নীল ক্যাফের ভালোবাসা

নীল ক্যাফের ভালোবাসা ভালোবাসার নীল ক্যাফের ভালোবাসা প্রতিদিন কমপক্ষে একটি ভালো কাজ করুন
#নীল

21/09/2025

#অ্যারেস্টেড_লাভ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১২

সিগারেট ঠোঁট থেকে সরিয়ে ফ্যালফ্যাল করে নওয়াজের পানে তাকাল সেহের। টিমটিমে আলোতে লোকটাকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও সে নিজের পুলিশের ইউনিফর্মে নেই সেটা সেহের বুঝতে পারল। ক্ষীণ স্বরে সেহের বলল,
"আপনি হঠাৎ এখানে?'

"আমি তো বলেছিলাম আমি আবার আসব। আপনি হয়ত ভুলে গিয়েছেন আমার বলা কথাটা।"

"আমি সত্যি ভাবিনি আপনি আবার আসবেন। তাছাড়া আজকাল কথা দিয়ে কথা কে-ই বা রাখে?"

বেশ দায়সারাভাবে প্রত্যুত্তর করে সেহের। তাতে নওয়াজের মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটেনা। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে সেহেরের মুখোমুখি এসে সামান্য ঝুঁকে তার চোখে দৃঢ় দৃষ্টি রেখে স্পষ্ট জবাব দিলো,
"আমি রাখি।"

আচানক নওয়াজের এত নিকট চাহনিতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সেহের। যার ফলে পরপর তিনবার হেঁচকি ওঠে তার। সেই সুযোগে নওয়াজ ধীরে ধীরে সেহেরের হাতের দিকে গিয়ে তার সিগারেট ধরে নিজের হাতের কবলে নিয়ে আসতেই আরো একদফা চমকায় সেহের। সে ক্ষেপে উঠে সিগারেট নওয়াজের হাত থেকে সিগারেট নিতে চাইতেই নওয়াজও নিজের হাত সরিয়ে ফেলে জিনিসটা ফেলে দিয়ে নিজের পায়ের জুতার সাথে চাপা দেয়। সেহের হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
"হাউ ডেয়ার ইউ? একটু বেশি স্পর্ধা দেখিয়ে ফেলছেন না?"

নওয়াজ নির্লিপ্তে বলল,
"স্পর্ধা দেখানো যাদের পেশা তাদের থেকে আপনি কী আশা করেন? অ্যান্ড দিস ইজ অ্যা হসপিটাল ম্যাডাম, নট ইউর পারসোনাল স্মোকিং জোন।"

সেহের উঠে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,
"সো আপনি এখানে এসেছেন আমাকে ফ্রি-তে এডভাইস দিতে?"

তৎক্ষনাৎ নওয়াজের কাছ থেকে কোনো উত্তর পেল না সেহের। নওয়াজ নিজের প্যান্টের পকেট থেকে কয়েকটা জিনিস বের করে সেহেরের পাশে এসে দাঁড়াল। হাত মুঠো করে সেহেরের সামনে নিয়ে গিয়ে হাতটা খুলতেই দৃশ্যমান হলো সেহেরের প্রাণ প্রিয় কাঙ্ক্ষিত জিনিস গুলো। মাত্র একপলক মায়ের রিং দেখতে পেয়ে লোচন দুটো চকচক করে ওঠে সেহেরের। বুক ভর্তি জেগে ওঠে উচ্ছ্বাস। আলতো করে স্পর্শ করে সে রিংটা। তার কম্পিত স্পর্শে নওয়াজ বেশ অনুভব করতে পারে সেহেরের মায়ের স্মৃতির প্রতি এক সমুদ্র সমান উন্মাদনা। সেহের দুটো আঁখিতে ভরপুর খুশির ঝলকানি যা নওয়াজের কাছে স্পষ্ট ধরা পড়েছে। সেহের দ্রুত মায়ের রিং নিজের হাতের আঙ্গুলে পরে নিলো। তাতে যেন তার খুশির ডানা মেলে গেল। নওয়াজের ফট করে মনে হলো এ যেন এক বাচ্চা মেয়ে যার প্রিয় কোনো জিনিস হারানোর পর আবার ফিরে পাওয়ার আনন্দে দিশাহারা! সেহের সেই আংটিতে একটা চুমু দিয়ে মোলায়েম সুরে বলল,
"এখন আবার মনে হচ্ছে মা আমার হাতটা ধরে রেখেছে।"

নওয়াজ স্মিত হাসে। তারপর নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
"আপনার বাকি জিনিসগুলো নিলেন না যে!"

সেহের ফের নওয়াজের হাতের দিকে তাকায়। নওয়াজের হাতে সেহেরের আরেকটা রিং রয়েছে যেটা ডায়মন্ডের এবং বেশ দামী। এটাও হারিয়ে ফেলেছিল সেহের এক্সিডেন্টের পর যেটা নিয়ে সেহেরের খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না। তার উচ্ছ্বাস বিস্ময়ে পরিবর্তন হয় যখন সে নিজের পেন্ডেন্ট নওয়াজের হাতে দেখে। ওটা সেহের চট্টগ্রামেই অস্বীকার করে চলে এসেছিল। আজ নওয়াজ আবারও নিয়ে এসেছে? সেহের কোনো প্রশ্ন করবার আগেই নওয়াজ বলল,
"আমি জানি এটা আপনারই। তবে সেদিন মিথ্যা কেন বলেছিলেন আমি জানি না। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমায় ভয় পান না।"

সেহের তার পেন্ডেন্ট ও রিং নিয়ে দাঁড়ানো থেকে বসল। খোলা আকাশের পানে চেয়ে ভার গলায় বলল,
"আমি আমার মাকে ভীষণ মিস করছিলাম। তার ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য ছটফট করছিলাম। আমি জানি সে নেই কিন্তু তার জামাকাপড় আমি যত্ন করে রেখেছি। তার সব জিনিসে এতটুকু আঁচ আসতে দিইনি। আর এই রিং আমার মা পরে থাকত সবসময়। তাই এটা পরার মাধ্যমে তাকে অনুভব করি।"

কথাগুলো শুনতে শুনতে সেহেরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি বসল নওয়াজ। কেন বসল তার পাশাপাশি নওয়াজ নিজের মনকে প্রশ্নকে করে উত্তর পায় না। হয়ত সেহেরের কথাগুলো আরো কাছ থেকে শুনতে মন চাইছিল আর তার নিজেরও কিছু বলতে মন চাইছিল। সেহের তার পাশাপাশি নওয়াজের উপস্থিতি টের পেয়েও আজ রুদ্রমূর্তি ধারণ করল না। একেবারে নিস্ক্রিয় রইল। দুজনেরই দৃষ্টি কালো অম্বরে সীমাবদ্ধ যেখানে ঝিকিমিকি তাঁরা তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তাদের কর্ণকুহরে শুধু প্রবেশ করছে সেহের শান্ত কণ্ঠে শুধাল,
"আপনি সব ছেড়ে আমার জিনিস খুঁজলেন কেন? এত সামান্য কাজ করতে গেলেনই বা কেন?"

"আজ যেটুকু কাজ ছিল সব আমার সহযোগী সামলে নিয়েছে। দেশের কোনো উন্নতি কেন নেই সেটা আপনার দুর্ঘটনা থেকে বোঝা যায় মিস সেহের। আপনি রাস্তায় পড়ে ছিলেন আর বাকিরা আপনাকে সাহায্য করার নামে আপনার জিনিসপত্র চুরি করেছে। আপনার হাত থেকে রিং অবধি খুলে নিয়েছে। জানি না এসব আদেও ঠিক হবে কিনা।"

নওয়াজের কথা শেষে আবার তাদের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ রইল। কিন্তু নওয়াজের অন্তরে অবিচল রইল অস্থিরতা। তাদের সে দমাতে পারছে না। যদি তার অস্থিরতা শব্দ করতে পারত তাহলে সেই শব্দে কেউ টিকতে পারত না। নওয়াজের মনে চেপে রাখা কথা উগড়ে এলো।
"আপনার মনে আছে আমি বলেছিলাম আমার পারসোনাল রিজনে আমি আপনার মায়ের রিং খুঁজতে হেল্প করব?"

