04/07/2025
আমার পঁচিশ বছরের সংসারটা আমার তিন ননদ মিলে ভেংগে দিল!
কারন হিসাবে বলা হল আমি নাকি আমার শাশুড়ির সেবা যত্ন ঠিকমত করিনা।
আমি আমার কলিজা ভুনা করে খাওয়ালেও ননদেরা কয়-নুন কম হইছে!
শাশুড়ি আমার পক্ষেও বলেন না বিপক্ষেও বলেন না শুধু মেয়েদের সাথে হয় হয় করেন!
আর একই এলাকায় বসবাস করা ননদেরা সেই 'হয় হয়' আগুনে শুধু ঘি ঢালে আর বাতাস দেয়।বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ির কন্যাদের আমার প্রতি এই অভিযোগ!এক কন্যা দিনে সকালে এসে উঁকি দিয়ে বলবে-
-আম্মা!আপনার শরীরটা দিনদিন শুকায়ে যাচ্ছে;খাওয়া দাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে নাকি?
আমি সবই শুনি আর গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।আমার 'গেরাইম্মা' মা আমার কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ গ্রামে চুলা 'গুতাইতে গুতাইতে' নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমারে 'টাউনে' বিয়ে দিলেন।
আমি জ্বলন্ত উনুন থেকে ফুটন্ত কড়াইয়ে এসে পড়লাম।
দুপুরে মেজ ননদের উঁকি-
-আম্মা!আপনের চুলের এ কী অবস্থা? ইস!মনে হয় ছয় মাস ধরে মাথা ধুন না,তেল দেন না-ভাবি!অই ভাবি!
অথচ প্রতি শুক্রবার আমি শাশুড়ির মাথায় শ্যাম্পু করে দেই,তেল দিয়ে দেই।
একটু গরীব ঘরের মেয়ে বলে এরা আমার সাথে যা ব্যবহার করল-লিখলে 'মেঘনাথ বধ কাব্য'র কলেবর পাবে লেখাটা সন্দেহ নাই।
আমারও তো দু'টো সন্তান আছে এদের লেখাপড়া,যত্ম আত্তিও আমাকেই করতে হয়।আমার স্বামী দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন,
পাঁচ বছর হল পাকাপাকি চলে এসেছেন।
স্বামী বাইরে থাকা অবস্থায়ই ওর কান ভারি করেছে এরা।যে কানে একবার বদনামের বিষ ঢালা হয়ে যায়;তারপর ওখানে শত মধু ঢাললেও মধুর ঘ্রানের সাথে বিষের গন্ধ খানিকটা হলেও চলে আসে।
সবার ছোট ননদ পান চিবাতে চিবাতে বিকালে এসে রাউন্ড দিয়ে যাবে-
-আম্মা!আপনার প্রেসারের ওষুধ ঠিক মত খাওয়ায় নি ভাবি?
আম্মা কোন রা' করেন না।রক্ত মাংসের মানুষ আমি;আমারও রাগ অনুরাগ আছে।
-আচ্ছা বেলী!তুমি না এম এ পাস করেছো!তুমি জাননা প্রেসারের ওষুধ নিয়মিত না খেলে বিপদ হতে পারে,
এমন কি স্ট্রোকও হয়ে যাওয়া অসম্ভব না!আম্মার কি এমন হইছে কোন দিন?
নির্বাক বেলীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল;
জোঁকের মুখে নুন যারে কয়!
এভাবে সংঘাতের ভিতর দিয়ে পার করলাম পঁচিশটা বছর!কারো মন তো পেলামই না উপরন্তু কপালে তকমা জুটে গেল আমি শাশুড়ির যথেষ্ট সেবা যত্ম করিনা।
একমাত্র ছেলে বউ শাশুড়ি সেবা করবেনা তো কে করবে?মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত;সেই বেহেস্ত আমার কারনে হাতছাড়া হোক তা আমার স্বামীও চান না,ননদেরাও না।সুতরাং আমার তালাক হয়ে গেল।
যেদিন তালাক দিয়ে আমাকে ওই বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয় সেদিনও আমি ডাইনিংয়ে আমার ওনার জন্য সকাল,
দুপুর,রাতের ডায়াবেটিসের ওষুধ,
প্রেসারের ওষুধ ভাগে ভাগে সাজিয়ে রেখে আসি!ওনার যা ভুলো মন।
আঁচলে মুখ ঢেকে অশ্রু সামলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি-যে লোকটা আমাকে ছাড়া একগ্লাস পানিও খেতে পারেনা সেই লোকটা বাকি জীবন চলবে কি করে?আমি আসলেই এক বুদ্ধিহীন নারী!
