নীল ক্যাফের ভালোবাসা

নীল ক্যাফের ভালোবাসা ভালোবাসার নীল ক্যাফের ভালোবাসা প্রতিদিন কমপক্ষে একটি ভালো কাজ করুন
#নীল

04/07/2025

আমার পঁচিশ বছরের সংসারটা আমার তিন ননদ মিলে ভেংগে দিল!
কারন হিসাবে বলা হল আমি নাকি আমার শাশুড়ির সেবা যত্ন ঠিকমত করিনা।

আমি আমার কলিজা ভুনা করে খাওয়ালেও ননদেরা কয়-নুন কম হইছে!
শাশুড়ি আমার পক্ষেও বলেন না বিপক্ষেও বলেন না শুধু মেয়েদের সাথে হয় হয় করেন!

আর একই এলাকায় বসবাস করা ননদেরা সেই 'হয় হয়' আগুনে শুধু ঘি ঢালে আর বাতাস দেয়।বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ির কন্যাদের আমার প্রতি এই অভিযোগ!এক কন্যা দিনে সকালে এসে উঁকি দিয়ে বলবে-

-আম্মা!আপনার শরীরটা দিনদিন শুকায়ে যাচ্ছে;খাওয়া দাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে নাকি?

আমি সবই শুনি আর গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।আমার 'গেরাইম্মা' মা আমার কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ গ্রামে চুলা 'গুতাইতে গুতাইতে' নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমারে 'টাউনে' বিয়ে দিলেন।
আমি জ্বলন্ত উনুন থেকে ফুটন্ত কড়াইয়ে এসে পড়লাম।

দুপুরে মেজ ননদের উঁকি-

-আম্মা!আপনের চুলের এ কী অবস্থা? ইস!মনে হয় ছয় মাস ধরে মাথা ধুন না,তেল দেন না-ভাবি!অই ভাবি!

অথচ প্রতি শুক্রবার আমি শাশুড়ির মাথায় শ্যাম্পু করে দেই,তেল দিয়ে দেই।

একটু গরীব ঘরের মেয়ে বলে এরা আমার সাথে যা ব্যবহার করল-লিখলে 'মেঘনাথ বধ কাব্য'র কলেবর পাবে লেখাটা সন্দেহ নাই।

আমারও তো দু'টো সন্তান আছে এদের লেখাপড়া,যত্ম আত্তিও আমাকেই করতে হয়।আমার স্বামী দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন,
পাঁচ বছর হল পাকাপাকি চলে এসেছেন।

স্বামী বাইরে থাকা অবস্থায়ই ওর কান ভারি করেছে এরা।যে কানে একবার বদনামের বিষ ঢালা হয়ে যায়;তারপর ওখানে শত মধু ঢাললেও মধুর ঘ্রানের সাথে বিষের গন্ধ খানিকটা হলেও চলে আসে।

সবার ছোট ননদ পান চিবাতে চিবাতে বিকালে এসে রাউন্ড দিয়ে যাবে-

-আম্মা!আপনার প্রেসারের ওষুধ ঠিক মত খাওয়ায় নি ভাবি?

আম্মা কোন রা' করেন না।রক্ত মাংসের মানুষ আমি;আমারও রাগ অনুরাগ আছে।

-আচ্ছা বেলী!তুমি না এম এ পাস করেছো!তুমি জাননা প্রেসারের ওষুধ নিয়মিত না খেলে বিপদ হতে পারে,
এমন কি স্ট্রোকও হয়ে যাওয়া অসম্ভব না!আম্মার কি এমন হইছে কোন দিন?

নির্বাক বেলীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল;
জোঁকের মুখে নুন যারে কয়!

এভাবে সংঘাতের ভিতর দিয়ে পার করলাম পঁচিশটা বছর!কারো মন তো পেলামই না উপরন্তু কপালে তকমা জুটে গেল আমি শাশুড়ির যথেষ্ট সেবা যত্ম করিনা।

একমাত্র ছেলে বউ শাশুড়ি সেবা করবেনা তো কে করবে?মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত;সেই বেহেস্ত আমার কারনে হাতছাড়া হোক তা আমার স্বামীও চান না,ননদেরাও না।সুতরাং আমার তালাক হয়ে গেল।

যেদিন তালাক দিয়ে আমাকে ওই বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয় সেদিনও আমি ডাইনিংয়ে আমার ওনার জন্য সকাল,
দুপুর,রাতের ডায়াবেটিসের ওষুধ,
প্রেসারের ওষুধ ভাগে ভাগে সাজিয়ে রেখে আসি!ওনার যা ভুলো মন।

আঁচলে মুখ ঢেকে অশ্রু সামলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি-যে লোকটা আমাকে ছাড়া একগ্লাস পানিও খেতে পারেনা সেই লোকটা বাকি জীবন চলবে কি করে?আমি আসলেই এক বুদ্ধিহীন নারী!

আমার স্বামীর সায় ছাড়া এই তালাক যে অসম্ভব ছিল তা বুঝেছি-তালাকের পরে ও যখন তড়িঘড়ি বিয়ে করে তখন।
আমার আরো আগে বুঝা উচিৎ ছিল।

আমার বিশ বছর ও আঠারো বছর বয়সী ছেলে দু'টোকেও ত্যাজ্যপুত্র করে গৃহত্যাগে বাধ্য করা হয়;কারন তারা তাদের মায়ের কঠিন ভক্ত।মায়ের কঠিন ভক্ত এমন ‘বেয়াদপ’ ছেলেদের বাড়ি রাখা নিরাপদ না,সুতরাং ত্যাজ্য!

বড় ছেলেটা অর্থাভাবে মাঝপথে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে একটা গার্মেন্টসে ঢুকেছে শুনেছি,ছোট ছেলেটা লেগুনা চালায়।আমি গ্রামে আমার মা'র কাছে চলে আসি।

দিবানিশি কাঁদি,গভীর রাতে তাহাজ্জুতে আঁচল বিছায়ে কাঁদি
'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল নি'য়ামাল মাওলা ওয়া নি'য়ামান নাছির'!
আমার সাজানো সংসার কোন অপরাধেগো মা’বুদ তছনছ হয়ে গেল?

আমার ওয়াক্বিল,আমার মাওলা আমার প্রতি করা জুলুমের শাস্তি অবশ্যই দিবেন।
কবে দিবেন,কিভাবে দিবেন তা জানিনা;
তবে কৃতকর্মের ফল মানুষ অর্ধেকটা দুনিয়াতেই পায় তা বহুলশ্রুত একটি বাক্য বলেই জানি।

আমার তালাকের ঠিক একবছর পর……।

বড় ননদের ছোট মেয়েটার কি যে হলো বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে আর যাওয়ার নাম নেয় না।তার স্বামী এসে পীড়াপীড়ি করে,ঘুরে ঘুরে যায় স্বামী বাড়ি যায়না।
বড় ননদ বলল-কি হল শাম্মী বিয়ের পাঁচ বছর পর এ কোন প্যাঁকনা তোর?বাচ্চা হয়না মেয়ের এত প্যাঁকনা ভাল লাগেনা!

-মা!তুমি কি চাও আমি সতীন নিয়া ঘর করি?

ননদ আমার ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল।

-কস কি?

-মা!বিয়ের দুই বছর পর থেকেই হাসান পরোকীয়ায় আসক্ত।তুমি কষ্ট পাবে বলে এতদিন জানাইনি,শুধু ওকে ওই পথ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছি।বছর খানেক হলো হাসান ওই মহিলাকে বিয়ে করে পল্লবী,আরামবাগে বাসা ভাড়া করে আরামসে সংসার করছে!আমি ওই সংসারে যাব না মা।

শাম্মী হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

আমার এই ননদই সর্ব প্রথম আমার স্বামীর বিদেশ থাকার সুযোগে আমাকে পরোকীয়ার অপবাদ দিয়েছিল!

আমি অবশ্যই খুশি হইনি-শুধু এই ভেবে আশ্চর্য হই পৃথিবীর মালিক কখন যে কারে কোন সূতা ধরে টান দিয়ে 'টাইট' দিবেন তা একমাত্র তিনিই জানেন!
একদিন ফোন করে শাম্মী প্রচুর কাঁদল।

-মামী!মামীগো!আমার মা'রে আপনি মাফ করে দেন!