সেহের উত্তর না দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে শুধু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল। নওয়াজ সেই চাহনির জবাবে ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
"আমার কেউ নেই। আমি এতিম। আমি জানিও না আমার মা-বাবা কে! কখনো দুই চোখে দেখার ভাগ্যও হয়নি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নিজেকে এক অনাথ আশ্রমেই দেখে আসছি। জানি না মা-বাবার আদর-স্নেহ ঠিক কেমন হয়! তাদের ভালোবাসা পেলে ঠিক কেমন লাগে আমি কখনো সেসব বুঝিনি। আপনি মায়ের স্নেহ পেয়েছেন তাই মায়ের জিনিসের মূল্য আপনার কাছে অনেক বেশি। আপনার কাছে এখন মা না থাকলেও মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে রাখেন আমি সেটাও পাইনি। তাই অন্য একজনের মায়ের স্মৃতি খোঁজার জন্য আমি এতটা ডেস্পারেট হয়ে পড়েছিলাম।"

নওয়াজের বিষাদে ভরা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইল সেহের। আবছা আলোতে নওয়াজের জ্বলজ্বল করা লোচনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার পরিবার না থাকার যন্ত্রণা। মুখশ্রীতে যদিও সে কোনো কষ্টের ছাপ রাখেনি। সেহের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে একবার হেসে বলল,
"তাহলে আপনার আর আমার মাঝে একটা সিমিলারিটি পাওয়া গেল। আমাদের কারোর মা নেই।"

নওয়াজ ফের প্রশান্তিতে ভরা আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
"উঁহু, আপনার তো সৎমা আছে। বাবাও আছে। যদিও হয়ত আমি জানি সৎমা খুব একটা ভালো হয়না। তবুও..."

কথাটি শেষ করতে পারল না নওয়াজ। সেহের তেতে উঠে বলে,
"এমন সৎমা আর বাবা থাকার চেয়ে একা অনেক ভালো। আমার বাবা থেকেও নেই। আমি একা!"

সেহেরের এমন দাবি যেন গায়ে লাগে নওয়াজের। একা থাকার জ্বালা সে বোঝে। নিজের ঠোঁটে নিজে তর্জনী আঙ্গুল রেখে বলে উঠল,
"হুঁশশ, আপনি জানেনও না আপনি কী বলছেন। আপনার জন্য চিন্তা করার মানুষটাকে অবহেলা করবেন না। আমাকে দেখুন মিস সেহের। আমি মরে গেলেও আমায় নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার কেউ নেই। সেই দলে আপনি নাম লেখাতে চাইবেন না প্লিজ।"

সেহের হাসে। তার হাসিতে ভরপুর তাচ্ছিল্য প্রকাশ পায়। তার দুর্বল শরীরে হাসতে গিয়ে সামান্য দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। হাসি থামিয়ে দুর্বল কণ্ঠে বলে,
"আমাকে নিয়ে চিন্তা করা সেই বাবার অস্তিত্ব ততদিন ছিল যতদিন আমার মা বেঁচে ছিল। সেই বাবার অস্তিত্ব মুছে গেছে। কতটুকু জানেন আমার জীবন সম্পর্কে? আমাকে নিয়ে পরোয়া করার কেউ নেই। যদি সত্যিই থাকত আমি হসপিটালে জাস্ট দুটো অচেনা নার্সের সাথে একা পড়ে থাকতাম না। যেই বাবার কথা বলছেন তিনি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এই রাতে উনি একবারও আসবেন না। একা আমি পড়ে থাকব হসপিটালের বেডে।"

"সম্পর্কে অনেকসময় তিক্ততা চলে আসে। সেটা সময় মতো কমিয়ে আনতে হয়।"

সেহের কঠোর গলায় জবাব করল,
"আমি চাইনা কোনো তিক্ততা কমাতে। এই তিক্ততা, বিষাক্ততা আমার প্রিয়। এদেরকে প্রিয় বানিয়ে রাখা ভালো। এরা অন্য কাউকে আমার কাছে আসতে দেয়না। এরা আমার মনের চারিদিকে দেয়ালের মতো। যাকে ভেদ করে কেউ আসতে পারবে না।"

নওয়াজ কৌতূহলী নয়নে চেয়ে বলল,
"আর কেউ যদি কোনোদিন সেই দেয়াল ভেঙেচুরে আপনার মনকে ছুঁয়ে ফেলে তবে?"

সেহের দাঁতে দাঁত চেপে পাল্টা জবাবে বলল,
"ইম্পসিবল। কারণ ওখানে কোনো মনই নেই। মন বলতে কোনো জিনিস হয়না। তাই মন থেকে ভালোবাসা এটাও একটা মিথ। একারণে ভালোবাসা পুরোটাকেই মিথ মনে হয় আমার।"

নওয়াজ সামান্য হেসে বলে,
"মস্তিষ্ক যদি কাউকে একবার গেঁথে নেয় তাহলে কী হয়? মস্তিষ্ক তো তাহলে সবচেয়ে বড়ো ধোঁকাবাজ। সে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পছন্দ করে তার দোষ দেয় বেচারা মনের উপর। দিস ইজ নট ফেয়ার।"

সেহেরের হাসির শব্দ পায় নওয়াজ। হাস্যোজ্জ্বল সুন্দরী রমনীর পানে তাকায় সে। খুব সাধারণ বেশে এক নারী। রোগীর পোশাক, লম্বা চুলের এলোমেলো বিনুনি মাটি থেকে মাত্র কিছুটা উপরে ঝুলছে। মেয়েটা সেই হাসিতে সবসময়ের মতো অহমিকা, পৈশাচিকতা নেই। একখানা শুদ্ধ হাসিতে বোধহয় খারাপ লাগে না এই নারীকে। তৎক্ষনাৎ চোখ সরায় সেহের। মিনিট দুয়েক তাদের কথোপকথন বন্ধ থাকে। সেহের হুট করে বলে ফেলে,
"থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ।"

"ফর হোয়াট?"

"আমাকে সকলের স্পর্শ থেকে দূরে রাখার জন্য।"

নওয়াজ নির্লিপ্তে স্বীকার করল,
"কিন্তু আমি তো স্পর্শ করেছি।"

সেহেরের মাঝে কোনো ক্রোধের রেশ দেখা গেল না। সে সোজাসাপটা মনে আওড়ালো,
"ইয়েস, ইউ টাচড্। আমি ভেবেছিলাম অনেক রাগ দেখাব কিন্তু আপনার সেই স্পর্শে কোনো ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা ছিল না।"

"ডু ইউ ওয়ান্ট টু পানিশ মি ফর দিস?"

