোট ইংরেজ’ ছিলেন, যাঁরা সামান্য একটা চাকরিকে সম্বল করে কোনরকমে এদেশে এসে পৌঁছেছিলেন, তাঁরা কিছু কিছু ভারতীয় আদব-কায়দা গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন, তাঁরা ভারতীয় বিলাসিতাকে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে গ্রহণ করে কৃতার্থ হয়েছিলেন। আর তখন যাঁরা ‘বড় ইংরেজ’ ছিলেন, যাঁরা রুচিবান, উন্নত সংস্কৃতির ধারক ছিলেন, তাঁরা (শোর, হেষ্টিংস, ফোর্বস) তাঁরা ফার্সি সাহিত্য, হিন্দুপুরাণ, দর্শন পড়ে নিজেদের সময় কাটাতে শুরু করেছিলেন।
ঠিক সেই সময়ে ভারতের মাটিতে আরেক শ্রেণীর ইউরোপীয়ানদের আগমন শুরু হয়েছিল। তাঁরা ভাগ্যান্বেষীর দল ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের পরে লর্ড ক্লাইভ ও মীরজাফরের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল যে, কোম্পানির কোন কর্মচারীর কাছ থেকে নবাব নদীপথে যাতায়াতকারী মালের জন্য কোন ধরণের শুল্ক আদায় করতে পারবেন না। কিন্তু তখন যাঁরা কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন, এমন স্বাধীন ইংরেজ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করাও কোম্পানি বা নবাবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে সেই শুল্ক-রেহাই ও সরকারী অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে দলে দলে ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান ও আমেরিকানরা ইংরেজ সেজে বঙ্গদেশের গ্রামে গ্রামে ব্যবসা করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁদের পরিধানে থাকত ইংরেজ সিপাহীর পোশাক, আর হাতে থাকত ইংরেজদের পতাকা। নবাবের কর্মচারীরা তাঁদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে, তাঁরা কোন বিশিষ্ট ইংরেজের গোমস্তা বা এজেন্টের পরিচয় দিতেন, আর চ্যালেঞ্জ করলে নকল পরিচয় পত্র পর্যন্ত দেখিয়ে দিতেন। তখনকার সাধারণ গ্রামবাসী, বিশেষতঃ সেদিনের সরল গ্রামবাসীদের পক্ষে কে আসল আর কে নকল - সেটা বোঝা সহজ ছিল না। ফলে ওই সব ভাগ্যান্বেষীরা গঞ্জে বা নগরে হাজির হয়ে দেশী-ব্যবসায়ীদের বাজার দামের চেয়ে ঢের বেশি দাম দিয়ে তাঁদের মাল কিনতে বাধ্য করতেন। বস্তুতঃ ওই সব ছদ্মবেশী ‘ইংরেজ’ ব্যবসায়ীদের দুর্বৃত্তপনা দমন করতে গিয়েই মীরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের ১৭৬৪ সালে যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। যাই হোক, লর্ড হেষ্টিংস ১৭৭২ সালে নতুন আদেশ জারী করে ঐসব ব্যবসায়ীদের কলকাতার চৌহদ্দির বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য নীলকর সাহেবরা তাঁর সেই আদেশের এক্তিয়ারভুক্ত ছিলেন না। সেই আদেশের ফলে ওই ভাগ্যান্বেষী সাহেবদের বাংলার মফঃস্বলে যাওয়া পুরাপুরি বন্ধ হয়নি বটে, কিন্তু বাংলার গ্রামে গ্রামে ওই ‘গোরা-সাহেবরা’ যে ত্রাসের, যে বীভৎস অরাজকতার সৃষ্টি করেছিলেন, সেটা অনেকাংশে দূর হয়েছিল।
ওদিকে বাংলার শহরগুলিতেও তখন নতুন একটি শ্রেণীর দেখা পাওয়া গিয়েছিল। তাঁরা ভবঘুরে ও ভাগ্যান্বেষী ছিলেন না, কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে অধিক অর্থ সংগ্রহ করা তাঁদেরও লক্ষ্য ছিল। কোম্পানির বিভিন্ন পদে তাঁদের ঘনিষ্ঠ পরিচিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তখন অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাই দেশের সেই এলোমেলো অবস্থায় লুটেপুটে খাওয়ার জন্য তাঁরা ব্যগ্র ছিলেন। তাঁদের হাতে সময় বেশি ছিল না। তাঁরা জানতেন যে, কোম্পানির শাসনব্যবস্থা একটু বেশী কায়েমী হয়ে বসলে, নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, আর সহজে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হবে না। সেই অবস্থায় কোম্পানিতে কোনমতে বড় একটি পদ সংগ্রহ করতে পারলে তাঁদের পোয়া-বারো ছিল। তাঁদের নবাব হওয়া কে ঠেকাতেন?
এই প্রসঙ্গে ‘টপহ্যাম’ ১৭৬৫ সালে ‘বারিংটন’কে লিখেছিলেন, “The Company's Civil Service is the only certain track to a fortune or preferment and much more on the Bengal Establishment than any other.” (Home miscellaneous series, Topham to Barrington, 1765. P- 153) অর্থাৎ, কোম্পানির সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করাই হল বড়লোক হওয়ার নিশ্চিত পথ। আর তখন সেইসব পদের মধ্যে সেরা পদ ছিল, কোন দেশী নবাব বা রাজার অভাবে কোন বড় জমিদারের দরবারে ‘বৃটিশ রেসিডেন্টের’ পদ। তাতে দু’-দফা লাভ ছিল। প্রথমতঃ, কোম্পানি নবাবকে যে বৃত্তি দিত, সেটা রেসিডেন্টের হাত দিয়ে নবাবের কাছে পৌঁছাত। ফলে নবাবের কাছ থেকে সেই টাকা বাবদ তাঁরা কমিশন বা দস্তুরী পেতেন। দ্বিতীয়তঃ, নবাব যখন তাঁর নিজের বিলাসের জন্য কোন বিলাতী জিনিস কিনতেন, সেটাও ঐ রেসিডেন্টই তাঁকে সরবরাহ করতেন। সেটার জন্যও তিনি কমিশন পেতেন। অর্থাৎ, শাঁখের করাতের মত দু’-দিক দিয়ে কেটে তাঁরা টাকা রোজগার করতেন। ‘উইলিয়াম হিকি’র বন্ধু ‘বব পট’ যেদিন মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে বৃটিশ রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন, সেদিন তিনি যেন আনন্দের আতিশয্যে ফেটে পড়েছিলেন! “He rejoiced for not only did the whole stipend allowed by Government to the Nabob pass through the Resident’s hands he had likewise the further advantage of purchasing and paying for every European article the Nabab wished to have.” মুর্শিদাবাদ থেকে চার মাইল দূরে ‘আফজল বাগে’ তখন বৃটিশ রেসিডেন্টের বাসভবন ছিল। পট ভবিষ্যৎ লাভের কথা ভেবে আগে থেকেই বিশ হাজার টাকা ব্যয় করে সেই বাড়িটি সাজাবার ব্যবস্থা করে, সেখানে হিকি ও অন্যান্য বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হিকি সেই বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেটা বাড়ি নয়, রীতিমত প্রাসাদ ছিল, “... of the completest kind with warm and cold baths belonging exclusively to them and every other luxury of the East.”
পোলিশ পর্যটক ‘ম্যাক্সিমিলিয়ান উইকলিনস্কি’ সেই সময়ের (১৭৬৮-৮১) কলকাতার বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “... there were stately palaces where rich furniture pointed to the great wealth of the inmates whose voluptuous life resembled rather that of the Nawabs-they drank out of golden cups the best wines of the world. Over 2000 carriages perpetually rolled in that modern Babylon the governors of which could be compared, as regards pomp, power and magnificence, to real kings.” ‘ম্যাকিনটসের’ (১৭৭৭-১৭৮১) ভ্রমণ কাহিনীতে আঠারো শতকের কলকাতার সাহেব-নবাবদের দৈনন্দিন জীবনের একটি নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন - “সকাল প্রায় সাতটায় দারোয়ান গেটের দরজা খুলতেই সাহেবের সরকার, পিওন, হরকরা, চোপদার, হুঁকাবরদার, খানসামা, রাইটার ও সলিসিটরের দল বারান্দায় এসে জড়ো হয়। হেড-বেয়ারাসহ জমাদার সর্বপ্রথম হলঘরের মধ্যে দিয়ে সাহেবের শয়নকক্ষে সকাল আটটায় প্রবেশ করে। সাহেবের পাশ থেকে এক মহিলা উঠলেন, তাঁকে পাশের গোপন-সিঁড়ি দিয়ে পাশের কোন ঘরে বা একেবারে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। সাহেব শয্যা থেকে একটু নড়ে একটি পা বাড়াতেই বাইরের অপেক্ষমান সকলেই সাহেবের ঘরে প্রবেশের জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে। তারপরে শুরু হয় সালামের পালা। শরীরটাকে বাঁকিয়ে, মাথা নিচু করে, হাতের তালু কপালে ও উন্টা দিকে পিঠ স্পর্শ করে তিনবার তাঁরা সেলাম করল। তিনি চোখ মেলে তাঁদের দিকে তাকিয়ে বা ঈষৎ মাথা নেড়ে অনুগ্রহপ্রার্থীদের সালাম গ্রহণ করলেন। আধ-ঘণ্টার মধ্যে তাঁর ঢিলা পায়জামা চলে গেল, অঙ্গে উঠল নতুন পোশাক-শার্ট, ব্রিচেস, স্টকিং সিপার - সব কিছু। তিনি স্ট্যাচুর মত বসে রইলেন, কিছুই তাঁকে করতে হল না। নাপিত এল, ক্ষৌরকর্ম সমাধা করল, নখ কেটে, কানের ময়লা সাফ করে সে বিদায় নিল। এরপর এল আরেক নফর, হাতে চিলমজী ও বড় বালতি বোঝাই জল নিয়ে। সাহেবের হাতে ও মুখে জল ঢালা ও তোয়ালে দিয়ে সেই তাঁর গাত্র-মার্জনা করাই তাঁর কাজ। অতঃপর মহাশয় হেলতে দুলতে গেলেন ব্রেকফাস্টের ঘরে। গায়ে কেবল ওয়েস্টকোট। খানসামা চা ও টোস্ট এগিয়ে দিল। এবার আগমন হেয়ার-ড্রেসারের। অপর দিক দিয়ে হুঁকাবরদার। প্রায় নিঃশব্দে নলের একটি প্রান্ত সে বাবুর হাতে ধরিয়ে দেয়। হেয়ার ড্রেসার সাহেবের মাথায় যখন টেরি বানাতে ব্যস্ত, সাহেব তখন হুঁকো টানেন, কিছু খান বা পান করেন। … কখন এক সময়ে বেনিয়ানের আবির্ভাব হয়। সাহেবকে সালাম করে সে (অন্যান্য নফরদের তুলনায়) একটু বেশি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। উপস্থিত অনুগ্রহপ্রার্থীদের মধ্যে যাঁদের গুরুত্ব বেশি, তাঁদের জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা থাকে। বেলা দশটা পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান চলে। তারপর সেই নফরের দল সারি দিয়ে সাহেবকে পাল্কি পর্যন্ত নিয়ে যায়। পাল্কির আগে আগে ছুটে চলে আট থেকে বারো জনের চোপদার, হরকরা ও পিওন-বাহিনী। প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ড্রেস, মাথায় পাগড়ির রং ও কোমরবন্ধ দেখে তাঁদের পদমর্যাদা বোঝা যায়।” মোটামুটিভাবে এটাই ছিল তখনকার সাহেব-নবাবের রোজনামচা। পলাশী-যুদ্ধ বৃটেনের হাতে বাংলার রাজশক্তিকে তুলে দিয়েছিল, পলাশী-যুদ্ধই সেই নতুন নবাবদের সৃষ্টি করেছিল। পলাশী-যুদ্ধ বৃটিশ সেনাবাহিনী তথা সিভিলিয়ানদের মধ্যে এক নতুন শ্রেণীচেতনা এনে দিয়েছিল। সর্বোপরি পলাশী-যুদ্ধ সাধারণ শহর কলকাতাকে তার ‘কসমোপলিটান’ রূপটি দিয়েছিল।
অর্থ হাতে আসবার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজদের আগেকার অনাড়ম্বর জীবনে বিলাসিতা দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক সাহেবই তখন দেশী নবাবদের অনুকরণ করতে শুরু করেছিলেন। নিয়মিত নাচের আসরে যাওয়া ও বাড়িতে নাচের আসর বসানো সেই নব্য-নবাবদের ফ্যাশান হয়ে উঠেছিল। হিন্দুস্থানী নাচ যে তাঁরা তেমন কিছু বুঝতেন তা নয়, হিন্দুস্তানী গানও তাঁদের কাছে বোধগম্য হওয়া তো দূরের কথা, উল্টে বিরক্তিকর বলেই মনে হত। কিন্তু তবুও তাঁদের ফ্যাশানের দরকার ছিল। আগে দেশী মদ ‘আরক’ পান করেই তাঁদের দিন কাটত। তখন সেই আরক তাঁদের কাছে ‘পুওর ম্যানস ড্রিঙ্ক’ হয়ে পড়েছিল। বস্তুতঃ আরক ও হুইস্কি প্রায় একই রকমের বলে হুইস্কি দীর্ঘদিন পর্যন্ত ‘জেন্টলম্যানস ড্রিঙ্ক’ বলে ইংরেজ সমাজে স্বীকৃত হয়নি। সেই সময়ে হুঁকা-সেবন অনেক ইংরেজেরই স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। সম্ভবতঃ তামাকের সুগন্ধই সেটার মূল কারণ ছিল। পকেটে অর্থ আসবার ফলে সেই সাহেব-নবাবরা দেশীয় নবাবদের অনুসরণে নিজের নিজের বাড়িতে হারেম গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন। আগে ইংরেজদের মধ্যে কেউ কেউ পর্তুগীজ বা অন্যান্য খৃষ্টান নারীদের এদেশে বিয়ে করতেন। কিন্তু তারপরে নতুন যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা ইংরেজ ছাড়া অন্য কোন নারীকে বিবাহ করা নিজেদের জন্য সম্মানহানিকর বলে মনে করেছিলেন। তখন যেহেতু তাঁদের হাতে যথেষ্ট অর্থ ছিল, সেহেতু তাঁরা বিবাহের পরিবর্তে উপপত্নী গ্রহণ করাই নিজেদের জন্য নিরাপদ বলে মনে করেছিলেন। তদানীন্তন ভারতীয় রীতি অনুসারে সেই সময়ে একাধিক উপপত্নী গ্রহণ নিন্দনীয় ছিল না। আগে কলকাতার মধ্যেই একতলা বাড়িতে কোন রকমে তাঁদের মাথাগুঁজে বাস করতে হত। পরে হাতে অর্থ আসবার পরে তাঁরা খাস শহর ছেড়ে বাইরে বাগানবাড়ি ও বসতবাড়ি বানাতে শুরু করেছিলেন। দেখতে দেখতে গার্ডেনরীচ, বারাসত, ব্যারাকপুর প্রভৃতি জায়গায় ইংরেজদের নতুন নতুন বাগানবাড়ি গড়ে উঠেছিল। কেউ কেউ আবার নিজের বিলাস-ব্যসন চরিতার্থ করবার জন্য ফরাসি চন্দননগরে, ডেনিশ শ্রীরামপুর বা ডাচ চুঁচুড়াতেও বাড়ি বানিয়েছিলেন। কলকাতার ঐশ্বর্যের ও বিলাস-ব্যসনের খবর বিলেতে পৌঁছবার পরে সেখান থেকে অনূঢ়া কন্যারা দলে দলে স্বামী শিকার করবার জন্য ভারতে আসতে শুরু করেছিলেন। তাছাড়া, তখন নতুন যেসব অফিসারেরা ভারতে আসতে শুরু করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের স্ত্রী ও অন্যান্য পরিজনবর্গসহ এদেশে এসেছিলেন। ফলে ইংরেজ সমাজে মহিলাদের সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভারতে তাঁদের একটা সোসাইটি গড়ে উঠেছিল। সেই সোসাইটির সঙ্গে সঙ্গে এদেশে বিলাতী-নাচের আগমন ঘটেছিল। আগে গভর্নমেন্ট হাউসে বছরে মাত্র এক-দু’বার ‘বল নাচ’ অনুষ্ঠিত হলেও, পরে বারোমাস সেই নাচের আসর বসতে শুরু করেছিল। বাইরে ক্লাব ঘরে বা বিশিষ্ট সাহেবদের প্রশস্ত হলঘরে নাচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে রোদ ছিল না, বৃষ্টি ছিল না, শীত-গ্রীষ্ম ভেদাভেদ ছিল না, কুল-গোত্রের বালাই ছিল না - শুধু নাচ হলেই চলত। এমনকি নাচেরও - “চরম গরম বা বর্ষার সময়েও এমন একটি সপ্তাহ ছিল না যখন নাচ বাদ পড়েছে। যে ঘরে নাচের আয়োজন সেখানে পাখা নেই, মৃদু মোমবাতির আলো। ‘কোটিলো’ নাচতে হলে যে পরিশ্রম করতে হয়, তার ফলে নাচিয়েদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে।” কিন্তু সেই পরিশ্রম কেউ গায়ে মাখতেন না। কারণ, হাজার হোক দয়িতার সঙ্গে সাক্ষাতের সেটাই তো সবচেয়ে নিরাপদ সুযোগ ছিল। ‘এশিয়াটিকাস’ তখনকার কলকাতার বিলাতী নাচের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “নিজেকে সেই অবস্থায় একবার কল্পনা কর। অসহ্য গরমে তোমার প্রেমাস্পদা ম্রিয়মাণ। তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কম্পমান। প্রবল অবসাদের জন্য কোমল অঙ্গ সঙ্কুচিত। আর তাঁর দয়িত (নাচের পার্টনার) দুই হাতে মসলিনের রুমাল দিয়ে সানন্দে তাঁর মুক্তাবিন্দুবৎ মুখের ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছেন।” (“Imagine to yourself the lovely object of your affection ready to expire with heat, every limb trembling and every feature distorted with fatigue, and her partner, with a muslin handkerchief in each hand, employed in the delightful office of wiping down her face, while the big drops stand imparted upon her forehead.”) তখন বিলাতী নাচ চালু ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বলে ইংরেজদের কাছে দেশীয় নাচ অপাঙক্তেয় হয়ে থাকেনি। তাঁরা দেশী নাচ দেখতে যেতেন, আর বিলাতী নাচ নাচতে যেতেন। তাছাড়া ইংরেজ সেনাবাহিনীতে, যেখানে শ্বেতাঙ্গিনী ললনারা দুর্লভ ছিলেন, সেখানে কিন্তু দেশী নাচের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ থেকে গিয়েছিল। তখন নিজেদের অভিজাত প্রমাণ করবার জন্যই সদ্য-জাতে-ওঠা ইংরেজরা প্রায়শঃই নিজের নিজের বাড়িতে দেশী নাচের ব্যবস্থা করতেন, আর সেখানে অন্যান্য ইউরোপীয়দের আমন্ত্রণ জানাতেন।
১৭৬৯ সালে বঙ্গদেশে ইংরেজদের বিলাসী জীবনে পরিবর্তনের দ্বিতীয় জোয়ার এসেছিল। সেই বছরই বঙ্গদেশের জেলায় জেলায় ইংরেজ ‘সুপারভাইজার’ নিয়োগ করা হয়েছিল। ১৭৭২ সালে হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতে এসেছিলেন। সেই বছরই কোম্পানি নবাবের কাছ থেকে দেওয়ানি স্বহস্তে গ্রহণ করেছিল। এরপরে সুপারভাইজারদের নাম হয়েছিল ‘কালেক্টর’। সেই কালেক্টরদের সরকারী কাজ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করবার অধিকারও ছিল। হেস্টিংস জেলাপর্যায়ে অধিকাংশ কাজের দায়িত্ব ভারতীয় দেওয়ানদের উপরেই ন্যস্ত করেছিলেন। তাই কালেক্টররা তখন শুধু জেলার সদরে বসে টাকা গুনতেন আর বিচার করতেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির রাজস্ব ও কোম্পানির বাণিজ্যে অর্জিত টাকা গোনা অপেক্ষা তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে অর্জিত টাকা গুনতেই বেশি ভালবাসতেন। সেই বাণিজ্যে তখন বিপুল লাভও হত। ফলে তাঁরাও দেখতে দেখতে সিভিলিয়ন থেকে ‘নবাবে’ পরিণত হয়েছিলেন। অবশেষে কর্ণওয়ালিশ ১৭৮৭ সালে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি কোম্পানির রাজস্ব আদায় ও কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনাকে তিনি দুটি স্বতন্ত্র ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন। ওয়েলেসলির আমলে (১৭৯৮) দেখা গিয়েছিল যে, প্রত্যেক অফিসারের ক্ষমতাই আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়েছে। তখন ‘সেক্রেটারী বোর্ড অব রেভেন্যু’ বা ‘কালেক্টর অব বার্ডোয়ান’ ইত্যাদি নামগুলি বেশ গালভরা হলেও তাঁরা আদতে বাঁধা মাইনের সরকারী কর্মচারী ছাড়া অন্য কিছুই ছিলেন না। ওদিকে তখন কোম্পানির ‘কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টে’ যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁদের কোন জৌলুস ছিল না। তাঁরা শুধু চিনির বলদের মত চিনি বয়ে বেড়াতেন, কিন্তু সেই চিনি ভোগ করবার কোন অধিকার তাঁদের ছিল না। ইংরেজ শাসন ব্যবস্থায় তাঁরা নাক গলাতে পারতেন না। সেই সময়ে গ্রামের ব্যাপারী বেনিয়ানরাও তাঁদের রক্তচক্ষুকে ভয় পেতেন না। ১৮১৩ সালে ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার লুপ্ত হয়েছিল। এর কুড়ি বছর পরে, ১৮৩৩ সালে কোম্পানির বাণিজ্যিক পরিচয়ই একেবারে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কোম্পানি তখন কেবলমাত্র শাসকে পরিণত হয়েছিল, সেই সময়ে বণিকের মানদণ্ড আর তাঁদের হাতে ছিল না, শুধু রাজদণ্ড ছিল। এর থেকে দেখা যায় যে, আঠারো-ঊনিশ শতকের সাহেব-নবাবদের আয়ুষ্কাল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, জোয়ারের মতই তাঁদের যেমন আবির্ভাব ঘটেছিল, তেমনি আবার ভাঁটার টানে তাঁদের তিরোভাব হয়েছিল।
_______________________________
তথ্যসূত্র:
১- Asiaticus, John Hawkesworth.
২- কলকাতার ৩০০ বছরের ইতিহাস, অতুল সুর।
৩- কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র।
৪- শহর কলিকাতার ইতিবৃত্ত, বিনয় ঘোষ।)
©️রানা চক্রবর্তী
[email protected]