আমি মাফ করে দিয়েছি;এই বাচ্চা মেয়েটির তো কোন দোষ নাই।

-শাম্মী বিপদে ধৈর্য্য হারা হইও না।
নিজে পড় মাকেও বেশি বেশি পড়তে বল-'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল………'

শাম্মীর এই ঘটনার পর মেজ ননদের একটি ঘটনা আমার মত পোড় খাওয়া মানুষেরও অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়।
মেজ ননদের একমাত্র ছেলে অপু।
ওকে বলতে গেলে আমিই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি!

অনার্স পড়াকালীন মেজ ননদের বিয়ে হয়ে যায়!ভাল ছেলে,বংশীয় ছেলে,ভাল চাকরি করে উত্তরাধিকার সূত্রে মিরপুরে ওদের বিশাল বাড়ি।

অপু কলেজে উঠেই বায়না ধরে তাকে 'এপাচি' মোটর বাইক কিনে দিতে হবে।
কোন ভাবেই ওকে বাইক কেনা থেকে নিবৃত্ত করা গেলনা।

পুত্রের জেদের কাছে পিতামাতা পরাজিত হল।নতুন বাইক পেয়ে ছেলেটা কী যে খুশি!অনেক খুশি হল অপু।

শুরু হল বাইকের মালিকে মালিকে বন্ধুত্ব।সেই বন্ধুত্ব এলাকার গন্ডী ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত হল।পুরাতন বন্ধুরা সব তামাদি হয়ে গেল।নতুনরা প্রতিস্থাপিত হল।

ওদের সাথে বাইক নিয়ে কোথায় কোথায় যায় ছেলেটা।একদিন বাইকার বন্ধুদের নিয়ে হাতির ঝিলে বেড়াতে গেল অপু।
আর ফিরে এলোনা।

মেজ ননদের হাজব্যান্ড অচেনা সেই বন্ধুদের নামে অপুকে অপহরন ও গুম করে বাইক ছিনতাইয়ের মামলা দিল।মাস খানের পর তিনশ ফুট,পুর্বাচল প্রজেক্টের নির্জন এক লেকে ওর বস্তাবন্দী লাশ পাওয়া গেল।

মেজ ননদ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর আমার কাছে ক্ষমা চায়।
আমি অপুর জন্য দোয়া করি-'হে আল্লাহ এই মাসুম বাচ্চাটাকে তুমি জান্নাত দান করো'।
মেজকে বলি বিপদে ধৈর্য হারা হইও না বেশি বেশি পড়-'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল………'

এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর সবার ছোট ননদ বারান্দায় কাপড় শুকাতে গিয়ে ডেসকোর হাই ভোল্টেজ তারে বিদ্যুতপৃষ্ট হয়ে ঝলসে যায়।মরতে মরতে বেঁচে গেছে বেচারী।বামহাতটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে
গেছে।

ওকে দেখে আমার ভীষন কান্না পেয়েছে;আহা!আমার সবার ছোট ননদ।
কতই বা আর বয়স!
'প্রভুহে দয়াময়!আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি তুমি মজলুমের ডাক শোন।আমি মজলুম হয়ে হাত তুলে বলি শান্তাকে তুমি ক্ষমা করে দাও,সুস্থ করে দাও'!
'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল…'

আমার পঁচিশ বছরের স্বামীধন নতুন "বউকে একটি কন্যা সন্তান উপহার দিয়াছে!কন্যার বয়স দুই বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে।সেই কন্যার মামারা দস্যু প্রকৃতির।উহারা আমার প্রাক্তন স্বামী প্রবরকে ঢাকার বাড়ি তাহাদের ভগিনীর নামে লিখিয়া দিতে প্রতিনিয়ত চাপ দিয়া যাইতেছে"!

আমার স্বামী নিজ সন্তানকে অনিরাপদ ভেবে ত্যাজ্য করেছে;বিপদ অন্যদিক থেকে এমন ভাবে আসবে কল্পনায়ও আসেনি!

তিনি প্রায় সময়ই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান।তার কিচ্ছু ভাল লাগেনা।
তিনি সারাক্ষন আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন।

আমি তার শাস্তি চাই বিনাশ চাইনা-তাই মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে লিখি বেশি বেশি এই দোয়াটা পড়ুন-'হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি'য়ামাল ওয়াক্বিল,নি'য়ামাল মাওলা ওয়া নি'য়ামান নাছির'!



©সাইফুল আলম*

03/07/2025

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দরী মেয়ে থাকা হলো সবচেয়ে বড়ো যন্ত্রণার একটা যন্ত্রণা। সৌন্দর্য পূজারী বিশাল বিশাল ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। পিতামাতা সন্তানের উত্তম জীবনের জন্য কোনটা রেখে কোনটা গ্রহন করবে বাছবিচার করা কঠিন হয়ে যায়। অব্যাহত ধারা মোতাবেক এবার আইরাতে'র সম্মন্ধ এসেছে গাজীপুর থেকে। ছেলে লোকমান হোসেন স্থানীয় কোম্পানির ভালো পদে আছে। বেতনও বেশ। বয়োজ্যেষ্ঠ আইরাতের দাদিজান আপত্তি করলেন। ছেলেকে বললেন-

-" এতো দূর দেশে মেয়ে দিস না। তুই মরলেও শেষ দেখা দেখতে আসতে পারবে না। আসপাশের এলাকায় দেখ"

লবন ব্যবসায়ী রুক্ষ মেজাজের ফারুক মোল্লা। কখনো আবেগের বারান্দায়-ও বসে না। সে নিজের মা'কে দ্ব্যর্থহীন জানিয়ে দিলেন-

-" মেয়ে যতদূরে দিবো ততো ভালো। আস্তিক থাকে। বছরে একবার আসবে দুধেভাতে সম্পর্ক থাকবে। ঘরের পাশে ঘর তার তলে পরে মর -এমন সম্পর্ক না। এই হাঁড়ির খবর ওই হাঁড়িতে ; ওই পাতিলের খবর এই পাতিলে? এসব আর বলবে না। দোয়া করো যাতে ছেলে ভালো হয়।"

-"তাই বলে এতো দূরে? এক দেশ থেকে আরেক দেশে?"

আইরাতদের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালি। প্রস্তাব এসেছে ঢাকা গাজীপুর থেকে। আইরাতে'র দাদি চাচ্ছেন না নাতনী চট্টগ্রামের গন্ডির বাহিরে যাক। ফারুক মোল্লা সহিষ্ণুতা বিসর্জন দিলেন। সে অবিচল গলায় বললেন -

-"পারলে সাত সাগর তেরো নদীর ওপারে দিতাম" ফোঁসফোঁসানি শব্দ হচ্ছে পুরুষালি ক্রোধানলে মায়ের দিকে। কয়েক পলক তাকিয়ে উত্তপ্ত গলা নেমে এলো। বারান্দার দরজায় দাঁড়ানো ফারুক মোল্লা ফিরে এসে বসলেন হাতল ওয়লা কাঠের চেয়ারটাতে। বললেন- "এখন আর বাংলাদেশ মধ্যে কোথাও দূর নাই। রাস্তাঘাট ভালো। কাছেকাছে রাখতে চাও আমার পারা লাগবে না? ব্যবসা নামেই আছে। রমজান, ঈদ,কোরবান, জৈষ্ঠ্যমাস, শীতকাল, আরও আরও যা আছে তা ঠেকাবো কি দিয়া?"

"বেগ মাছে গু হায় নাম অদে পাঙ্গাস মাছের"

দু'পক্ষে কথা বলে এলো পাত্রপক্ষ। মুরব্বিদের কথা বলার শেষে লোকমান জানালো একটু আলাদা কথা বলতে চায়।পাত্র পরিচয়ের বাহক লোকমান হোসেন অনুমতি সাপেক্ষে বসলো আইরাতের কামরায় । আইরাতের ছোটো গোছানো কামরায় চোখ বুলিয়ে দেখতে-দেখতে লোকমান হোসেনের চোখ আটকালো আইরাতের পড়ার টেবিলে -" চশমা তোমার? "

বিশাল বিস্ময় ছিলো লোকমান হোসেনের গলায়। আইরাত নরম গলায় জানালো-" জ্বী"

-" কেন চশমা পরো? স্টাইল? "

-" জ্বি না, আমার চোখে একটু সমস্যা আছে। সূর্যের আলো, বই পড়া, ফোন ল্যাপটপের স্ক্রিনে খালি চোখে তাকালে চোখ থেকে পানি পরে "

গল্প শেষ। বিয়ের দফারফা করে লোকমান হোসেনের পরিবার জানালো -" মেয়েতো রোগা। চোখের সমস্যা। আমরা মনে হয় না আগাচ্ছি "

ব্যাস! আর কি লাগে? কিচ্ছু লাগে না। এই পৃথিবীতে সব দোষ মেয়েদের। "মেয়ে" হয়ে জন্মানো দিয়ে দোষ শুরু। এরপর সময় না বুঝে হুট করে ম'রে যাওয়া পর্যন্ত সব দোষ মেয়েদের। এতো দোষের মধ্য থেকে বিয়ে ভেঙে গেলে সেটা একটা উল্লেখযোগ্য দোষ। অবাস্তব শোনালেও সত্যি হলো এই দোষের ঢ্যারা পিটায় মেয়ের পরিবার থেকেই। অথচ অধিকাংশ বিয়ে ভাঙে পাত্র পক্ষের ইচ্ছায়।

" দুই পৃষ্ঠা বই চাবাইছে না? ভাবছে 'আমি যা করবো কেউ কি বুঝবে?' ওসব হইলো বিয়ে যাতে ভাঙে তার জন্য বলেছে- আমার চোখে সমস্যা। এটা কি বলা উচিত ছিলো, না দরকার? বিয়ের পরে তারা আস্তে ধীরে জানতো"

মেজ আপার কাছে বিচার দিলো আইরাতের মা। মেজআপা মুঠোফোনের ওপার থেকে কি বললো আইরাত শুনতে পেলো না। তবে দু'দিনের মৌনতার কারাগার ভেঙে আইরাত প্রতিবাদী কন্ঠে বললো-

" চোখে আমার সমস্যা ; এটা আমি বলবো না? তাছাড়া আমি যেচে বলেছি নাকি? ওই লোকটা টেবিলের উপর চশমা রাখা দেখে জিজ্ঞেস করলো ‘স্টাইল করে পরো?’ তখন বলছি যে - না, আমার চোখে একটু সমস্যা আছে এইজন্য পরি। বিয়ের আগে না জেনে বিয়ের পরে জানলে ভালোর বদলে খারাপই হয়। বিয়ের আগে সমস্যাগুলো জানানো উচিত"

ভাদ্রমাসে তালগাছ থেকে ঢিপঢিপ করে তাল পরার মতো আইরাতের পিঠে উপর্যুপরি কিল পরলো। পরিশ্রমী নারী হাতের দাবাং চড় পরলো আইরাতের কোমল গালে। সাথে চললো নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং বিয়েতে ভাঙানি দেওয়ার প্রমানিত অপরাধের বিধান অনুসারে "অশ্রাব্য গালাগালি"।
তবে বেশিদিন না সপ্তাহখানেক। মাত্র সপ্তাহখানেক সহ্য করতে হলো। এরপরে নতুন প্রস্তাব এলেই মিলিয়ে গেলো পূর্বকার দোষ। এভাবেই গত দুইবছর পালাক্রমে চলছে।
নতুন পাত্রপক্ষের সঙ্গে ছবি বিনিময়ে তারা নাক কুঁচকালেন দূর থেকেই -" মেয়ে কালো"

আইরাত উজ্জ্বল শ্যামারঙা এক মায়াবতী। যাদেরকে নিয়ে কবিরা গাদাগাদা প্রেমের কবিতা লিখেছেন। সাহিত্যিকের কলমের হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাস উৎসর্গ হয়েছে নির্দ্বিধায়।

ফারুক মোল্লা বাজার থেকে ফেরার পথে একই রিক্সায় চড়ে বসলো পাশের বাড়ির মতিন কাকা। তিনি একটা সম্মন্ধ নিয়ে আলাপ বসালো। মেয়ের বিয়েটা দিতে পারলেই ফারুক মোল্লার ঝাড়া হাতপা। সমস্ত দায়িত্ব শেষ। এরপর কোনো কাজ নেই। শুধু খাবে আর ঘুমাবে, ঘুমাবে আর খাবে। ছেলে মতিন কাকার সম্মুন্দির। ভালো আয় ইনকাম করে।

" আয় ইনকাম করে তা-তো বুঝলাম। কিন্তু আমিতো গরিব মতিন ভাই। আমি আর তোমার সম্মুন্দি ; মানায়? কতবড়ো ঘর!"

"মানায় না ক্যান? আইরাত দেখতে ভালো। মাইয়া ভালো। পড়ালেখা করছে। তইলে মানাইবো না ক্যান? "

মতিন কাকার মুখ ভরে উঠছে পানের পিকে। ফিচ করে রিক্সা থেকে পানের পিক নিচে ফেলে আবারও বললো-"কপালের লিখন না যায় খন্ডন। বাড়ি যাইয়া ভাবির লগে কথা কও। ফেনী শহরে তিনতলা বাড়িটা ছেলের নামে। লাখের মতো ভাড়াই ওঠে। আড়তদারি করে। পোলা সালমান খানে। আরকি লাগে?"

মোমেনা কিছু পড়াশোনা জানেন। সহজ ইংরেজি লেখাগুলো তিনি পড়তে পারেন। মতিন কাকা ছেলের সিভিসহ ছবি দিয়ে গেলো দুপুরে। মোমেনার মুখ কালো। মিনমিন করে বললেন-

-" ছেলের বয়সতো চল্লিশ। আমারও বড়ো। "

ফারুক মোল্লা রক্ত চোখে তাকালেন। মোমেনার গলার আওয়াজ আরও ছোটো হলেও তিনি থামলেন না -"আইরাতের ডাবলের-ও বেশি বয়স"

-" পুরুষ মানুষের বয়স বেশি হইলে কি? বয়স ধুইয়া পানি খাবা? পয়সা থাকলে বয়সে কিছু আসে যায় না। চেহারায় কি বয়স বোঝা যায়? দেখছো, দেখতে কত ভালো? বিয়ার সাথেসাথে তোমার মাইয়া জমিদারনী। আর কথা কইও না"

মানুষ বড়োই অদ্ভুত। আইরাতের দাদি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো নাতনীর বিয়ের বিষয় আর কথা বলবেন না। অটল রইতে পারলেন না। নাতনীর মায়ায় ঘায়েল হয়ে বেহায়া হয়ে আবারও বললেন-" কথা নইলে না কইলো, তয় এই কি সেই ছেলে যার বউ নিয়া ঝামেলা ছিলো? বউয়ের বাপ মামলা দিছিলো গুমের। এরপর মতিনের বাড়ি গা-ঢাকা দিছিলো। সেই পোলা?"

মোমেনার মাথা চক্কর দিয়েছে। ফারুক মোল্লা তেমন বিচলিত নয়। তিনি অন্যচিন্তা করছেন।

-" সেই পোলা নইলে আর কি? মতিন ভাইয়ের শালার না তিনটা মেয়ে? সম্মুন্দির ঘরে একটা ছেলে। আমার অবিবাহিত মেয়ে দোজবরে কিভাবে দেই? না, তুমি না কও"

-" বেশি কম বোঝবা। বউ আছে? বিয়ার দুইমাস পরে নাগরের লগে পলাইছে। তাও কতবছর। এখন কি?"

নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনের আধা সমস্যার স্বান্তনা হলো প্রবাদবাক্যে। মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে খাটে ‘শাড়ীর পার ভালো হলে আঁচল হয় না। আবার জমিন হলে পার ভালো না’ মুলকথা হলো - পাত্রের কোনো না কোনোদিক একটু সমস্যা থাকবেই। এটা বড়ো বিষয় না। যেমন- ছেলের বয়স হয়তো চল্লিশের নাকের ডগায়। নইলে ইয়া বিশাল একটা ভুঁড়ি লজিক -বসা কাজ করে । আবার- ছেলের বিয়ে ছিলো। বউ ভেগে গেছে প্রেমিকের সঙ্গে। নিয়মানুসারে এখানে আবার আরেকটা প্রবাদ খাপেখাপে বসে ‘সোনার আংটি বাঁকাও ভালো’ কোথাও শোনা যায় ‘পুরুষ মাইনসের খুঁত কিসের?’ মানে গিয়ে দাঁড়ায় -"ছেলের বিয়ে থাকলেও কিছু আসো যায় না আর মেয়ের আগে বিয়ে হলেই হয় ‘ব্যবহার করা’।

-" এতো প্যাচাইস না বাপ। প্রেমবাজারের ওই পোলার লগে দিয়া দেয়। আসপাশে থাকলো। ভালোমন্দে থাকলি"

-" খাওয়াবে কি? কয় পয়সা ইনকাম করে? থাকার ঘর কেমন তুমি জানো? কাঠের ঘর। কাঁচা মাটি। টিনের চাল। মতিন ভাইয়ের সম্মুন্দির ছেলের তিনতলা বাড়ি আছে। আড়তদার। দোকান ভাড়া আছে। তোমারে মানা করছিলাম, মা। বেশি বোঝবা না"

এটা উনিশ নম্বর সম্মন্ধ। এতোদিন ফারুক মোল্লা ধৈর্য ধরেছে ঠিক নিলামে সর্বোচ্চ দরটার মতো। সবচেয়ে বেশিমূল্য যেখানে পাবেন সেখানে দিবেন। সেক্ষেত্রে ফেনীর ছেলে জিতেছে।
আইরাত গত দু'দিন ঘরে চোরের মতো লুকিয়ে চুপ করে থাকে। মতিন কাকার সম্মুন্দির ছেলের সঙ্গে মুখ ভার করে কথা বলায় সে নাকচ করে দিয়েছে। ছেলের ধারনা "নিশ্চয়ই মেয়ের কোথাও সম্পর্ক আছে" ঘরের হাওয়া আইরাতের বিপরীতে বইছে। বইবে না কেন? অপরাধ কি কম? মোটেই না। আদালতে তুললে এই অপরাধের শাস্তি— যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ; নইলে বিনাশ্রম ফাঁসি।

দুদিন বাদেই সম্মন্ধ আনলো এলাকার জাদরেল ঘটক। যার পেশাদার অবিজ্ঞতায় কোনো হেরে যাওয়ার গল্প নেই। ছেলে চকচকা ঝকঝকা। ছবি নিয়ে এসে হাজার টাকা হাদিয়া হাসিল করেছে আইরাতের মায়ের থেকে। ছেলে পুলিশ। ছবির সাথে বিয়ে দেওয়া যায় না। যদি ছবির সাথে বিয়ে দেওয়ার কোনো দুর্গম রাস্তাও থাকতো মোনেনা সে রাস্তায় গিয়েও মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতো। তবে 'দুর্ভাগ্যের' বদ নজর লেগেছে মনোবাঞ্ছায়। পুলিশ পাত্র জানিয়েছেন-" মেয়ের মুখে ব্রণ। এই বিয়ে ক্যান্সেল"

দোষ আবারও আইরাতের কাঁধে পা ঝুলিয়ে বসে পা নাচাচ্ছে। আইরাতের স্বভাবের ময়নাতদন্ত চললো প্রতি বেলায়। রিপোর্টে বের হলো-" ব্রণ ও ব্রণের দাগের পেছনে হাত আইরাতের। আইরাত পানি খায়? না। যা লাগে তা খায় না। পাখির ঠোটের মতো এক চুমুক পানি খেলে ব্রণ উঠবেই। তারপর দু'নম্বর রিপোর্টে প্রকাশ হলো -"আইরাত ব্রণ নখ দিয়ে চেপে ইচ্ছে করে দাগ ফেলে। যাতে বিয়ে না হয়"

আইরাতের গায়ে জ্বালা ধরে। কে না চায় একটা দাগহীন মসৃণ চেহারা? এইযে মানসিক চাপে আইরাত কত রাত আরামে ঘুমায় না! তার বেলায়? পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে যাবে ভাব। কষ্টে সারাক্ষণ বুকের ভেতর তড়পানি? বিয়ে না হওয়ায় দায়ভার সব তার! এই মিথ্যা দোষারোপের বিষাক্ত তীরের আঘাত? এতো মানসিক যন্ত্রণার একটু প্রভাব চেহারায় পরবে না?

নতুন বিয়ের ঘর আনলো পাশের বাড়ির খালা। এবারের ছেলের ঢাকায় মোবাইলের দোকান। ম্যালা বড়ো গোডাউন আছে "টাকাপয়সার"। ছেলের আইরাতকে দেখে ভীষণ পছন্দ। আবারও এলো মাহেন্দ্রক্ষণ। বশির হক জিজ্ঞেস করলো -" আমাকে তোমার পছন্দ হইছে?"

আইরাত মিথ্যা বলে না। চুপ করে থাকলো সল্পসময়। তারপর বললো- "আমার আব্বু-আম্মু আমার জন্য যা করেন তাতেই আমি রাজি"

আইরাতের গায়ে জ্বর। চোখ টলটল করছে। এতে করে বশির হকের কাছে আরও আকর্ষণীয় লাগছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে অতীতে যা থাকে থাকুক এখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শুধু তার।

" সে ভালো কথা। তোমার কোনো চাওয়া আছে? বলতে পারো আগেভাগে"

" আমি পড়াশোনা করতে চাই"

আইরাত উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। এসএসসি এইচএসসি মিলে তার টোটাল পয়েন্ট ভালো। শুধুমাত্র এই বিয়ের জন্য পাবলিক পরীক্ষায় বসা হলো না। স্বপ্ন ছিলো একদিন উচ্চ শিক্ষিত হয়ে পুত্রহীন বাবা-মায়ের ভরসা হবে। আর এখন?
বশির হক এবার গলা খাঁকারি দিলেন। নড়েচড়ে বসেছেন। কি বলে এই মেয়ে? পড়াশোনা করা মেয়েরা বেপর্দা চলে। নন-মাহারামের সাথে বন্ধুত্ব পাতায়। যা একসময় পরোকিয়ায় রুপান্তর ঘটে। এতে তার আমলনামা থাকবে? আইরাত স্ত্রী হিসেবে সে পাপের বোঝা তার কাঁধেও উঠবে না?

" আমার বউ দিয়ে আমি চাকরি করাবো না সুতরাং আর পড়াশোনার দরকার নেই। মুলকথা হলো- ‘বউ হলো ঘরের খুঁটি, খুঁটির নড়াচড়া যতকম ঘর তত টেকসই"

আইরাত অটল তার মতামতে -" পড়াশোনা শুধু চাকরির জন্য এটা আপনাকে কে শিখিয়েছে? আমি পড়াশোনা করবো। চাকরি করি বা না; সেটা-তো পড়াশোনার পরের অংশ"

বাধ্য হয়ে বশির হক একটু শিথিল হলেন। আইরাতকে যে তার খুব মনে ধরেছে। বিয়েটা হয়ে যাওয়াটাই বেশি জরুরি মনে হলো। তারপর মানাতে কতক্ষণ? জানালেন -" ঠিক আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত উপস্থিতির দরকার নাই। যদি পর্দা মেইনটেইন করে শুধু পরিক্ষাগুলো দিতে পারো তাহলে আমার আপত্তি নেই"

আইরাতের বুকের ধকধকানি বৃদ্ধি পায়। বুঝেছিলো ত্যাছড়া গলায় উল্টো আবদারে এটাও ফিরে যাবে- বাকি বাইশ জনের মতো। বুকে এক, মুখ আরেক!! এটা তো সারাজীবন সম্ভব না। মনটায় যে রাজত্ব করেছে অন্যকেউ। বহু সাহস করে নিজের মনোবাঞ্ছা বাসায় জানালো। -" মুরাদ কে আমি ভালোবাসি। বিয়ে ওর সাথে না দিলে কারও সাথে দেওয়া লাগবে না"

পুরো ঘরটা আচানক ভয়াবহ চুপ হয়ে গেলো। এতো অচেনা বাক্য কেউ কোনোদিন শোনেনি। আইরাতে'র মা সবার আগে শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো -" কি বললি?"

আইরাতের কলিজা শুকিয়ে কাঠ। তৃষ্ণায় ধুঁকছে গলদেশ। জিহ্বাটা পেচিয়ে গিয়েছে। এখুনি সামনে আজরাইল দেখলেও অবাক হবে না। আজরাইল আসলো না তবে আইরাতকে আজরাইলের বাড়ি পাঠানোর বন্দোবস্তো চললো। প্রচন্ড প্রহারে বেসামাল জ্বর। বশির হকের সঙ্গে বিয়ে প্রায় পাকা। দেনমোহর নিয়ে মতবিনিময় চলছে মুঠোফোনে। আইরাতের কানে যাচ্ছে সব। ইচ্ছে করছে ছুটে বেরিয়ে যেতে। মুরাদ সইবে কি করে? এই চিন্তার উত্তাল উত্তাপ জ্বরের মাত্রা বাড়াচ্ছে।

"তারপর?"

জেনিফা থেমে গেলো। মেয়েদের প্লেটের ভাত শেষ। ছোটো মেয়েটা মাত্র নয় বছরের। গল্পের আগামাথা না বুঝলেও তার ভালো লেগেছে। তবে মায়ের চুপ করে থাকা তার ভালো লাগছে না। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো -"তারপর আইরাতের কি হলো? আম্মু থামলে কেন? বলো, কি হলো আইরাতের? কবে, কার সাথে বিয়ে হয়েছিলো?"

"খাওয়া শেষ। গল্প মুলতবি। আবারও আরেকদিন এখান থেকে বলবো। এখন গিয়ে একঘন্টা বই পড়বে তারপর ঘুমাবে। যে কোনো মূল্যে পড়াশোনা করতেই হবে "

জেনিফার বড়ো মেয়েটা এবার মাধ্যমিক দিয়েছে। সে স্থবির হয়ে গেলো। এটা গল্প নয় ;বাস্তব। সে-যে আইরাতকে চেনে তাতে স্বয়ং নেই। কৌতূহল মেটাতে চাইলো -" আইরাতের মেজআপা কেন আইরাতের পাশে দাঁড়ালো না? সে কি পারতো না তার বোনের জন্য কিছু করতে?"

জেনিফা মেয়ের সঙ্গে বাক্য চালাচ্ছে না। তার মেয়েটা বুদ্ধিমতী কিশোরী। জেনিফা জানে তার মেয়ে বুঝে ফেলেছে যে— আইরাত-ই তার মা জেনিফা। এটা তার মায়ের গল্প।

-" সবসময় চাইলেও করা যায়না। মেজআপা চেয়েছে। সে অনেক চেষ্টা করেছে আইরাত'কে পছন্দের মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে। যখন চুড়ান্ত সময় এলো তখন আইরাত নিজেই হাল ছেড়ে পিছিয়ে গিয়েছে। আইরাতের বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা তাকে আগাতে দেয়নি"

-" কিসের কৃতজ্ঞতা? সন্তান জন্ম দিয়ে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন সব বাবা-মা'কে ফরজ করে দিয়েছে। সেখানে কৃতজ্ঞতা শব্দই ব্যবহার কেন?"

-" কেন আসবে না? তোমাকে জন্ম দেওয়া, এতদূর বড়ো করার পরে তুমি কি আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ নও?"

নওমি এবার মিয়িয়ে গেলো। গলার উত্তাপ নিভে গেলো। ভাবুক মেয়েকে পিছে ফেলে জেনিফা কাজে ব্যস্ত। মেজআপা আর দুলাভাই কাল আসবে। আপা মাছ-গোশের থেকে ভর্তা-ভাজি, শাক, ছোটমাছ পছন্দ করে। গৃহিণী হলেও সীমাবদ্ধতা সবার আছে। নির্দিষ্ট পরিশ্রমের পরে গৃহিণীদের শরীরটাও চলতে চায় না। কয়েকদিনের কাজ গুছিয়ে রাখবে যাতে আপার গায়েগায়ে একটু থাকা যায়। সেই যে জেনিফার বিয়ের বিষয় কথা বলে অপমানিত হয়ে বাবার বাড়ি ছাড়া হলো, তারপর আর মেজআপা বাড়ি ফেরেনি। বাবা ফারুক মোল্লার শত আকুতিও মেজআপা-কে গলাতে পারেনি। নরম মাটি পুড়ে শক্ত হওয়ার মতো কোমল হৃদয়ের মেজআপাও শক্ত হয়ে গেলো....

-" তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি, মা"

-"যাও, ঘুমানোর আগে নাহয় ডিকশনারিটা দেখো"

নওমি পিছন থেকে মায়ের কাঁধে মাথা রাখলো। জেনিফা নিজের কাজে মত্ত। চোখের কোনে পানি জমেছে। দোকান থেকে বশির হক খেতে এলো বলে। রাত দশটার বেশি। ভাত চুলায়। এসে টেবিল গোছানো না পেয়ে কাঁটাযুক্ত বিষাক্ত বচনগুলো একটাও পেটে থাকবে না। সব জেনিফার বুকে ঢেলে দিবে।
মেয়ের উল্লেখিত বাক্যখানার উত্তর কন্ঠনালি ভেদ না করে বুকের ভেতর চিৎকার করে উঠলো-

-" বেঁচে থাকলে তোর কৃতজ্ঞতার দাম আমিও দিবো। জন্ম দিলেই কি জুলুম করতে হবে?"

#অনিষ্পন্ন
Nafesa Jannat

02/07/2025

মা আমি যখন বড় হবো, ইনকাম করবো সবার আগে তোমাকে রান্নাঘরে একটা পাখা লাগিয়ে
দিবো।

নিজের সাত বছরের ছেলে শান্তর মুখে এমন কথা শুনে থমকায় রুনা। নিজের ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মোছা হাতটা থমকে যায়।

"আব্বা এদিকে আয় মায়ের কাছে। " রুনা বসে দুই হাত দিয়ে ডাকে ছেলেকে।

শান্ত দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। রুনা ছেলের গালে নিজের অধর ছুঁইয়ে দেয়। শান্ত ও তার মায়ের গালে চুমু দিতে গেলে বলে,,,উহু বাবা গালে অনেক ঘাম। তোর ঠোঁটে লেগে যাবে।

শান্ত এ বিষয়ে মায়ের বারণ শুনার মতো ছেলে না। সে নিজের টিশার্ট উপরে তুলে সযত্নে মায়ের গাল,গলা মুছে দেয়।

তুমি টেনশন করো না মা।আমি একদিন অনেক বড় চাকরি করবো তারপর তোমাকে সবার আগে রান্নাঘরে পাখা লাগিয়ে দিবো। পাখা লাগালে তুমি আর ঘামবে না, আর আমাকেও চুমু খেতে বারন করতে হবে না তোমাকে।

রুনা ছেলের কথায় অনেকটা ইমোশনাল হয়ে যায়। চোখ দুটো কেমন ছলছল করে উঠে। ছেলেটা কবে এতো বড় হয়ে গেলো? এইতো সেইদিন মাত্র টাওয়ালে পেঁচানো ছোট্ট শরীরটাকে নিজের বুকে নিয়েছিল। ছেলের কথাতেই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো সে আর বড় হয়ে তার যত্ন নিক আর না নিক এই কথাতেই মনে প্রশান্তি নেমে আসে।

"আচ্ছা মা আমাদের তিনবেলা না খেলে হয় না? "

"এটা আবার কেমন প্রশ্ন বাবা?"

"শান্ত ঠোঁট উল্টে বলে, দুইবেলা খাবার খেতে হলে ভালো হতো।"

রুনা মুচকি হেসে বলে,, যেনো তোমাকে কম খেতে হয় তাই না? খালি খাবার ফাঁকি দেওয়ার দুষ্টু বুদ্ধি।

উহু্ু দুইবেলা খাবার হলে তোমাকে সারাদিন রান্না করতে হতো না।

আমার জানবাচ্ছাটা। এতো ভাবতে হবে না আমাকে নিয়ে। আম্মু একদম ঠিক আছি। তারপর রুনা কিছু একটা ভেবে বলে,,,আচ্ছা বাবা তুমিকি চাও আমার এই কষ্টের পুরস্কার দিতে?

শান্ত মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানায়।

তাহলে মন দিয়ে পড়াশোনা করো।ভালো মানুষের মতো মানুষ হও। এটাই হবে আম্মুর জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

আচ্ছা মা তাহলে আমি পড়তে যাই?

আচ্ছা যাও।আমি একটু পর খাবার দিচ্ছি।
শান্ত মাথা নাড়িয়ে দৌড়ে চলে যায়।
রুনা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তার স্বামী পকেটে হাত ঢুকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রুনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার শ্বাশুড়ি এসে বলে,,,কি হলো বউমা খাবার কখন খাবো? কতো বেলা হয়ে গেছে দেখেছো,? খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে হবে তো নাকি? হাতটা ভালো করে চালাও।

হ্যা মা এইতো আরেকটু হয়ে গেছে প্রায়।বলে রুনা তারাতাড়ি তার রান্না শেষ করতে থাকে।

রুনা একজন গৃহিণী। স্বামী,সন্তান, শ্বশুর শ্বাশুড়ি, দেবর ননদ নিয়ে তার ভরা সংসার। সংসারের সব দায়িত্ব তার উপরেই। সকল কাজ কর্মও তাকেই করতে হয়। বাড়ির বউ আর মায়েদের কি শীত গরম গায়ে মাখলে হয়? উহু যতো যাই হয়ে যাক না কেনো সংসারের সব কাজ তাদেরকেই সামলাতে হয়।

সকালের রান্না দিয়ে শেষ হয় আর রাতের থালাবাসন ধোঁয়া দিয়ে তার পরিসমাপ্তি হয়।এভাবেই পরিক্রমায় চলে যাচ্ছে।

আজকে ভোরে উঠতে একটু দেরি হয়ে যায় রুনার। রাতে শরীর টা কেমন গরম ছিলো হালকা জ্বর ও এসেছে এজন্য ভালো ঘুম হয়নি।যার কারণে সকালের দিকটায় চোখ লেগে গেছে। রুনার চোখে রোদের আলো পরতেই ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে।
ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখে দশটা বেজে গেছে। রুনার গলা শুকিয়ে যায় সময় দেখে।লাস্ট কবে সে এতো দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছে তার জানা নেই৷। কোনোরকম নিজেকে ঠিক করে দৌড়ে রান্নাঘরে যায়।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখে শান্ত আর তার বাবা কি যেনো করছে।

তোমরা এখানে কি করছো? আমাকে ডাক দাওনি কেনো? আল্লাহ কতো দেরি হয়ে গেছে রান্না করতে হবে তোমরা সরো। তুমি একটু আম্মাকে ম্যানেজ করোনা গো একটু। আমার জাস্ট আধা ঘণ্টা লাগবে রান্না করতে। প্লিজ! অনুরোধ সুরে তার স্বামী কে বলে।

রুনার হাত থেকে পাতিল টা নিতে নিতে তার স্বামী বলে,, তুমি হয়তো ভুলে গেছো আজ মা বাবা ওরা সবাই গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা । আর ওরা সেই ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে গেছে।

রুনার একদমই মনে ছিলো না আজ সকলে গ্রামের বাড়ি যাবে। প্রান্তর অফিসে কাজ থাকায় সে আর শান্ত ও যেতে পারেনি।

আমি ভুলেই গেছিলাম। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,, সরো এবার আমাদের জন্য রান্নাটা সেরে ফেলি।

কোনো দরকার নেই তুমি ফ্রেশ হয়ে টেবিলে গিয়ে বসো আমি আর শান্ত খাবার নিয়ে আসছি।

কি বলো?

ইয়েস। আজ বাপ বেটা মিলে রান্না করেছি।আর ঠিক করেছি যতোদিন ওরা না আসবে ততোদিন তোমার এই গৃহিণী পদ থেকে ছুটি। ইনজয় রুনা।

ইয়েস মা ইনজয় হাসতে হাসতে শান্ত তার বাবার সাথে বলে।

রুনা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয় তাদের দিকে।
প্রান্ত এবার রুনার গালে হাত রেখে বলে,,,স্বপ্ন দেখছো না তুমি শান্তর মা। সত্যি দেখছো তোমার ও মাঝে মাঝে রেস্টের দরকার।

রুনার চোখ ছলছল করে উঠে। চোখের পানি লুকিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। আজ নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। এমন স্বামী সন্তান পেয়ে সে সত্যি খুব ভাগ্যবান। এতো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম কেমন কয়েক নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এতোটুকুইতো পাওয়া জীবনের। এইটুকু সাপোর্ট স্বামী সন্তানের থেকে পেলে সংসারের জন্য বছরের পর বছর লড়াই করে যাওয়া যায়। এটাই জীবনের স্বার্থকতা।

সমাপ্তি।

#অনুগল্প
#স্বার্থকতা।
.

01/07/2025

‘আপার কথা শুনবেন না এখনি আমাদের বাসায় চলে আসেন।’

শওকত পাশ থেকে রিমার গলা শুনতে পায়। হয়তো পাশেই বসে আছে। রিমা বলে যদি তোর ভাইয়া আসে তাহলে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।

শওকত রিমার ছোটোবোন কুহেলীর সাথে কথা বলছে ফোনে। মেয়েটা শওকতকে ভীষণ পছন্দ করে। রিমাদের বাসায় গেলে চুল টেনে দেয়, একসাথে দাবা খেলে। কুহেলী এবার কেবল ক্লাস টেনে পড়ে ওর ধারণা বড় আপার থেকে তার বুদ্ধি বেশি। বড় আপা ভীষণ বোকা।

বোকা না হলে সামান্য মাছ কেনা নিয়ে ঝগড়া করে বাবার বাসায় চলে যায়।

শওকত এই নিয়ে পরপর দুবার মাছ কিনেছে, সমস্যা হলো দুবারই পঁচা মাছ কিনেছে। শওকত কি জানতো মাছ পঁচা হবে। মাছ নিয়ে বাসায় ফেরবার পরে রিমা বলেছে, তুমি এখনি যাবে মাছ ফেরত দিয়ে আসবে। যদি তুমি না যেতে পারো আমাকে সাথে নিয়ে যাবে।

শওকত হেসে বলে, কি দরকার এখন যাওয়ার। থাক না। রিমা বলে থাকবে কেন? তোমাকে সবাই ঠকাবে তুমি চুপচাপ ঠকে যাবে। শওকত বলে এরপর মাছ দেখে কিনবো, হাত দিয়ে ধরে দেখবো।

রিমা সে কথা কিছুতেই শুনে না, শওকতকে মাছ নিয়ে যেতে বলে। শওকত যায় না, দুপুরে ভাত খায় ডিম ভাজি দিয়ে। বিকালে রিমা রাগ করে বাবার বাসায় চলে যায়।

রিমা বাসায় নেই দুইদিন এই দুইদিন খাওয়া নিয়ে বেশ ঝামেলার ভিতরে যেতে হয়েছে। বাইরের খাবার খেয়ে গ্যাস্ট্রিক বেড়ে গেছে। রিমার ছোটো বোন কুহেলী কল দিয়ে বলে, ভাইয়া আপনি আমাদের বাসায় এসে খেয়ে যাবেন। তখনই পাশ থেকে রিমার রাগী গলা শুনতে পায়।

শওকত বলে, কুহেলী আজকে আসবো না। তোমার আপার রাগ কমলে তাকে কল দিতে বলবে। আমি অপেক্ষা করবো।

কুহেলী পাশ থেকে আপাকে উদ্দেশ্য করে বলে দেখ আপা তুই কিন্তু বেশি করছিস। রিমা বলে, তোর দরদ লাগলে তুই যা। কুহেলী বলে আমি যদি রান্না জানতাম অবশ্যই ভাইয়ার জন্যে রান্না করে দিয়ে আসতাম। তখনই ঘরের ভিতরে রিমার মা আসে৷

মা বলে, রিমা এমন সাধারণ বিষয় নিয়ে রাগ করা উচিত না। তোর বাবা সংসার শুরুর প্রথম দিকে এমন করেছে, তবে এখন ঠিক হয়ে গেছে।

‘মা তুমি এই বিষয়টাকে সাধারণ বলছো। এই লোককে সবাই ঠকায় শিক্ষা হয় না। এবার যদি কয়েকদিন হোটেলে খেয়ে শিক্ষা হয়। সে দরদের সমুদ্র নিয়ে এসেছে। পঁচা মাছ দিবে তারপরও চুপ থাকবে, নষ্ট সবজি দিবে কিছু বলতে পারবে না। কেন টাকা দিয়ে কেনা হয় না? নাকি আমাদের ফ্রিতে দেওয়া হয়?’

রিমার মা বলে ঠিক আছে তুই যা ভালো মনে করিস।

শওকত অফিসের জন্যে বের হয়ে যায়। গত দুইদিন সকালে নাস্তা করা হয় না, হোটেলের খাবার খেয়ে পেটের অবস্থা খারাপ।

শওকত অফিসের বারান্দায় কফির মগ নিয়ে বসে আছে তখনি দেখে বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইচ্ছে করছে এখন রিমাকে কল দিতে। রিমার হাতের ভর্তা খিচুড়ির স্বাদের কোনো তুলনা হয় না। রিমাকে একটা প্রেমের কবিতা শুনাতে ইচ্ছে করছে। রিমার কি মনে পড়়ছে না? হয়তো মনে পড়ছে, তবে অভিমানে চুপ হয়ে আছে। শওকত একবার ঠিক করে আজকে রিমাদের বাসায় যাবে। ঢাকা শহরে কদম ফুল দেখা যায়না, তবে উদ্যানের দিকে একটা গাছ আছে। পাশেই ছোটো ছোটো বাচ্চারা থাকে, ওদের বললে কদম গাছে উঠে ফুল এনে দিদে পারে। এই বৃষ্টিতে যদি একজোড়ন কদম ফুল নিয়ে যাওয়া যায় রিমা কি তখনো রাগ করে থাকতে পারবে?

শওকতের কল্পনার জগত বিস্তৃত হয়, যে জগতে রিমা একটা শাড়ি পরে ঘাসের মাঠে হাঁটছে, যেখানে পায়ের গোড়ালি সমান বৃষ্টির পানি। রিমা হেঁটেই যাচ্ছে, শওকত পিছনে দাঁড়িয়ে ডাকছে তবে ফিরছে না হাতে একজোড়া কদম ফুল।

শওকত কফি শেষ করে ডেস্কে বসে। সন্ধ্যা সাতটায় অফিস থেকে বের হয়, বাইরে এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। স্নিগ্ধ একটা বাতাস, বুকভরে সেই বাতাসে শ্বাস নেয়।

চা খাওয়ার জন্যে একটা দোকানে দাঁড়ায়। পাশেই বিরিয়ানির হোটেল, বৃষ্টি হলে বিরিয়ানির হোটেলে বিক্রি ভালো হয়। বেশ ভালোই ভীড় জমেছে এখানে। শওকতের ইচ্ছে করছে এই জায়গা থেকে বিরিয়ানি খেতে। ঠিক করে চায়ের কাপ রেখে এক প্লেট বিরিয়ানি খাবে তারপর বাসায় যাবে। বাসায় যেয়ে কাপড় বদলে রাতে একবার রিমাদের বাসায় যাবে।

বিরিয়ানির হোটেলের পাশে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, গায়ের শার্ট ভেজা, এক হাতে নীল পলিথিন অন্য হাতে কিছু খুচরো পয়সা।

ছেলেটাকে একজন বয়স্ক লোক বারবার হাত সরিয়ে দিচ্ছে। শওকত চা শেষ করে ছেলেটার পাশে দাঁড়ায়। কাঁধের উপর হাত রাখতেই অবাক হয়ে তাকায়। শওকত বলে —

‘কি নাম তোমার?'

‘নয়ন।’

‘কি করো?’

‘ফুল বিক্রি করি। আর বস্তিতে একটা স্কুলে পড়ি। সপ্তাহে দুদিন ক্লাস হয়।'

‘এখানে কি নিতে এসেছো?'

‘মায়ের জন্যে বিরিয়ানি। কালকে থেকে মায়ের অনেক জ্বর। কিছু খাইতে পারে না। আজকে বলেছে আসবার সময় যেনো বিরিয়ানি নিয়ে আসি। তবে ফুল বিক্রি করেছি দুইশো বিশ টাকার। একশো পঞ্চাশ টাকা গেছে মায়ের ওষুধে। হাতে আছে সত্তর টাকা, বিরিয়ানির দাম একশো সত্তর টাকা। বলেছি বাকি দাম পরে দিয়ে দিবো।'

হোটেলের লোকটা নয়নের কথা শুনে শওকতের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাই ওই বাটপারের কথা শুনবেন না। দেখবেন এরপর কোনো খোঁজ নেই আজকে নিয়ে যাবে তারপর আর কোনো খোঁজ থাকবে না।

শওকত লোকটার কথা শুনে আবার নয়নের দিকে তাকায়। নয়নকে বলে, তুমি খাইছো কিছু?

‘না বস্তিতে যেয়ে খাবো। মা তো আর বিরিয়ানি একা খাবে না। আমারেও দিবে অর্ধেক।’

‘তোমার বাবা নেই?’

‘আছে তয় আমাদের খোঁজ নেয় না। আরেকটা বিয়ে করেছে।’

শওকত চুপচাপ নয়নের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হোটেলের লোকটাকে বলে দুই প্যাকেট বিরিয়ানি দেন। শওকতের হাতে দুই প্যাকেট বিরিয়ানি।

নয়নকে বলে, তোমার বাসা কোথায়?

‘ফুলনগর বস্তিতে।’

শওকত একটা রিক্সা ডেকে বলে, ফুলনগর বস্তিতে যাবে?

শওকতের বিরিয়ানি খাওয়ার কথা ছিলো কিংবা ভেবেছিলো কদম ফুল নিয়ে রিমার রাগ ভাঙাতে যাবে তবে কিছুই হলো না। এখন দাঁড়িয়ে আছে ফুলনগর বস্তিতে একটা টিনের ঘরের সামনে। একজন মহিলা দরজা খুলেন। এই মহিলাই নয়নের মা।

নয়ন আর নয়নের মা বিরিয়ানি খায় শওকত পাশে একটা টুলে বসে দেখে। শওকতকেও খেতে বলেছে তবে হেসে বলেছে আপনারা খান আমি খেয়ে এসেছি। এই দুজনের খাওয়ার আনন্দ দেখে শওকতের পেট এবং মন সত্যি ভরে উঠেছে।

শওকত ফুলনগর বস্তি থেকে বের হয়। বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এখন রিমাদের বাসায় যাবে না, সোজা নিজের বাসায় যাবে। এই ভেজা পোশাক বদলাতে হবে।

শওকতের পকেটে থাকা ফোন বেজে উঠে। ফোন বের করে করে দেখে রিমার কল। শওকত ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করে। ওইপাশ থেকে রিমা বলে, কই তুমি? বাসার চাবি নিয়ে গেছো কেন? আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি এসো। আর শুনো আসবার সময় লেবু নিয়ে আসবে, তুমি তো বিরিয়ানির সাথে লেবু খেতে পছন্দ করো। মা বাসা থেকে বিরিয়ানি রান্না করে দিছে।

শওকত কি বলবে বুঝতে পারে না, রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে কাঁচা বাজারে যায়। রিমার মুখে বিরিয়ানির কথা শুনে পেটের ক্ষুধা এখন টের পায়। দুই হালি লেবু কিনে সাথে পথের পাশ থেকে একজোড়া রজনীগন্ধা ফুল নেয়, বৃষ্টির দিনে কদম ফুল পেলে ভালো হতো।

শওকত খেতে বসেছে, পাশেই রিমা বসে আছে। রিমা প্লেটে লেবু চিবকে দেয়। টেবিলের পাশেই একজোড়া রজনীগন্ধা ফুল রাখা। শওকত খেতে খেতে বলে জানো আজকে অফিস থেকে ফেরবার পথে কি হয়েছে? শওকত বলে যায় ফুলনগর বস্তির সেই কথা। রিমা মুগ্ধ হয়ে শুনে। শওকতের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কি জানো আসলেই তুমি অনেক ভালো মানুষ। শওকত বলে, আমি জানি ভালো মানুষ, তাইতো তোমার মতে একজন ভালো বউ পেয়েছি। যে নিজে বিরিয়ানি রান্না করে নিয়ে এসেছে তারপর বলে মা রান্না করে দিয়েছে। রিমা হেসে বলে, তোমাকে এসব কুহেলী বলেছে তাই না? শওকত হাসে। রিমা কল দেওয়ার পরেই কুহেলী কল দেয়, তখন শওকত লেবু কিনছে। কুহেলী বলে, ভাইয়া আপা বাসায় গেছে সাথে আপনার জন্যে বিরিয়ানি নিয়ে, এই বিরিয়ানি কিন্তু আপাই রান্না করেছে। আপনাকে দেখি আপা অনেক ভালোবাসে। শওকত হেসে বলে, হ্যাঁ তোমার আপা একটু রাগী তবে ভালোবাসে একটু বেশিই।