সেহের শুধু মুচকি হাসল। সেই প্রসঙ্গে আর কিছুই বলল না। কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল,
"থ্যাংক ইউ ওয়ান্স এগেইন।"

নওয়াজ প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকাতেই সেহের উত্তর দিলো,
"আমার আর মায়ের জিনিস আমার কাছে ফেরত আনার জন্য।"

নওয়াজ ঠোঁট হেসে ব্যঙ্গ করে বলে,
"আপনার মতো মানুষের থেকে এতগুলো থ্যাংক ইউ পেলে সেই লোড নেওয়া তো মুশকিল হয়ে যাবে।"

সেহের চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ফোঁসফোঁস করে বলল,
"এজন্য আমি মানুষের সাথে ভালো হইনা। আমার ভালোটা কেউ সহ্য করতে পারেনা।"

নওয়াজ বিদ্রুপের সহিত বলল,
"ওহ হো! সো স্যাড।"

মুখ ঘুরিয়ে নিজের পেন্ডেন্ট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল সেহের। এই পেন্ডেন্ট তার নিজস্ব পছন্দের ছিল। তবে তার মায়ের চেয়ে বেশি পছন্দের নয়। পেন্ডেন্ট গলায় পরে নিলো সেহের। হালকা বাতাসের তোড়ে দুর্বল শরীর আরামে আরো নেতিয়ে পড়তে চাইছে। ঘুমের ইনজেকশনের প্রভাব বোধহয় এখনো শেষ হয়নি। চোখ দুটো বুঁজে আসতেই রেলিং-এ হাত রেখে হাতের উপর মাথা রাখল সে। ঘুম জড়ানো গলায় বলতে থাকল,
"জানেন, আজ এক্সিডেন্টের পর সেন্সলেস যখন ছিলাম তখন আমার স্বপ্নে আমার মা এসেছিল। তবে আমার আর আমার মায়ের মধ্যে একটা দূরত্ব ছিল। সেই দূরত্ব মিটিয়ে আমি মায়ের কাছে যেতে চাইছিলাম। মা আমায় বলল, আমি তোকে নিতে আসিনি। তোর আমার সাথে যাওয়ার সময় আসেনি। তুই যেখানে আছিস থাক। ভালো থাক। এটা শোনার পর আমি খুব কষ্ট পেলাম। কিন্তু মা তবুও চলে গেল। আমাকে নিয়ে গেলে কী ক্ষতি হতো?"

সেহেরের শেষ কথাতেই আঁটকে গেল তার যাতনা। নওয়াজ থমকে বসে রইল খানিকক্ষণ। থেমে থেমে বলল,
"আপনার আর আপনার মায়ের দূরত্বটা সেখানে যতটা কম মনে হয়েছিল হয়ত তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল সেই দূরত্ব। আর উনি তো বলে দিলেন আপনার সময় হয়নি যাওয়ার।"

সেহের ভারি নিশ্বাস ছাড়ল। সেই নিশ্বাসে শূন্য করার চেষ্টা করল তার অন্তরে মিশে থাকা সমস্ত ভার। চোখ বুঁজেই এবার কঠোর জবান খুলল সে। কাঠকাঠ গলায় বলে দিলো,
"এইযে শুনুন, আমার আজকের কথাগুলো শুনে আমার প্রতি একটুও সহানুভূতি দেখাবেন না। এতটুকু সময়ের জন্য আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কিন্তু আমি কিন্তু ভুলে যাইনি আমার সঙ্গে আমার শত্রুতা। আই জাস্ট হেইট ইউ মিস্টার এসপি!"

নওয়াজের ঠোঁটে দেখা গেল সূক্ষ্ম হাসি। একপলক সেহেরের দিকে চেয়ে বলল,
"আই নো মিস ইনোসেন্ট। আপনি আকাশ হলে আমি পাতাল। আর আমাদের এই শত্রুতা শেষ হওয়ার নয়। অ্যান্ড আই অ্যাম ইনজয়িং ইট।"

নওয়াজের কথা সমাপ্তের পর শান্ত হলো পরিবেশ। সেহেরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভালো করে পরখ করল নওয়াজ। মেয়েটা রেলিং-এ হাত রেখে মাথা দিয়েই সিটে বসে বসে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছে। নওয়াজ তাকে ডাকতে চেয়েও পারল না। কিছুক্ষণ বসে সময় কাটালো সে। রাত বাড়তে থাকলে বাধ্য হয়েই সে সেহেরকে ধীর কণ্ঠে ডাকল।
"মিস সেহের! আপনার ঘুম পেলে নিচে চলুন।"

সেহের নড়েচড়ে উঠে বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে ঘুমের মাঝেই বলল,
"আর একটু মা প্লিজ!"

স্থবির হয়ে গেল নওয়াজ। সেহের কি ফের মায়ের স্বপ্ন দেখছে? মায়ের একটা মেয়ের যে কিনা সজ্ঞানে, স্বপ্নে সবসময় নিজের মাকে ছাড়া কিছু বোঝে না তার পক্ষে বাস্তব জীবনে মাকে ছাড়া থাকা কতটা কঠিন? সেটা অনুভব করার প্রচেষ্টা করে নওয়াজ। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ করে নিরুপায় হয়ে সেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
"মিস সেহের! উঠে পড়ুন ম্যাডাম।"

সামান্য উচ্চ স্বরে চোখ মেলে তাকায় সেহের। আশেপাশে দেখে নিজেকে সেই বিরক্তিকর হসপিটালের ছাঁদে আবিষ্কার করেই চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। সোজা হয়ে বসে চোখ ডলতে থাকলে নওয়াজ জানায়,
"ঘুম ধরলে নিচে চলুন।"

সেহের টলমল করে কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। ঘুমটা ঝেঁকে এসেছে চোখে। দুই ধাপ দিতে গেলেই তার এলোমেলো পায়ের চলনে দুটো হাত ধরে ফেলে নওয়াজ। সেহের তৎক্ষনাৎ ক্ষিপ্র হয়ে হাত সরিয়ে বলে,
"ডোন্ট বি সো নাইস টু মি। আন্ডারস্ট্যান্ড?"

নওয়াজ তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে মেয়েটার চলা দেখল। নিজেও তার সাথে সাথে সিঁড়ি অবধি গেল। সেখানে একটা লিফট আছে। নওয়াজ নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
"আই এম নট বিং নাইস টু ইউ। আমি শুধু একটা পেশেন্টের হেল্প করছি। ইটস মাই রেসপনসেবলিটি।"

সেহেরের মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটল না। লিফটের দরজা খুলে গেলে দুজনেই ঢুকল ভেতরে। নওয়াজ পুরোটা সময় আঁড়চোখে সেহেরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গেল। সেহের বারবার চোখ খুলে টানটান করে মেলে থাকা চেষ্টা করছে। স্থির হয়ে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে। একসময় নওয়াজ অধৈর্য হয়ে সেহেরের হাতটা ধরে তার নিজের বাহু ধরিয়ে দিয়ে বলল,
"আমার স্পর্শে নাকি ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা নেই। তবুও কেন এত জেদ? আমায় ধরে থাকুন। জাস্ট কয়েক সেকেণ্ডে আপনাকে কেবিনে দিয়ে আসব।"

নওয়াজের অদ্ভুত ধরনের কথার জোরে আর হাত সরালো না সেহের। ধরে থাকল নওয়াজের পেশিবহুল শক্ত বাহু। জীবনে প্রথমবার বোধহয় এভাবে কোনো পুরুষকে স্পর্শ করতে হয়েছে তাকে। যার কারণে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলেও স্বস্তি পাচ্ছে না সে। এলোমেলো খেলা করছে মস্তিষ্ক। লিফটের গতিকে দুনিয়ার সবচেয়ে ধীর মনে হচ্ছে। নওয়াজ নিজেও দাঁতে দাঁত চেপে একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এমন নারী স্পর্শে কান গরম হচ্ছে তার। মনে মনে চাইছে যেন খুব দ্রুত কাঙ্ক্ষিত স্থান অবধি যেতে পারে! নারী স্পর্শ এত জটিল অনুভূতি দেয় নাকি? এতটা বিপদজনকও হয় যে মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে যায়?

চলবে...

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আজ তিনদিন যাবত আমার বৃদ্ধা আঙ্গুলে ব্যথা। আঘাত পেয়েছি বাজেভাবে। যার কারণে টাইপিং করতে হচ্ছিল খুবই ধীর গতিতে। তাই গল্প দিতে চেয়েও হয়নি।]

21/09/2025

"রুমডেট করেছো কবার?"

হবু ননাশের মুখে প্রশ্নটা স্পষ্টভাবে শোনার পরো রুম্পা চুপ! সে আগের মতোই দৃষ্টি নিচের দিকে আটকে রেখেছে, শান্ত, নিশ্চুপ ও নির্বিকার। কিন্তু ভেতরটা সহসাই দুমড়ে মুচড়ে গেলো তার। অপমানে হৃদপিন্ডটা তার স্বাভাবিক ছন্দে গরমিল করে ফেললো।

উত্তর না পেয়ে তাই রিমা পুনরায় তাকে প্রশ্ন করলো, তবে কড়া স্বরে,

" বুঝো নাই মেয়ে? মানে হলো.... দুজনে মিলে কোনো বন্ধুর ফ্ল্যাটে ক'বার ডেটে গিয়েছিলে?"

রুম্পার সাথে রিমার এই প্রথম দেখা আর প্রথম কথা, আর প্রথম কথাতেই প্রথম প্রশ্নটা এরকম হতে পারে তা রুম্পার কাছে চিন্তারো অতীত ছিলো। রুম্পার নিকটে এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেয়ে মাটির নিচে চলে যাওয়া সহজ। তাই অষ্টাদশী রূম্পা পূর্বের ন্যায় নিচের দিকেই তাকিয়ে রইলো। এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর করার মতো ম্যাচুরিটি যে তার হয়নি!
দুই বছরের সম্পর্কে পার্কে বা রেস্টুরেন্টে বসে সামান্য অনুভূতির অন্বেষণ হয়েছে বটে দুজনার
মধ্যে। কিন্তু রুমডেট! এ বিষয়টি দুজনের একজনের মাথায়ও তো আসেনি কোনোদিন।

" আমার বড় বোন তোমাকে দেখতে চায়, রূম্পা।

সাহেদ এ প্রশ্ন করাতে রূম্পা সেদিন লাজুক হেসে স্বভাবজাত চঞ্চলস্বরে বলেছিল,

" কেনো? কেনো?"

সাহেদ কলেজ ড্রেস পরিহিতা রুম্পার একটা বিনুনী ধরে টান দিয়ে বলেছিলো,

" ছোটো ভাইয়ের পছন্দের মেয়েটা কেমন দুষ্টু তা দেখার বড্ড সাধ জেগেছে যে ওর!"

রূম্পা তার বিনুনী ছাড়াতে ছাড়াতে বলেছিলো,

" ও..আচ্ছা! আচ্ছা! আমি দুষ্ট ;তাই বুঝি? আপনার বয়স বেশি বলে আমাকে দুষ্ট মনে হয়। তাছাড়া আমার বয়সে মেয়েরা এরকম করেই থাকে। আমি বলে দেবো তাকে আপনার ভাই আমার সাথে জোর করে প্রেম করে! "

আর প্রত্তুত্তরে সাহেদ বলেছিলো,

" আর একটা দুষ্ট পাগলি যে জোর জবরদস্তি আমার মন নিয়ে ছিঁনিমিনি খেলছে, সেটাও আমার বোনকে আমি বলে দেবো!"

সাহেদ আর রুম্পার সাথে এরকমই খুনসুঁটিময় কিছু কথাবার্তা হয়েছিলো সেদিন।
রুম্পা ভেবেছিলো সাহেদের সাথে তার বোন রিমার ভীষণই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
কিন্তু আজ দেখতে পেলো ভিন্নচিত্র।
শাহেদের প্রতি তার ভীষণই রাগ হলো।
শাহেদ নিশ্চয় তাদের সম্পর্ক নিয়ে এমন কিছু তার বোনকে বলেছে যে তার বোন এহেন প্রশ্ন করতে পারে!

চাকচিক্যময় একটা লাইট জ্বলছে রেস্টুরেন্টে। এই গরমেও যেনো স্নো ফল করছে এরকম একটা এনভারনমেন্ট সৃষ্টি করতে চেয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে রূম্পা ঘামছে। একটা সেপারেট চেম্বারে রূম্পা আর রিমা বসেছে। রুম্পার চেয়ে রিমা বছর পাঁচেক বড় হতে পারে। কিন্তু রিমার চেহারা দেখে তা বুঝার উপায় নাই। নিঁখুত সুন্দরী যাকে বলে সে তেমনি দেখতে। কাপড়, চোপড়, চেহারায় আভিজাত্যের পূর্ণ ছাপ! কিন্তু এখন সে বলে বসলো,

" কিছু মনে না করলে একটু তোমাকে ব্যাক সাইড হতে দেখতে পারি? আই মিন তোমার বাটক( নিতম্ব) দেখতে পারি?"

একথা বলেই রিমা এবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রুম্পাকে দেখতে লাগলো।

তারপর মিনমিনে স্বরে বললো,

" পুরুষ মানুষের জাত খা'রাপ। শুধু সামনের হেড লাইট আর ব্যাক লাইট ভালো হলেই হলো। মুখ সাদা ফুরফুরা হলেও ঘাড় আর হাত পা যে কালো সেটা দেখে নি ও। "

রূম্পা বুঝতে পারলো যে, সে বডি শেমিং এর স্বীকার হচ্ছে। একথা শুনে রূম্পা প্রায় কেঁদেই দিলো। তবে তা সংবরন করা ছাড়া উপায় ছিলো না।

ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। তথাপি রূম্পা কিছুই খেতে পারলো না। শুধু একটা মোমোস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো।

যাওয়ার আগে রিমা হেসে রুম্পাকে বললো,

" বড় লাজুক মেয়ে তুমি দেখছি, অথচ সাহেদের ফোনের একটা ভিডিওতে দেখেছিলাম, কি চঞ্চলতাই না করছো! যাক গে আশা করি একটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট হাদারাম বর পেতে চলছো। তার পরো জিতে যাচ্ছো, বর ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার! এমন ছেলে তো কোটি টাকাতেও পায় না অনেকে। ভালো থেকো, খুব দ্রুতই বিয়ে করে ফেলতে চায় আমাদের বিয়ে পাগলাটা! আমাদের তো আর ঘটক নেই, তোমার সাথেই কথা হবে বিয়ে নিয়ে।! ওকে! আসি। তাহলে?"

বলেই রুম্পার প্রত্তুত্তরের অপেক্ষা না করেই হনহন করে গাড়িতে উঠে বসলো রিমা।

বড়লোক বর রিমার। দামী পোশাক পরিচ্ছদ ও গাড়ি, তবে ব্যবহারের শ্রি এত কমদামের তা ভেবেই রুম্পার একটা দ্বীর্ঘশ্বাস পড়লো।

রুম্পার সবচেয়ে বেশি অভিমান হলো সাহেদের প্রতি। তবে ঘটনা খুলে বলতেই সাহেদ বলে বসল,

" সংসার তো তুমি করবে আমার সাথে, নাকি আমার বোনের সাথে? সুতরাং আমার বোনের কথায় এত শত কান্নাকাটি করার কি আছে?"

একথা শুনে রুম্পার কান্নার বেগ তো কমলোই না বরং আরো বাড়লো।

সাহেদ আবার বুঝালো তাকে,

" জানো না তো রিমাকে যখন পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো তখন কত কি আরো জিজ্ঞেস করেছে? ও ভার্জিন কিনা? কয়টা প্রেম করেছে? এমনকি প্রায় সারা শরীর ই দেখে নিয়েছিলো আর ইত্যাদি আরো নানা প্রশ্ন। তোমাকে তো অল্পেই রক্ষে করে গেল ও। বাড়ির সবাইকে ও বলেছে তোমাকে ওর ভীষণই পছন্দ হয়েছে, আর আমাদের বাড়িতে ওর পছন্দ মানেই সবার পছন্দ। আর কেউ তোমাকে দেখতেও আসবে না। শুধু একটা ছবি দেখিয়েছি মাত্র। সবাই ওর সুরে সুর মিলিয়ে বলেছে, মেয়ে মাশাল্লাহ!"

রুম্পার এইচ এস সি র রেজাল্টের পর হঠাৎ ই ঘটা করে এংগেইজমেন্টের প্রস্তাব দিলো সাহেদের পরিবার।

সাহেদ এস্টাবলিশ ছেলে, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পরিবারের মানুষজন সামান্য একটু খিটখিটে মেজাজের হলে কি হবে? ছেলেটা শান্ত, শিষ্ট ও ভদ্র।

রুম্পার বাবা, চাচারা মহা ধূমধামে এংগেইজমেন্টের আয়োজন করতে থাকে।
সাহেদদের জ্ঞাতি গোষ্টি থেকে প্রায় একশত জিন অতিথি উপস্থিত থাকা পূর্বক এংগেইজমেন্ট হয়। রুম্পাদের বাড়ি থেকে দশ ভরি গহনা দেওয়া হবে রুম্পাকে ঠিক করা হলো। স্বর্ণকার এসে ওর গোলগোল হাতগুলোর চুড়ি, আংটির মাপ নিয়ে গেলো। ডিজাইনও পছন্দ করানো হলো বই দেখে দেখে।
রুম্পাকে দেওয়ার জন্য খাট, ডায়নিং টেবিল, সোফা, আলমারি, ওয়ারড্রব ইত্যাদি বানানোর জন্য অর্ডার দিলেন রুম্পার বাবা।

রূম্পা আর সাহেদ দুজনেরই খুশির অন্ত নেই। ভালোবাসার মানুষটিকে এভাবে বিনা বাধায় পাওয়ার চেয়ে আনন্দের আর কি আছে?
রুম্পাদের বাড়ির মানুষদের বিয়ে নিয়ে ভাবনা চিন্তার অন্ত নেই। এটা কেনা, সেটা কেনা। সব কেনাকাটার লিস্ট একের পর এক সাঙ্গ করতে লাগলো তারা।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এলো।
নিজেকে প্রিয় মানুষটির বঁধু বেশে দেখে খুশিরা বাঁধ ভাঙ্গলো রুম্পার।
কিন্তু যেখানে বিয়ের ভোজ চলছিলো সেদিকে অকস্মাৎ হট্টগোল দেখে পিলে চমকালো রুম্পার।
কম্পিত বক্ষে বড় বোনকে জিজ্ঞেস করলো

"ঘটনা কি ?"

উত্তর পেলো, আড়াইশ জন আসার কথা থাকলেও ওরা এসেছে তিনশ জনেরও অধিক। তাই আমন্ত্রিত অতিথিদের মাঝে গরুর গোশ আর রোস্ট কিছু কম পড়েছে দেখে এমন বিশৃঙ্খল চেঁচামেচি চলছে।

একজন তো এসে নাম ধাম পরিচয় না সেরেই গটগট করে বলে ফেললো,

" শুনলাম! কনে নিজেই নাকি ঘটক? প্রেম পীরিতী করার বেলায় তো এক্সপার্ট ভালোই ছিলো। তো নিজের পরিবারকে ঠিকমতো জানাতেও পারলো না যে, তিনশ লোক আসবে, আড়াইশ নয়! পঞ্চাশ জনের রোস্ট আর গরুর গোশ শর্ট পড়েছে! এটা কি যাচ্ছে তাই অপমান! আমরা কি আর কোনোদিন খেতে আসবো এই বাড়ি? এই প্রথম এই শেষ! দারুন অপমান করলেন আপনি ও আপনার পরিবার! "

এসব শুনে রুম্পার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো অবিরত। অপমানে বিদ্ধস্ত হলো তার হৃদপিন্ড।
খাবার ঠিকমতো না পেয়ে ভীড়ের মধ্যে কেউ কেউ অকথ্য বলেও চেঁচামেচি করলো।

কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলেও সত্য সাহেদ এসবের বিন্দুমাত্র প্রতিবাদও করলো না।
রুম্পার বাবা চাচারা নিজেদের সাধ্যমতো বুঝানোর চেষ্ঠা করলো অতিথিদের। অবশেষে তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়িয়ে রুম্পাকে নিয়ে বিদায় হলো তারা।

গাড়িতেও এসব নিয়ে বহু কটু কথা শোনানো হলো রুম্পাকে।
কিন্তু তার কিছুই বলার ভাষা নেই। আর না আছে কোনো প্রতিবাদের ভাষা।
চুপচাপ চোখের পানি মুছে সে শ্বসুর বাড়ি চললো। সাহেদ আলগোছে রুম্পার হাত চেপে ধরলো। কিন্তু সে বুঝলো না রুম্পার মনের ভাষা।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শুধু রুম্পার বিয়ে নয়, অসংখ্য বিয়ে বাড়ির নিত্য দিনকার পরিস্থিতি এরুপ ঘটনা। ঠিক বিয়ের মুহূর্তে এসবের কারনে কনে বেশে বসে থাকা নারীটির মনের ভেতরে কি চলে তা কারো গোচর হওয়ার কথা নয়।
আর অবশেষে বলি, বিয়ের আসরে এরুপ হেনস্তার প্রতিকার কি আদৌ জানা আছে আমাদের নারীদের?

----------------------সমাপ্ত----_---------------

অনুগল্প

#বিবাহ_প্রহসন

রচনায়

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

20/09/2025

-"দেখো স্নেহা,তোমার সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"

সায়নের কথায় চোয়াল শক্ত হয় স্নেহার।সে রেগে বলে ওঠে,
-"পরকিয়া করলে কি আর ঘরের বউকে কারো ভালোলাগে? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো সায়ন আমি তোমায় ছাড়বো না।নিজের অধিকার আমি বুঝে নিতে জানি।একটা থার্ডক্লাস মেয়ের জন্য তুমি আমায় ছেড়ে দেবে তা আমি কিছুতেই মেনে নেব না।"

সায়ন ও এবার রেগে যায়।উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে,
-"তুমি কাকে থার্ড ক্লাস বলছো হ্যাঁ? তোমার নিজের কি ক্লাস?ক্লাসলেস মেয়ে একটা।মুখের ভাষা ঠিক করো,নিজেকে সংযত করতে না পারলে আমার সংসারে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার।"

-"আমার ব্যবহার যথেষ্ট ভালো,তোমার মতো।পুরুষের সাথে এভাবে কথা বলাটাও যথেষ্ট ভদ্রতা।পরকিয়া করছো তো করছো তাও কার সাথে!নিজের প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে!"

-"ওর সাথেই আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো।মাঝখান থেকে তুমি আর তোমার মা আমাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি টা ক্রিয়েট না করলে আজ আমাদের সুখের সংসার হতো।"

সায়নের কথায় চমকে যায় স্নেহা।তুতলিয়ে বলে ওঠে,

-"কি করেছি আমি আর আমার মা?"

-"কি করেছো?কি করোনি সেটা বলো?আমার আর মাধবী র বিয়েটা তুমি আর তোমার মা ভেঙ্গেছ।মাধবীর বাবার কাছে গিয়ে তুমি বলেছো আমি নাকি তোমাকে বিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়েছি আর তুমি অন্তঃস্বত্ত্বা!আমায় এসে মাধবীর সাথে অন্য ছেলেদের ঘনিষ্ঠ ছবি দেখিয়েছো!এসব মিথ্যে?"

-"বাজে কথা বলবেনা সায়ন।নিজের দোষ ঢাকতে আমায় এখন দোষারোপ করছো তুমি।"

-"আমার কোনো দোষ নেই স্নেহা।তুমি নিজেই মনগড়া কথা বানিয়েছো।এমনকি আমার মায়ের কাছে অবধি বলেছো আমি পরকিয়া করি।তারপরও তোমার সাথে থাকা সম্ভব?"

-"যা সত্যি তা-ই বলেছি আমি।তুমি একটা ঠক,প্রতারক।"

-"আর তুমি সাধু?দেখ স্নেহা,আমার কোনো বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নেই।মাধবী আমার কাছে এসেছিলো সত্যিটা জানতে আর থ্যাংক গড ও এসেছিলো নাহলে আমি জানতেই পারতাম না তুমি এতো বড় গেইম প্লে করেছো।"

-"আমি কিছুই করিনি।তুমি একটা চরিত্রহীন, লম্পট।"

স্নেহা নিজের দোষ স্বীকার করতে নারাজ আর সায়ন ও নিজের উপর মিথ্যে অপবাদ কিছুতেই মেনে নিবে না।ফলস্বরুপ দু'জনের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়।এক পর্যায়ে স্নেহা সায়নের মা-কে ভীষণ কুরুচিপূর্ণ গালি দয়ে উঠলে সায়ন সপাটে চড় মারে স্নেহার গালে।

-"ছোটোলোকের বাচ্চা,তোর সাহস কি করে হয় আমার গায়ে হাত তোলার?"

-"তুই আমার মা তুলে গালি দিস আমি কি চুপ করে থাকবো?এই মূহুর্তে আমার বাড়ি থেকে তুই বেরিয়ে যাবি তুই;অসভ্য মেয়ে মানুষ।"

সায়নের কথায় স্নেহা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের ঘরে গিয়ে লাগেজে সব প্রয়োজনীয় জিনিস ভরে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

সায়ন সোফায় বসে দু'হাতে নিজের চুলগুলো টেনে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।

স্নেহা,সায়ন আর মাধবী একই সাথে একই ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিলো।মাধবী আর সায়নের প্রণয়ের সম্পর্ক ভার্সিটি লাইফের শুরু থেকেই।তবে স্নেহা যে সায়নকে পছন্দ করে তা সায়ন কখনো টের পায়নি।সে স্নেহাকে নিজের ভালো বন্ধু হিসেবেই দেখেছে।গ্রাজুয়েশন শেষ করে অর্ণব নিজের ফ্যামিলি বিজনেসে যোগ দেয়।মাধবীর বাবা মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করলে মাধবী বাড়িতে সায়নের কথা জানায়।সায়নকে মাধবীর পরিবার আগে থেকেই চিনতো তবে মাধবীর বয়ফ্রেন্ড হিসেবে নয় ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড হিসেবে।

সায়ন তার মা-বাবাকে নিয়ে মাধবীদের বাড়ি গেলে সায়নের পরিবারের মাধবীকে ভীষণ পছন্দ হয়।আর মাধবীর পরিবারও সায়নের পরিবারকে ভীষণ পছন্দ করে।আনুষঙ্গিক সব কিছু ঠিকঠাক থাকায় বিয়ের দিনক্ষণ ও পাকা হয়ে যায়।
এরই মধ্যে একদিন স্নেহা সায়নের সাথে দেখা করতে চায়।সায়ন রাজি হলে দু'জন একটা ক্যাফেতে দেখা করে।স্নেহা সায়নকে মাধবীর অন্য ছেলের সাথে কিছু আপত্তিকর ছবি দেখায়।সায়ন এসব বিশ্বাস করতে চায়না।তখনি স্নেহা বলে ওঠে,

-"দেখিস আজই মাধবী তোকে কল করবে আর তোর উপর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে বিয়েটা ভাঙ্গতে চাইবে।"

সায়ন স্নেহার কথায় বেশ বিরক্তবোধ করে।সে কাজের বাহানা করে চলে আসে ক্যাফে থেকে।আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিন রাতেই মাধবী সায়নকে ফোন দিয়ে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করা শুরু করে।সায়ন আর মাধবীর তুমুল ঝগড়া হয়।দু'জন দু'জনকে সব যায়গা থেকে ব্লক করে দেয়।মাধবীর বাবা সায়নের বাবাকে কল করে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়।

সায়ন তখন মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পড়ে।আর সেই সুযোগটাই নেয় স্নেহা।সে সায়নের আশে-পাশে থাকা শুরু করে বেশিরভাগ সময়।সায়নের মায়ের সাথেও তার বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে।এক পর্যায়ে সায়নের মা স্নেহার বাবার কাছে সায়ন আর স্নেহার বিয়ের প্রোপোজাল রাখে।সায়ন ভালো ছেলে,নিজেদের ব্যবসা আছে, ভালো বংশ সব দিক বিবেচনা করে স্নেহার বাবাও বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।সায়ন নিজের মেন্টাল ব্রেকডাউনে সবথেকে বেশি সাপোর্ট পেয়েছিলো স্নেহার থেকে।তাই সেও স্নেহাকে বিয়ে করতে রাজি হয়।

বিয়ের প্রথম ছয়মাস সব ঠিক চললেও আস্তে আস্তে স্নেহা নিজের আসল রূপ দেখাতে শুরু করে।সায়নের মায়ের সাথে অকারণে খারাপ ব্যবহার করা,একই বাড়িতে শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে থাকা নিয়ে সায়নের সাথে ঝামেলা করা!এমন আরো অনেক কিছু।সায়নের মা-বাবা বিচক্ষণ মানুষ।ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছে দেখে তারা অন্য ফ্ল্যাটে শিফট করেন।এরপর স্নেহার ব্যবহার আগের তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

সকালে অফিসে কাজ করার সময় আননোন নাম্বার থেকে কল পায় সায়ন।কল রিসিভ করলে ওপাশ থেকে জানান দেয় সে মাধবী আর সায়নের সাথে তার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
সায়ন প্রথমে রাজি হয়না,কারণ সে বিবাহিত।আর প্রাক্তনের সাথে বিবাহিত পুরুষের মেলামেশা ভালো দেখায় না।তবুও মাধবীর বার বার বলার কারণে রাজি হয় সায়ন।একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

মাধবীর সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা হলে মাধবী সব সত্যি খুলে বলে।স্নেহা আর তার মা মাধবী আর তার পরিবারের কাছে বলেছিলো স্নেহার বার্থডে পার্টিতে সায়ন ড্রিংক করে স্নেহার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে আর স্নেহা এখন প্রেগন্যান্ট। এমনকি ভুয়া প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট ও দেখিয়েছিলো তাদের।
মাধবী সেবার স্নেহার বার্থডে পার্টিতে যেতে পারেনি কারণ তার মামা অসুস্থ থাকায় মাধবীরা সপরিবারে তার মামা বাড়ি গিয়েছিলো।তাই সেদিন পার্টিতে কি হয়েছে এটা মাধবী নিজেও জানেনা।তবে কয়েকজন বন্ধুর থেকে শুনেছিলো ওইদিন নাকি সবাই একটু-আধটু ড্রিংক করেছিলো ইভেন ওরা রাতে বাড়ি ও ফেরেনি, পরদিন ভোরে বাড়ি ফিরেছিল।
এসব কিছুকেই মাধবী দুই-দুই চার করে সায়নের সাথে সম্পর্কের ইতি টানে।তবে কয়েকদিন আগে যখন স্নেহাকে শপিংমলে দেখে তখন মাধবী বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করলে স্নেহা মাধবীকে চিনতেই অস্বীকার করে।
মাধবীর বিষয়টা খটকা লাগলে সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে স্নেহার কোনো বাচ্চা নেই,এমনকি সে এখনো একবারো প্রেগন্যান্ট ই হয়নি!

মাধবীর মনে হয়ে হয়েছিলো সায়নকে সবটা জানানো প্রয়োজন।তাই সায়নের নাম্বার জোগাড় করে সায়নের সাথে দেখা করে মাধবী।
সায়নও সেদিন তাকে বলা স্নেহার সব কথা মাধবীকে বলে দেয়।সব কিছু বলার পর দু'জনেই বুঝতে পারে এটা স্নেহা আর তার মায়ের চক্রান্ত।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে স্নেহাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই স্নেহা সায়নের সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়।আসলে স্নেহা ও বাইরে গেছিলো,সায়ন আর মাধবীকে একসাথে দেখে সে মনে করে সায়ন তাকে প্রতারণা করছে।
অত:পর এই ঝগড়া এবং স্নেহার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া।

কারো ফোন পেয়ে সায়ন অতীত থেকে বেরিয়ে আসে।ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সায়নের বন্ধু রকি একটা বিস্ফোরক সংবাদ দেয়।যা শুনে সায়নের মাথা ঘুরে ওঠার উপক্রম হয়।

বাড়ির সামনে রিকশা থামলে স্নেহা দেখে বাড়ির সামনে অনেক লোকের সমাগম।সে ভাড়া মিটিয়ে ভীর ঠেলে ভিতরে ঢুকলে দেখে তার বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।পাশেই তার মা বসা;শরীরের কাপড়টা এলোমেলো হয়ে আছে।আর তার মায়ের পাশেই তার বাবার বন্ধু সজিব।তার পড়নে শুধুই একটা হাফপ্যান্ট।

-"কি হয়েছে এখানে?এভাবে সবাই দাঁড়িয়ে আছেন কেন?আর মা?বাবা?সজিব আংকেল?এই অবস্থা কেন আপনাদের?"

স্নেহার বাবা রাগে ফুঁসছেন কিছু উত্তর করলেন না।তবে উপস্থিত উৎসুক জনতার মধ্যে একজন বলে উঠলেন,

-"তোমার মা আর এই সজিব তোমার বাবা বাড়ি না থাকাকালীন অনৈতিক কাজ করছিলো।তোমাদের সাহায্যকর্মী মুক্তা জানালা দিয়ে এসব দেখে এলাকার সবাইকে ডেকে এনেছে।তোমার বাবাকে খবর দেওয়ার পর তিনি এসে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেছে।একদম হাতেনাতে ধরা পরেছে দু'জন।"

অন্য একজন বলে উঠলেন,

-"এই বয়সেও এতো নোংরা কাজ করার চিন্তা মাথায় আসে কি করে এদের?মেয়ে বড় হয়েছে,বিয়ে দিয়ে দিয়েছে মেয়ের তাও শরীরের জ্বালা দেখো!সমাজ নষ্টকারী কিট কতগুলো।"

আশেপাশের লোকেদের কথায় থ হয়ে গেছে স্নেহা।মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছেনা তার।স্নেহা নিজের ব্যাগটা রেখে ধীর পায়ে তার বাবার কাছে এগিয়ে গেলো।

-"এসব কি বাবা?মা সত্যিই এসব করেছে?"

স্নেহার বাবা স্নেহার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে,

-"এসব কি?এসব আমার পাপের ফল রে মা!একটা নিষ্পাপ ফুল আর কলিকে মূর্ছে দেওয়ার পাপের শাস্তি এটা।"

স্নেহার বোধগম্য হয়না তার বাবার কথা।সে তার মায়ের কাছে গিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে,

-"এ সংসারে কিসের কমতি ছিলো মা?যে তোমার পরকিয়া করতে হলো!"

স্নেহার মা কিছু বলতে পারেনা।মাথা নিচু করে আছে শুধু।ঘন্টা খানেক পর স্নেহারদের বাড়িতে ওই এলাকার গণ্যমান্য লোকেরা শালিস বসালেন।

-"এটা একটা ভদ্র পাড়া।আজ অবধি এখানে এমন নিচু কাজ করার মতো সাহস কেউ পায়নি।"

সারোয়ার সাহেবের কথায় সবাই সায় দিলেন।পাশ থেকে একজন বয়স্ক লোক বলে উঠলেন,

-"পরকিয়ার মতো জঘন্য পাপের শাস্তি হিন্দু ধর্ম মতে আমার জানা নেই।এটা আমাদের সুব্রত দাদাই ভালো বলতে পারবেন।"

-"দেখুন,পরকিয়া করে ওনারা যেই পাপ করেছেন তাতে এর উপযুক্ত শাস্তি যে ধর্মীয় মতে কি হতে পারে তা নিয়ে আমি নিজেও সন্দিহান।তবে সমাজ বাঁচাতে হলে এমন লোকেদের বিতাড়িত করা বা একঘরে করে দেওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে বলে আমার মনে হয়।"

সুব্রত বাবুর কথায় সকলে একমত পোষণ করলেন।অত:পর সারোয়ার সাহেব বললেন,

-"মিসেস মোহিনী বসু আপনি যেই অপরাধ করেছেন তার শাস্তি স্বরুপ আপনাকে আমরা এই এলাকা থেকে বিতাড়িত করছি।আপনাকে আজ রাত অবধি সময় দেওয়া হলো।সকালের মধ্যে আপনি এই এলাকা ছাড়বেন।আর অনুভব দাদা আপনি যদি আপনার স্ত্রীর সহিত সম্পর্ক রাখতে চান তবে তা আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার তবে এই এলাকায় থাকতে হলে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে থাকা যাবেনা।"

এলাকার লোকেরা মোহিনীকে নিজের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি স্বরুপ এই বাণী শুনিয়ে গেলেন।তবে সজিবকে তারা অন্যভাবে শাস্তি দিলেন।পাড়ার মোড়ে গলায় জুতোর মালা দিয়ে মুখে কালি লেপে পুরো পাড়া ঘুরিয়ে এনেছিলো পাড়ার ছেলেপেলেরা।
পাড়ার মহিলারা অবশ্য ভেবে রেখেছে কাল মোহিনী বের হলে তাকেও এই একই শাস্তি তারা দিবে।

রাত তখন দশটার মতো।সায়ন স্নেহার মায়ের কুকীর্তির কথা শুনে স্নেহাদের বাড়ি এসেছে।বর্তমানে সোফায় মুখোমুখি বসে আছে সায়ন আর অনুভব।নিজের মেউএ জামাইর সামনে এভাবে বসতে হবে কখনো ভাবেনি অনুভব।

নীরবতা ভেঙ্গে অনুভবই বলতে শুরু করে,

-"স্নেহার মায়ের জন্য তোমাদের সংসারে কোনো অশান্তি করিও না বাবা।আমার মেয়েটা এসবের কিছুই জানতো না।"

-"অন্যের দোষের ভাগীদার আপনার মেয়েকে আমি করবো না বাবা।কিন্তু সে তার মায়ের সাথে মিলে আমায় ঠকিয়েছে।"

অনুভব এ পর্যায়ে চমকে ওঠে।সায়ন নিজেই আবার বলে ওঠে,
-"স্নেহার আর স্নেহার মা মানে আমার শাশুড়ি মিলে আমার প্রাক্তন মাধবী ও তার পরিবারের কাছে বলেছিলো আমি তার সাথে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করেছি এবং তার গর্ভে আমার সন্তান।এর পরেই আমার আর মাধবীর বিয়েটা ভেঙ্গে যায়।"

অনুভব যেন এতসব চমক একসাথে নিতে পারছে না।ইতমধ্যেই স্নেহা ঘরে আসে চায়ের কাপ নিয়ে।স্নেহা চায়ের কাপটা টেবিলে রাখার সাথে সাথেই অনুভব সপাটে চড় বসায় তার গালে।
স্নেহা হতভম্ভ হয়ে যায় এতে।দ্বিতীয় চড়টা দেওয়ার আগেই সায়ন উঠে এসে স্নেহাকে সরিয়ে নেয়।

-"সে আমার স্ত্রী বাবা।আপনি আমার সামনে অন্তত ওর গায়ে হাত তুলিয়েন না,প্লিজ।"
অনুভব থেমে যায়।বজ্রকণ্ঠে মোহিনীর নাম ধরে ডাকে।মোহিনী একপ্রকার দৌঁড়ে আসে ঘরে।অনুভব মোহিনীর চুল মুঠ করে ধরে একটা গালি দিয়ে বলে ওঠে,

-"তেইশ বছর আগে তোর জন্য আমি আমার স্ত্রীকে ফেলে এসেছিলাম।ওর গর্ভে আমার সন্তান ছিলো।মেয়েটা বুকভরা অভিমান নিয়ে ট্রেন দূর্ঘটনায় মারা গেল।ওর শরীরখানা পুড়ে ছাই হয়ে গেল।হারামজা*দী তুই এখন আবার নিজের মেয়েকেও নিজের মতো বানাতে চাস?জামাই কি বললো?তুই স্নেহাকে সায়নের সাথে বিয়ে দিতে এই নোংরা পন্থা অবলম্বন করেছিলি?নষ্টা মহিলা একটা।"

মোহিনী অনুভবের হাত থেকে ছুটতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে কিন্তু লাভ হচ্ছেনা।অনুভব একটা চড় মেরে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় মোহিনীকে।

মোহিনী কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ে।অনুভবকে একটা জঘন্য গালি দিয়ে বলে,

-"বেশ করেছি।এখন মরা বউয়ের জন্য দরদ উতলে পড়ছে?তো আমার কাছে এসেছিলে কেন?নন্দাকে বিয়ে করার এক বছর পর আমায় কেন আবার লুকিয়ে চুড়িয়ে বিয়ে করেছিলে?তখন মনে ছিলো না প্রথম বউয়ের কথা?আর স্নেহাকে আমি সায়নের সাথে ওভাবে বিয়ে দিয়েছি বেশ করেছি।ভালো করেছি আমি।ফেইক রিপোর্ট বানিয়ে ওকে প্রেগন্যান্ট দেখিতেছি বেশ করেছি।"

স্নেহা এবার স্তব্ধ হয়ে যায়।স্নেহা সেদিন তার বার্থডে পার্টিতে সত্যিই সায়নের সাথে ইন্টিমেট হয়েছিলো।সায়ন প্রচুর ড্রিংক করেছিলো সেদিন কিন্তু স্নেহা কিছুটা হুশে ছিলো।তবুও সায়নের মাতাল করা ছোঁয়ায় স্নেহা সাড়া না দিয়ে পারেনি।সায়নকে সে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসতো তবে মাধবী আর সায়নের সম্পর্কের কারণে কখনো বলেনি সায়নকে।সেদিনের পর স্নেহা ভীষণ ভয়ে থাকতো।আবেগের বশে করে ফেলা ভুলের ফলাফল সম্পর্কে ঠিক ভাবে অবগত ছিলো না স্নেহা।ওই ঘটনার দু'দিন পর কাঁদতে কাঁদতে মোহিনীর কাছে আসে স্নেহা।মোহিনীকে সব ঘটনা খুলে বললে সে স্নেহাকে আশ্বস্ত করে সায়নকে যেন স্নেহা পায় তার সব ব্যবস্থা করবে মোহিনী।স্নেহা মায়ের কথায় বিশ্বাস করে।মোহিনীর প্রত্যেকটা প্ল্যানে সে তাল মেলায়।স্নেহার বিবেকে বাঁধা দিচ্ছিলো বারংবার কিন্তু সায়নকে সে অসম্ভব পরমাণ ভালোবাসতো বিধায় বিবেককে বিসর্জন দিয়ে দেয়।
সেদিন মাধবী যখন তাকে শপিংমলে বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করে তখন কোনো উত্তর খুঁজে পায়না স্নেহা।তাই মাধবীকে না চেনার অভিনয় করে চলে আসে ওখান থেকে।

হঠাৎ মোহিনীর গগন বিদারী চিৎকারের শব্দে ধ্যান ফেরে স্নেহার।সামনে তাকিয়ে দেখে অনুভব রেগে পানির গ্লাস ছুঁড়ে মেরেছে মোহিনীর মাথায়।ফলস্বরুপ মোহিনীর মাথার গ্লাসের ভাঙ্গা অংশ ঢুকে রক্তপাত হচ্ছে।

স্নেহা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।সায়ন তাৎক্ষণাৎ তার পরিচিত ডাক্তারকে কল করলে ডাক্তার এসে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে যায় মোহিনীকে।ডাক্তার চলে গেলে সায়নও চলে যেতে চায়।কিন্তু স্নেহা তার পা জড়িয়ে ক্ষমা চাইলে রাতটা তাদের বাড়িতে থাকতে রাজি হয় সায়ন।

রাতে স্নেহা সায়নের পা ধরে কান্না করে।ক্ষমা চায় তার কাছে।তার জন্মদিনের রাতে দু'জনের কাছে আসার কথাও বলে সায়নকে।সায়ন প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়না,কিন্তু স্নেহা যখন হোটেলের করিডোরের সিসিটিভি ফুটেজ দেখায় তখন সায়নের বিশ্বাস হয়।সায়ন বিশ্বাস করে জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে এগুলো বিধাতার আদেশেই হয়।ভুল সে নিজেও করেছে,বিয়ের আগেই স্নেহার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে তাই মোহিনীর প্ররোচনায় করা স্নেহার ভুলগুলো ক্ষমা করে দেয় সায়ন।

পরদিন সকালে মোহিনীকে ঘর থেকে বের করে দেয় অনুভব।ক্লান্ত শরীর নিয়ে পাড়ার মোড়ে গেলেই পাড়ার মহিলারা জুতোর মালা পড়িয়ে দিয়ে কালি মেখে দেয় মোহিনীর পুরো মুখে।অত:পর পাড়া থেকে ওভাবেই বের করে দেয় মোহিনীকে।

স্নেহা সেদিন অনুভবের অতীত জানার পর অনুভবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।শুধু সায়নের হাত ধরে বাড়ি থেকে চলে আসার সময় বলে,

-"পাপ বাপকেও ছাড়েনা বাবা।কিন্তু দেখো তোমার আর মায়ের করা পাপের ফল তোমাদের সন্তান হয়ে আমায় ভুগতে হচ্ছে।আমার স্বামীর চোখে আমি অনেকটা নিচে নেমে গেছি বাবা।দোষ আমারো আছে,আমি মোহিনী বসুর কথা শুনে এতো বড় পাপ করেছি।তবে তুমি কি করে পারলে একটা মেয়েকে বিয়ে করে তাকে ঠকিয়ে অন্য নারীকে আপন করে নিতে?তুমি খুনি বাবা,দু'টো মানুষের খুনি তুমি।আজ থেকে আমি তোমার মেয়ে না।"

সেদিনের পর স্নেহা তার শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো।স্নেহার শ্বশুর ক্ষমা করে দিলেও স্নেহার শাশুড়ি এখনো মন থেকে স্নেহাকে ক্ষমা করতে পারেননি।অনেক অনুরোধের পর স্নেহার শাশুড়ি রাজি হয়েছেন স্নেহা আর সায়নের সাথে থাকতে।

অনুভব মাঝে মাঝে স্নেহার শ্বশুর বাড়ি আসে।বাকি সবাই অনুভবের সাথে কথা বললেও স্নেহা বলেনা।দূর থেকে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে নিজের বাবাকে দেখে স্নেহা।কিন্তু সামনে এসে কথা বলেনা।

অনুভব এখন একাই থাকে।সেদিনের পর মোহিনী কোথায় গেছে অনুভব বা স্নেহা কেউ-ই জানেনা।তবে আজকাল অনুভব নন্দাকে প্রায় প্রতি রাতেই স্বপ্ন দেখে।একটা ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে নন্দা আসে তার কাছে।অনুভব হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় নন্দাকে কিন্তু পারেনা;তার আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় নন্দা।

নন্দার একখানা ছবি অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেয়েছিলো অনুভব।সেটাকেই ফ্রেম করে রেখে দিয়েছে।

-"তুমি স্বপ্নেও আমায় ধরা দেওনা নন্দা!আমার পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি নন্দা;ভীষণভাবে পাচ্ছি।তোমায় হারানোর পর আমি ভালো নেই।পারলে আমায় ক্ষমা করো;এই পাপী কে ক্ষমা করো।"

অবহেলার বকুল মালা খানা আর নেই;নিজেকে বিলিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে সে।তবে তার আর্তনাদ আর বুক ভাঙ্গা যন্ত্রণার ভার বইতে বইতে অপরাধীরাও আজ নিঃস্ব।কিন্তু ক্ষমা তাদের মিললো না!

সমাপ্ত...

অণুগল্প #অবহেলার_বকুল_মালার_সমাপ্তি
#শ্রীমতি_প্রজ্ঞা_মঞ্জরী [লেখিকা]

Address

Singapore

Telephone

+6598993042

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when নীল ক্যাফের ভালোবাসা posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share