08/10/2025
বাংলাদেশের প্রায় ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ২০২৭ সালের মধ্যে চীনের তৈরি ২০টি J-10CE মাল্টিরোল ফাইটার জেট কেনার পরিকল্পনা ঘিরে দেশ-বিদেশে সমানভাবে প্রশংসা ও উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছে। কাগজে-কলমে এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য এক বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
চীনের এই আধুনিক যুদ্ধবিমানটিতে রয়েছে AESA রাডার, উন্নত অ্যাভিওনিকস, এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ সক্ষমতা, যা বর্তমানে ব্যবহৃত পুরোনো F-7 ও সীমিত সংখ্যক MiG-29 বিমানের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। চুক্তির অন্যতম সুবিধা হলো—মূল্য পরিশোধের সময়সীমা ১০ বছরব্যাপী, যা একদিকে অর্থনৈতিক চাপ কমাবে, অন্যদিকে বিমানবহর দ্রুত আধুনিক করার সুযোগ তৈরি করবে।
ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার সীমিত, আর রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে পিছিয়ে পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে চীনের দিকে ঝোঁকা এক বাস্তবসম্মত বিকল্প—খরচে তুলনামূলক সাশ্রয়ী, সরবরাহযোগ্য, এবং প্রযুক্তিগতভাবে পর্যাপ্ত উন্নত, যা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার আকাশ প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে পারে।
তবে সিদ্ধান্তটির ঝুঁকিও কম নয়। সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন—চীনা যুদ্ধবিমানের দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরযোগ্যতা, বিশেষত ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা ও রক্ষণাবেক্ষণ সেবার মান নিয়ে। তাছাড়া, বেইজিংয়ের সঙ্গে গভীর প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তোলা বাংলাদেশের সূক্ষ্ম কূটনৈতিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে—বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
যদিও প্রতিটি বিমানের আনুমানিক দাম প্রায় ৬ কোটি মার্কিন ডলার, বিশেষজ্ঞদের মতে পাইলট প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, যন্ত্রাংশ, এবং অস্ত্রসজ্জা মিলিয়ে প্রকৃত ব্যয় এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। বিকল্প হিসেবে সুইডেনের Gripen, পুরোনো F-16, কিংবা সীমিত সংখ্যক পশ্চিমা ফাইটার নিয়ে মিশ্র বিমানবহর কৌশলও বিবেচনা করা যেত—তবে প্রতিটি বিকল্পের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল জটিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।
সব দিক বিবেচনায়, বাংলাদেশের J-10CE ক্রয় পরিকল্পনা একদিকে যেমন সাহসী আধুনিকায়নের ঘোষণা, অন্যদিকে এটি চীনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গভীরে প্রবেশের সূক্ষ্ম ঝুঁকি বহন করছে। যদি এই চুক্তিতে রক্ষণাবেক্ষণ, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও পাইলট প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কঠোর শর্ত বাস্তবায়ন করা যায়, তবে এটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সক্ষমতায় এক ঐতিহাসিক মোড় আনতে পারে।
কিন্তু, যদি বিষয়টি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে এটি দেশের জন্য এক ব্যয়বহুল নির্ভরশীলতার ফাঁদে পরিণত হতে পারে—যেখান থেকে ভবিষ্যতে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে।
অতএব, প্রশ্ন থেকেই যায়—
এটি কি বাংলাদেশের এক দূরদর্শী আধুনিকায়নের পদক্ষেপ, নাকি এক খরচসাপেক্ষ ভূরাজনৈতিক জুয়া?
বাংলাদেশের কি অপেক্ষা করা উচিত ছিল পশ্চিমা প্রস্তাবের জন্য, নাকি বর্তমান বাস্তবতায় যা পাওয়া গেছে, সেটিকেই সঠিকভাবে কাজে লাগানোই ছিল বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত?