21/09/2025
#অ্যারেস্টেড_লাভ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১২
সিগারেট ঠোঁট থেকে সরিয়ে ফ্যালফ্যাল করে নওয়াজের পানে তাকাল সেহের। টিমটিমে আলোতে লোকটাকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও সে নিজের পুলিশের ইউনিফর্মে নেই সেটা সেহের বুঝতে পারল। ক্ষীণ স্বরে সেহের বলল,
"আপনি হঠাৎ এখানে?'
"আমি তো বলেছিলাম আমি আবার আসব। আপনি হয়ত ভুলে গিয়েছেন আমার বলা কথাটা।"
"আমি সত্যি ভাবিনি আপনি আবার আসবেন। তাছাড়া আজকাল কথা দিয়ে কথা কে-ই বা রাখে?"
বেশ দায়সারাভাবে প্রত্যুত্তর করে সেহের। তাতে নওয়াজের মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটেনা। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে সেহেরের মুখোমুখি এসে সামান্য ঝুঁকে তার চোখে দৃঢ় দৃষ্টি রেখে স্পষ্ট জবাব দিলো,
"আমি রাখি।"
আচানক নওয়াজের এত নিকট চাহনিতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সেহের। যার ফলে পরপর তিনবার হেঁচকি ওঠে তার। সেই সুযোগে নওয়াজ ধীরে ধীরে সেহেরের হাতের দিকে গিয়ে তার সিগারেট ধরে নিজের হাতের কবলে নিয়ে আসতেই আরো একদফা চমকায় সেহের। সে ক্ষেপে উঠে সিগারেট নওয়াজের হাত থেকে সিগারেট নিতে চাইতেই নওয়াজও নিজের হাত সরিয়ে ফেলে জিনিসটা ফেলে দিয়ে নিজের পায়ের জুতার সাথে চাপা দেয়। সেহের হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
"হাউ ডেয়ার ইউ? একটু বেশি স্পর্ধা দেখিয়ে ফেলছেন না?"
নওয়াজ নির্লিপ্তে বলল,
"স্পর্ধা দেখানো যাদের পেশা তাদের থেকে আপনি কী আশা করেন? অ্যান্ড দিস ইজ অ্যা হসপিটাল ম্যাডাম, নট ইউর পারসোনাল স্মোকিং জোন।"
সেহের উঠে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,
"সো আপনি এখানে এসেছেন আমাকে ফ্রি-তে এডভাইস দিতে?"
তৎক্ষনাৎ নওয়াজের কাছ থেকে কোনো উত্তর পেল না সেহের। নওয়াজ নিজের প্যান্টের পকেট থেকে কয়েকটা জিনিস বের করে সেহেরের পাশে এসে দাঁড়াল। হাত মুঠো করে সেহেরের সামনে নিয়ে গিয়ে হাতটা খুলতেই দৃশ্যমান হলো সেহেরের প্রাণ প্রিয় কাঙ্ক্ষিত জিনিস গুলো। মাত্র একপলক মায়ের রিং দেখতে পেয়ে লোচন দুটো চকচক করে ওঠে সেহেরের। বুক ভর্তি জেগে ওঠে উচ্ছ্বাস। আলতো করে স্পর্শ করে সে রিংটা। তার কম্পিত স্পর্শে নওয়াজ বেশ অনুভব করতে পারে সেহেরের মায়ের স্মৃতির প্রতি এক সমুদ্র সমান উন্মাদনা। সেহের দুটো আঁখিতে ভরপুর খুশির ঝলকানি যা নওয়াজের কাছে স্পষ্ট ধরা পড়েছে। সেহের দ্রুত মায়ের রিং নিজের হাতের আঙ্গুলে পরে নিলো। তাতে যেন তার খুশির ডানা মেলে গেল। নওয়াজের ফট করে মনে হলো এ যেন এক বাচ্চা মেয়ে যার প্রিয় কোনো জিনিস হারানোর পর আবার ফিরে পাওয়ার আনন্দে দিশাহারা! সেহের সেই আংটিতে একটা চুমু দিয়ে মোলায়েম সুরে বলল,
"এখন আবার মনে হচ্ছে মা আমার হাতটা ধরে রেখেছে।"
নওয়াজ স্মিত হাসে। তারপর নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
"আপনার বাকি জিনিসগুলো নিলেন না যে!"
সেহের ফের নওয়াজের হাতের দিকে তাকায়। নওয়াজের হাতে সেহেরের আরেকটা রিং রয়েছে যেটা ডায়মন্ডের এবং বেশ দামী। এটাও হারিয়ে ফেলেছিল সেহের এক্সিডেন্টের পর যেটা নিয়ে সেহেরের খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না। তার উচ্ছ্বাস বিস্ময়ে পরিবর্তন হয় যখন সে নিজের পেন্ডেন্ট নওয়াজের হাতে দেখে। ওটা সেহের চট্টগ্রামেই অস্বীকার করে চলে এসেছিল। আজ নওয়াজ আবারও নিয়ে এসেছে? সেহের কোনো প্রশ্ন করবার আগেই নওয়াজ বলল,
"আমি জানি এটা আপনারই। তবে সেদিন মিথ্যা কেন বলেছিলেন আমি জানি না। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমায় ভয় পান না।"
সেহের তার পেন্ডেন্ট ও রিং নিয়ে দাঁড়ানো থেকে বসল। খোলা আকাশের পানে চেয়ে ভার গলায় বলল,
"আমি আমার মাকে ভীষণ মিস করছিলাম। তার ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য ছটফট করছিলাম। আমি জানি সে নেই কিন্তু তার জামাকাপড় আমি যত্ন করে রেখেছি। তার সব জিনিসে এতটুকু আঁচ আসতে দিইনি। আর এই রিং আমার মা পরে থাকত সবসময়। তাই এটা পরার মাধ্যমে তাকে অনুভব করি।"
কথাগুলো শুনতে শুনতে সেহেরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি বসল নওয়াজ। কেন বসল তার পাশাপাশি নওয়াজ নিজের মনকে প্রশ্নকে করে উত্তর পায় না। হয়ত সেহেরের কথাগুলো আরো কাছ থেকে শুনতে মন চাইছিল আর তার নিজেরও কিছু বলতে মন চাইছিল। সেহের তার পাশাপাশি নওয়াজের উপস্থিতি টের পেয়েও আজ রুদ্রমূর্তি ধারণ করল না। একেবারে নিস্ক্রিয় রইল। দুজনেরই দৃষ্টি কালো অম্বরে সীমাবদ্ধ যেখানে ঝিকিমিকি তাঁরা তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তাদের কর্ণকুহরে শুধু প্রবেশ করছে সেহের শান্ত কণ্ঠে শুধাল,
"আপনি সব ছেড়ে আমার জিনিস খুঁজলেন কেন? এত সামান্য কাজ করতে গেলেনই বা কেন?"
"আজ যেটুকু কাজ ছিল সব আমার সহযোগী সামলে নিয়েছে। দেশের কোনো উন্নতি কেন নেই সেটা আপনার দুর্ঘটনা থেকে বোঝা যায় মিস সেহের। আপনি রাস্তায় পড়ে ছিলেন আর বাকিরা আপনাকে সাহায্য করার নামে আপনার জিনিসপত্র চুরি করেছে। আপনার হাত থেকে রিং অবধি খুলে নিয়েছে। জানি না এসব আদেও ঠিক হবে কিনা।"
নওয়াজের কথা শেষে আবার তাদের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ রইল। কিন্তু নওয়াজের অন্তরে অবিচল রইল অস্থিরতা। তাদের সে দমাতে পারছে না। যদি তার অস্থিরতা শব্দ করতে পারত তাহলে সেই শব্দে কেউ টিকতে পারত না। নওয়াজের মনে চেপে রাখা কথা উগড়ে এলো।
"আপনার মনে আছে আমি বলেছিলাম আমার পারসোনাল রিজনে আমি আপনার মায়ের রিং খুঁজতে হেল্প করব?"
সেহের উত্তর না দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে শুধু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল। নওয়াজ সেই চাহনির জবাবে ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
"আমার কেউ নেই। আমি এতিম। আমি জানিও না আমার মা-বাবা কে! কখনো দুই চোখে দেখার ভাগ্যও হয়নি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নিজেকে এক অনাথ আশ্রমেই দেখে আসছি। জানি না মা-বাবার আদর-স্নেহ ঠিক কেমন হয়! তাদের ভালোবাসা পেলে ঠিক কেমন লাগে আমি কখনো সেসব বুঝিনি। আপনি মায়ের স্নেহ পেয়েছেন তাই মায়ের জিনিসের মূল্য আপনার কাছে অনেক বেশি। আপনার কাছে এখন মা না থাকলেও মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে রাখেন আমি সেটাও পাইনি। তাই অন্য একজনের মায়ের স্মৃতি খোঁজার জন্য আমি এতটা ডেস্পারেট হয়ে পড়েছিলাম।"
নওয়াজের বিষাদে ভরা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইল সেহের। আবছা আলোতে নওয়াজের জ্বলজ্বল করা লোচনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার পরিবার না থাকার যন্ত্রণা। মুখশ্রীতে যদিও সে কোনো কষ্টের ছাপ রাখেনি। সেহের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে একবার হেসে বলল,
"তাহলে আপনার আর আমার মাঝে একটা সিমিলারিটি পাওয়া গেল। আমাদের কারোর মা নেই।"
নওয়াজ ফের প্রশান্তিতে ভরা আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
"উঁহু, আপনার তো সৎমা আছে। বাবাও আছে। যদিও হয়ত আমি জানি সৎমা খুব একটা ভালো হয়না। তবুও..."
কথাটি শেষ করতে পারল না নওয়াজ। সেহের তেতে উঠে বলে,
"এমন সৎমা আর বাবা থাকার চেয়ে একা অনেক ভালো। আমার বাবা থেকেও নেই। আমি একা!"
সেহেরের এমন দাবি যেন গায়ে লাগে নওয়াজের। একা থাকার জ্বালা সে বোঝে। নিজের ঠোঁটে নিজে তর্জনী আঙ্গুল রেখে বলে উঠল,
"হুঁশশ, আপনি জানেনও না আপনি কী বলছেন। আপনার জন্য চিন্তা করার মানুষটাকে অবহেলা করবেন না। আমাকে দেখুন মিস সেহের। আমি মরে গেলেও আমায় নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার কেউ নেই। সেই দলে আপনি নাম লেখাতে চাইবেন না প্লিজ।"
সেহের হাসে। তার হাসিতে ভরপুর তাচ্ছিল্য প্রকাশ পায়। তার দুর্বল শরীরে হাসতে গিয়ে সামান্য দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। হাসি থামিয়ে দুর্বল কণ্ঠে বলে,
"আমাকে নিয়ে চিন্তা করা সেই বাবার অস্তিত্ব ততদিন ছিল যতদিন আমার মা বেঁচে ছিল। সেই বাবার অস্তিত্ব মুছে গেছে। কতটুকু জানেন আমার জীবন সম্পর্কে? আমাকে নিয়ে পরোয়া করার কেউ নেই। যদি সত্যিই থাকত আমি হসপিটালে জাস্ট দুটো অচেনা নার্সের সাথে একা পড়ে থাকতাম না। যেই বাবার কথা বলছেন তিনি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এই রাতে উনি একবারও আসবেন না। একা আমি পড়ে থাকব হসপিটালের বেডে।"
"সম্পর্কে অনেকসময় তিক্ততা চলে আসে। সেটা সময় মতো কমিয়ে আনতে হয়।"
সেহের কঠোর গলায় জবাব করল,
"আমি চাইনা কোনো তিক্ততা কমাতে। এই তিক্ততা, বিষাক্ততা আমার প্রিয়। এদেরকে প্রিয় বানিয়ে রাখা ভালো। এরা অন্য কাউকে আমার কাছে আসতে দেয়না। এরা আমার মনের চারিদিকে দেয়ালের মতো। যাকে ভেদ করে কেউ আসতে পারবে না।"
নওয়াজ কৌতূহলী নয়নে চেয়ে বলল,
"আর কেউ যদি কোনোদিন সেই দেয়াল ভেঙেচুরে আপনার মনকে ছুঁয়ে ফেলে তবে?"