আমার স্বামীর সায় ছাড়া এই তালাক যে অসম্ভব ছিল তা বুঝেছি-তালাকের পরে ও যখন তড়িঘড়ি বিয়ে করে তখন।
আমার আরো আগে বুঝা উচিৎ ছিল।
আমার বিশ বছর ও আঠারো বছর বয়সী ছেলে দু'টোকেও ত্যাজ্যপুত্র করে গৃহত্যাগে বাধ্য করা হয়;কারন তারা তাদের মায়ের কঠিন ভক্ত।মায়ের কঠিন ভক্ত এমন ‘বেয়াদপ’ ছেলেদের বাড়ি রাখা নিরাপদ না,সুতরাং ত্যাজ্য!
বড় ছেলেটা অর্থাভাবে মাঝপথে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে একটা গার্মেন্টসে ঢুকেছে শুনেছি,ছোট ছেলেটা লেগুনা চালায়।আমি গ্রামে আমার মা'র কাছে চলে আসি।
দিবানিশি কাঁদি,গভীর রাতে তাহাজ্জুতে আঁচল বিছায়ে কাঁদি
'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল নি'য়ামাল মাওলা ওয়া নি'য়ামান নাছির'!
আমার সাজানো সংসার কোন অপরাধেগো মা’বুদ তছনছ হয়ে গেল?
আমার ওয়াক্বিল,আমার মাওলা আমার প্রতি করা জুলুমের শাস্তি অবশ্যই দিবেন।
কবে দিবেন,কিভাবে দিবেন তা জানিনা;
তবে কৃতকর্মের ফল মানুষ অর্ধেকটা দুনিয়াতেই পায় তা বহুলশ্রুত একটি বাক্য বলেই জানি।
আমার তালাকের ঠিক একবছর পর……।
বড় ননদের ছোট মেয়েটার কি যে হলো বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে আর যাওয়ার নাম নেয় না।তার স্বামী এসে পীড়াপীড়ি করে,ঘুরে ঘুরে যায় স্বামী বাড়ি যায়না।
বড় ননদ বলল-কি হল শাম্মী বিয়ের পাঁচ বছর পর এ কোন প্যাঁকনা তোর?বাচ্চা হয়না মেয়ের এত প্যাঁকনা ভাল লাগেনা!
-মা!তুমি কি চাও আমি সতীন নিয়া ঘর করি?
ননদ আমার ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল।
-কস কি?
-মা!বিয়ের দুই বছর পর থেকেই হাসান পরোকীয়ায় আসক্ত।তুমি কষ্ট পাবে বলে এতদিন জানাইনি,শুধু ওকে ওই পথ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছি।বছর খানেক হলো হাসান ওই মহিলাকে বিয়ে করে পল্লবী,আরামবাগে বাসা ভাড়া করে আরামসে সংসার করছে!আমি ওই সংসারে যাব না মা।
শাম্মী হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
আমার এই ননদই সর্ব প্রথম আমার স্বামীর বিদেশ থাকার সুযোগে আমাকে পরোকীয়ার অপবাদ দিয়েছিল!
আমি অবশ্যই খুশি হইনি-শুধু এই ভেবে আশ্চর্য হই পৃথিবীর মালিক কখন যে কারে কোন সূতা ধরে টান দিয়ে 'টাইট' দিবেন তা একমাত্র তিনিই জানেন!
একদিন ফোন করে শাম্মী প্রচুর কাঁদল।
-মামী!মামীগো!আমার মা'রে আপনি মাফ করে দেন!
আমি মাফ করে দিয়েছি;এই বাচ্চা মেয়েটির তো কোন দোষ নাই।
-শাম্মী বিপদে ধৈর্য্য হারা হইও না।
নিজে পড় মাকেও বেশি বেশি পড়তে বল-'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল………'
শাম্মীর এই ঘটনার পর মেজ ননদের একটি ঘটনা আমার মত পোড় খাওয়া মানুষেরও অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়।
মেজ ননদের একমাত্র ছেলে অপু।
ওকে বলতে গেলে আমিই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি!
অনার্স পড়াকালীন মেজ ননদের বিয়ে হয়ে যায়!ভাল ছেলে,বংশীয় ছেলে,ভাল চাকরি করে উত্তরাধিকার সূত্রে মিরপুরে ওদের বিশাল বাড়ি।
অপু কলেজে উঠেই বায়না ধরে তাকে 'এপাচি' মোটর বাইক কিনে দিতে হবে।
কোন ভাবেই ওকে বাইক কেনা থেকে নিবৃত্ত করা গেলনা।
পুত্রের জেদের কাছে পিতামাতা পরাজিত হল।নতুন বাইক পেয়ে ছেলেটা কী যে খুশি!অনেক খুশি হল অপু।
শুরু হল বাইকের মালিকে মালিকে বন্ধুত্ব।সেই বন্ধুত্ব এলাকার গন্ডী ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত হল।পুরাতন বন্ধুরা সব তামাদি হয়ে গেল।নতুনরা প্রতিস্থাপিত হল।
ওদের সাথে বাইক নিয়ে কোথায় কোথায় যায় ছেলেটা।একদিন বাইকার বন্ধুদের নিয়ে হাতির ঝিলে বেড়াতে গেল অপু।
আর ফিরে এলোনা।
মেজ ননদের হাজব্যান্ড অচেনা সেই বন্ধুদের নামে অপুকে অপহরন ও গুম করে বাইক ছিনতাইয়ের মামলা দিল।মাস খানের পর তিনশ ফুট,পুর্বাচল প্রজেক্টের নির্জন এক লেকে ওর বস্তাবন্দী লাশ পাওয়া গেল।
মেজ ননদ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর আমার কাছে ক্ষমা চায়।
আমি অপুর জন্য দোয়া করি-'হে আল্লাহ এই মাসুম বাচ্চাটাকে তুমি জান্নাত দান করো'।
মেজকে বলি বিপদে ধৈর্য হারা হইও না বেশি বেশি পড়-'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল………'
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর সবার ছোট ননদ বারান্দায় কাপড় শুকাতে গিয়ে ডেসকোর হাই ভোল্টেজ তারে বিদ্যুতপৃষ্ট হয়ে ঝলসে যায়।মরতে মরতে বেঁচে গেছে বেচারী।বামহাতটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে
গেছে।
ওকে দেখে আমার ভীষন কান্না পেয়েছে;আহা!আমার সবার ছোট ননদ।
কতই বা আর বয়স!
'প্রভুহে দয়াময়!আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি তুমি মজলুমের ডাক শোন।আমি মজলুম হয়ে হাত তুলে বলি শান্তাকে তুমি ক্ষমা করে দাও,সুস্থ করে দাও'!
'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল…'
আমার পঁচিশ বছরের স্বামীধন নতুন "বউকে একটি কন্যা সন্তান উপহার দিয়াছে!কন্যার বয়স দুই বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে।সেই কন্যার মামারা দস্যু প্রকৃতির।উহারা আমার প্রাক্তন স্বামী প্রবরকে ঢাকার বাড়ি তাহাদের ভগিনীর নামে লিখিয়া দিতে প্রতিনিয়ত চাপ দিয়া যাইতেছে"!
আমার স্বামী নিজ সন্তানকে অনিরাপদ ভেবে ত্যাজ্য করেছে;বিপদ অন্যদিক থেকে এমন ভাবে আসবে কল্পনায়ও আসেনি!
তিনি প্রায় সময়ই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান।তার কিচ্ছু ভাল লাগেনা।
তিনি সারাক্ষন আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন।
আমি তার শাস্তি চাই বিনাশ চাইনা-তাই মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে লিখি বেশি বেশি এই দোয়াটা পড়ুন-'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল,নি'য়ামাল মাওলা ওয়া নি'য়ামান নাছির'!
©সাইফুল আলম*