সেহের দাঁতে দাঁত চেপে পাল্টা জবাবে বলল,
"ইম্পসিবল। কারণ ওখানে কোনো মনই নেই। মন বলতে কোনো জিনিস হয়না। তাই মন থেকে ভালোবাসা এটাও একটা মিথ। একারণে ভালোবাসা পুরোটাকেই মিথ মনে হয় আমার।"
নওয়াজ সামান্য হেসে বলে,
"মস্তিষ্ক যদি কাউকে একবার গেঁথে নেয় তাহলে কী হয়? মস্তিষ্ক তো তাহলে সবচেয়ে বড়ো ধোঁকাবাজ। সে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পছন্দ করে তার দোষ দেয় বেচারা মনের উপর। দিস ইজ নট ফেয়ার।"
সেহেরের হাসির শব্দ পায় নওয়াজ। হাস্যোজ্জ্বল সুন্দরী রমনীর পানে তাকায় সে। খুব সাধারণ বেশে এক নারী। রোগীর পোশাক, লম্বা চুলের এলোমেলো বিনুনি মাটি থেকে মাত্র কিছুটা উপরে ঝুলছে। মেয়েটা সেই হাসিতে সবসময়ের মতো অহমিকা, পৈশাচিকতা নেই। একখানা শুদ্ধ হাসিতে বোধহয় খারাপ লাগে না এই নারীকে। তৎক্ষনাৎ চোখ সরায় সেহের। মিনিট দুয়েক তাদের কথোপকথন বন্ধ থাকে। সেহের হুট করে বলে ফেলে,
"থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ।"
"ফর হোয়াট?"
"আমাকে সকলের স্পর্শ থেকে দূরে রাখার জন্য।"
নওয়াজ নির্লিপ্তে স্বীকার করল,
"কিন্তু আমি তো স্পর্শ করেছি।"
সেহেরের মাঝে কোনো ক্রোধের রেশ দেখা গেল না। সে সোজাসাপটা মনে আওড়ালো,
"ইয়েস, ইউ টাচড্। আমি ভেবেছিলাম অনেক রাগ দেখাব কিন্তু আপনার সেই স্পর্শে কোনো ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা ছিল না।"
"ডু ইউ ওয়ান্ট টু পানিশ মি ফর দিস?"
সেহের শুধু মুচকি হাসল। সেই প্রসঙ্গে আর কিছুই বলল না। কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল,
"থ্যাংক ইউ ওয়ান্স এগেইন।"
নওয়াজ প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকাতেই সেহের উত্তর দিলো,
"আমার আর মায়ের জিনিস আমার কাছে ফেরত আনার জন্য।"
নওয়াজ ঠোঁট হেসে ব্যঙ্গ করে বলে,
"আপনার মতো মানুষের থেকে এতগুলো থ্যাংক ইউ পেলে সেই লোড নেওয়া তো মুশকিল হয়ে যাবে।"
সেহের চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ফোঁসফোঁস করে বলল,
"এজন্য আমি মানুষের সাথে ভালো হইনা। আমার ভালোটা কেউ সহ্য করতে পারেনা।"
নওয়াজ বিদ্রুপের সহিত বলল,
"ওহ হো! সো স্যাড।"
মুখ ঘুরিয়ে নিজের পেন্ডেন্ট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল সেহের। এই পেন্ডেন্ট তার নিজস্ব পছন্দের ছিল। তবে তার মায়ের চেয়ে বেশি পছন্দের নয়। পেন্ডেন্ট গলায় পরে নিলো সেহের। হালকা বাতাসের তোড়ে দুর্বল শরীর আরামে আরো নেতিয়ে পড়তে চাইছে। ঘুমের ইনজেকশনের প্রভাব বোধহয় এখনো শেষ হয়নি। চোখ দুটো বুঁজে আসতেই রেলিং-এ হাত রেখে হাতের উপর মাথা রাখল সে। ঘুম জড়ানো গলায় বলতে থাকল,
"জানেন, আজ এক্সিডেন্টের পর সেন্সলেস যখন ছিলাম তখন আমার স্বপ্নে আমার মা এসেছিল। তবে আমার আর আমার মায়ের মধ্যে একটা দূরত্ব ছিল। সেই দূরত্ব মিটিয়ে আমি মায়ের কাছে যেতে চাইছিলাম। মা আমায় বলল, আমি তোকে নিতে আসিনি। তোর আমার সাথে যাওয়ার সময় আসেনি। তুই যেখানে আছিস থাক। ভালো থাক। এটা শোনার পর আমি খুব কষ্ট পেলাম। কিন্তু মা তবুও চলে গেল। আমাকে নিয়ে গেলে কী ক্ষতি হতো?"
সেহেরের শেষ কথাতেই আঁটকে গেল তার যাতনা। নওয়াজ থমকে বসে রইল খানিকক্ষণ। থেমে থেমে বলল,
"আপনার আর আপনার মায়ের দূরত্বটা সেখানে যতটা কম মনে হয়েছিল হয়ত তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল সেই দূরত্ব। আর উনি তো বলে দিলেন আপনার সময় হয়নি যাওয়ার।"
সেহের ভারি নিশ্বাস ছাড়ল। সেই নিশ্বাসে শূন্য করার চেষ্টা করল তার অন্তরে মিশে থাকা সমস্ত ভার। চোখ বুঁজেই এবার কঠোর জবান খুলল সে। কাঠকাঠ গলায় বলে দিলো,
"এইযে শুনুন, আমার আজকের কথাগুলো শুনে আমার প্রতি একটুও সহানুভূতি দেখাবেন না। এতটুকু সময়ের জন্য আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কিন্তু আমি কিন্তু ভুলে যাইনি আমার সঙ্গে আমার শত্রুতা। আই জাস্ট হেইট ইউ মিস্টার এসপি!"
নওয়াজের ঠোঁটে দেখা গেল সূক্ষ্ম হাসি। একপলক সেহেরের দিকে চেয়ে বলল,
"আই নো মিস ইনোসেন্ট। আপনি আকাশ হলে আমি পাতাল। আর আমাদের এই শত্রুতা শেষ হওয়ার নয়। অ্যান্ড আই অ্যাম ইনজয়িং ইট।"
নওয়াজের কথা সমাপ্তের পর শান্ত হলো পরিবেশ। সেহেরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভালো করে পরখ করল নওয়াজ। মেয়েটা রেলিং-এ হাত রেখে মাথা দিয়েই সিটে বসে বসে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছে। নওয়াজ তাকে ডাকতে চেয়েও পারল না। কিছুক্ষণ বসে সময় কাটালো সে। রাত বাড়তে থাকলে বাধ্য হয়েই সে সেহেরকে ধীর কণ্ঠে ডাকল।
"মিস সেহের! আপনার ঘুম পেলে নিচে চলুন।"
সেহের নড়েচড়ে উঠে বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে ঘুমের মাঝেই বলল,
"আর একটু মা প্লিজ!"
স্থবির হয়ে গেল নওয়াজ। সেহের কি ফের মায়ের স্বপ্ন দেখছে? মায়ের একটা মেয়ের যে কিনা সজ্ঞানে, স্বপ্নে সবসময় নিজের মাকে ছাড়া কিছু বোঝে না তার পক্ষে বাস্তব জীবনে মাকে ছাড়া থাকা কতটা কঠিন? সেটা অনুভব করার প্রচেষ্টা করে নওয়াজ। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ করে নিরুপায় হয়ে সেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
"মিস সেহের! উঠে পড়ুন ম্যাডাম।"
সামান্য উচ্চ স্বরে চোখ মেলে তাকায় সেহের। আশেপাশে দেখে নিজেকে সেই বিরক্তিকর হসপিটালের ছাঁদে আবিষ্কার করেই চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। সোজা হয়ে বসে চোখ ডলতে থাকলে নওয়াজ জানায়,
"ঘুম ধরলে নিচে চলুন।"
সেহের টলমল করে কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। ঘুমটা ঝেঁকে এসেছে চোখে। দুই ধাপ দিতে গেলেই তার এলোমেলো পায়ের চলনে দুটো হাত ধরে ফেলে নওয়াজ। সেহের তৎক্ষনাৎ ক্ষিপ্র হয়ে হাত সরিয়ে বলে,
"ডোন্ট বি সো নাইস টু মি। আন্ডারস্ট্যান্ড?"
নওয়াজ তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে মেয়েটার চলা দেখল। নিজেও তার সাথে সাথে সিঁড়ি অবধি গেল। সেখানে একটা লিফট আছে। নওয়াজ নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
"আই এম নট বিং নাইস টু ইউ। আমি শুধু একটা পেশেন্টের হেল্প করছি। ইটস মাই রেসপনসেবলিটি।"
সেহেরের মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটল না। লিফটের দরজা খুলে গেলে দুজনেই ঢুকল ভেতরে। নওয়াজ পুরোটা সময় আঁড়চোখে সেহেরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গেল। সেহের বারবার চোখ খুলে টানটান করে মেলে থাকা চেষ্টা করছে। স্থির হয়ে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে। একসময় নওয়াজ অধৈর্য হয়ে সেহেরের হাতটা ধরে তার নিজের বাহু ধরিয়ে দিয়ে বলল,
"আমার স্পর্শে নাকি ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা নেই। তবুও কেন এত জেদ? আমায় ধরে থাকুন। জাস্ট কয়েক সেকেণ্ডে আপনাকে কেবিনে দিয়ে আসব।"
নওয়াজের অদ্ভুত ধরনের কথার জোরে আর হাত সরালো না সেহের। ধরে থাকল নওয়াজের পেশিবহুল শক্ত বাহু। জীবনে প্রথমবার বোধহয় এভাবে কোনো পুরুষকে স্পর্শ করতে হয়েছে তাকে। যার কারণে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলেও স্বস্তি পাচ্ছে না সে। এলোমেলো খেলা করছে মস্তিষ্ক। লিফটের গতিকে দুনিয়ার সবচেয়ে ধীর মনে হচ্ছে। নওয়াজ নিজেও দাঁতে দাঁত চেপে একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এমন নারী স্পর্শে কান গরম হচ্ছে তার। মনে মনে চাইছে যেন খুব দ্রুত কাঙ্ক্ষিত স্থান অবধি যেতে পারে! নারী স্পর্শ এত জটিল অনুভূতি দেয় নাকি? এতটা বিপদজনকও হয় যে মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে যায়?
চলবে...
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আজ তিনদিন যাবত আমার বৃদ্ধা আঙ্গুলে ব্যথা। আঘাত পেয়েছি বাজেভাবে। যার কারণে টাইপিং করতে হচ্ছিল খুবই ধীর গতিতে। তাই গল্প দিতে চেয়েও হয়নি।]