ফুলনগর বস্তির টিনের ঘরের দুজন মানুষের মতো শওকতের মন খুশি হয়ে যায় রিমা এখানে আসায়৷

ফুলনগর

-মুস্তাকিম বিল্লাহ

29/06/2025

বউয়ের সাথে লুডু খেলায় হেরেছি। বউ সকাল থেকে খেপাচ্ছে। মেয়েও কম না, মায়ের মতন সেও ভেংচি কেঁটে খেপাচ্ছে। এদিকে কিছু বলতেও পারছিনা। কারণ বউ বলেছে, যে খেলায় জিতবে আগামি ১ মাস তার কথায় সবকিছু হবে।

এই এক মাস যে আমাকে অনেক অপমান সহ্য করতে হবে সেটা আর জানার বাকি রইল না। রুমে শুয়ে আছি বউ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল....

-একটা ডিগবাজি দেনতো৷

আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম। বললাম....

—মানে?

-মানে কি আবার যা বলছি তাই করেন।

—তাই বলে ডিগবাজি দিবো নাকি?

-অবশ্যই দিবেন এটা আপনার দায়িত্ব।

—এটা আবার কবে থেকে দায়িত্ব হল?

-আমি বলছি তাই আজকে থেকে, কারণ আগামী একমাস আমি যা বলব আপনি তাই করতে বাধ্য!

—করতামনা আমি৷ কার কাছে বিচার দিবা দাও।

-আপনি কথা রাখলেনা হু!

বউ রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো৷ মেয়ে পড়ে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে। ভুলভাল ইংরেজি বলে। সেও এসে বলতেছে, 'আব্বু প্লিজ গিভ মি ডিগবাজি।'

বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। মোতালেব ভাইর চা'য়ের দোকানে দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসতেছে। কিছুই বুঝলাম না। একটু পর একজন বলল, 'রুবেল আমাদের মান-ইজ্জততো আর রাখলানা।'

আরেকজন বলল, 'মিয়া মহিলা মাইনষের সাথে হাইরা গেলা জীবনে কি করলা?'

সবাই এটা ওটা বলতেছে। তারপর একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল ফেসবুক চেক করতে। আমি ফেসবুকে গেলাম। যা দেখলাম তাতে চক্ষু ছানাবড়া।

আব্বা ফেসবুকে পোস্ট করেছে, 'আমার ছেলে আজকে লুডু খেলায় বউমার কাছে হেরে গেছে। রুবেলের আজকে মন খারাপ। স্বামী সমাজের জন্য রুবেল এই সমাজের বোঝা। আমি চাই ওর হোক সাজা।'

বুঝলাম না এখানে স্বামীসমাজ আসলো কোত্থেকে। আর স্বামী সমাজ জিনিসটাই বা কি, অদ্ভুত। সেই পোস্ট আবার আম্মা শেয়ার দিয়ে ক্যাপশন দিছে...

''এই পৃথিবীর বুকে শুধু ছেলেরা না, মেয়েরাও অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু এই সভ্য সমাজ মেয়েদের দাম দেয়না। হিপোক্রেট রুবেল, হিপোক্রেট সমাজ, হিপোক্রেট রাষ্ট্র।''

আজব! আমি কি করলাম? আমি কেমনে হিপোক্রেট হলামরে ভাই! আম্মার কাজকর্ম দেখে হতাশ হলাম। সেই পোস্টে কমেন্ট করলাম, 'সোর্স কি? কিসের ভিত্তিতে আমাকে হিপোক্রেট বললা?'

আম্মার পোস্টে ড্রাইভার মোখলেস কমেন্ট করেছে,

''জীবনের এই খেলায়, আমি লুডুর গুটি,
রুবেল ভাই হেরে গেলো, ভেঙে গেল খুটি।
খুটির নাই জোর, তবুও সেটা শক্ত,
জন্ম থেকে আমি রুবেল ভাইর ভক্ত।

রুবেল ভাই গেছে হেরে, দুঃখ নেই তাতে,
যত দুঃখ আসুক তবু, আছি রুবেল ভাইর সাথে।
ভাইয়ের জন্য ভাই আমি, দিয়ে দিব জান,
প্রয়োজনে কেটে দিব নিজেই নিজের কান।''

ওর কবিতা দেখে আরও রাগ উঠলো। যা দেখছি তাতে বুঝলাম এরা আমাকে ভাইরাল করে ছাড়বে। চলে গেলাম বাসায়। আব্বাকে বললাম.....

-এখনি এই পোস্ট ডিলিট করো।

আব্বা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল.....

—লুডু খেলায় হেরে আবার এত বড় বড় কথা?

-তো হারতেই পারি, খেলায় হারজিত আছেই। তাই বলে এসব ফেসবুকে বলে বেড়াবা?

—আমার পার্সোনাল আইডি যা ইচ্ছে করব৷ একটু পরে টুইটারেও দিব, সমস্যা?

মায়ে'র কাছে গিয়ে সুন্দর করে বোঝালাম যে আমি হিপোক্রেসি না। মা বুঝলানা। বউ যে কি বুঝাইছে এদের কোন দামই দিচ্ছেনা। সব শেষে বুঝলাম এরা সবাই বউয়ের পক্ষে। আমার পক্ষে যদিও আমার মেয়ে আছে কিন্তু সে বলেছে আগে ডিগবাজি দিতে।

রুমে গিয়ে বউকে বললাম....

-আব্বারে কও পোস্ট ডিলিট করতে।

—পোস্ট করেছে আব্বু আমি না করার কে?

-শিখিয়ে তো তুমি দিয়েছো তাইনা?

—সোর্স কি? প্রমান কি?

-প্রমান আমার মাথা৷ তারাতাড়ি পোস্ট ডিলিট করতে বলো।

—তার আগে ডিগবাজি দেন।

-দিমুনা।

—পোস্টও ডিলিট হবেনা।

বউয়ের সাথে কথায় পারলামনা। এদিকে কুটনিতে মুখ টিপে হাসতেসে। বেহায়া মেয়ে৷ বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম, 'স্বামীর অসহায়ত্বে পাশে থাকেনা যে জন, কে বলে বউ তারে খ&%বিশা সে জন।'

—খ&%বিশা কি? (অবাক চোখে বলল বউ)

-খ&%বিশের স্ত্রীবচন। (আমি)

—যাই বলেন লাভ হবেনা।

আমিও আর জোর করলামনা। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম ডিগবাজি দিব। সবকিছু রেডি আমিও প্রস্তুত। বউ হাসতেছে, মেয়েও বসা। মনে হচ্ছে সার্কাস হচ্ছে। আমি দিলাম ডিগবাজি। অমনি গেলাম পরে, কোমড়ে ব্যাথা পেতেই মাগো বলে চিৎকার দিলাম। সবাই দৌড়ে আসলো।

'কি হয়েছে/ কি হয়েছে?' বলে আব্বা আম্মা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম এমনি পরে গেছি কিছু হয়নি। বউ আর মেয়ে হাসতেছে সমানে। মেয়ে সব ঘটনা খুলে বলতেই আব্বা আম্মাও হাসতে থাকলো। আমার রাগ করা দেখে আব্বা আম্মা চলে গেলো।

ব্যথা পেয়েছি হালকা। খুব বেশিওনা। বউ মলম লাগিয়ে দিলো। মেয়ে বলতেছে, 'আব্বু প্লিজ গিবমি এনাদার ডিগবাজি।' মেয়ের কান ধরে বাইরে পাঠালাম, যা ভাগ। বউ বলল....

-ব্যথা কি খুব বেশি পাইছেন?

—না ভালো লাগছে। পারলে লা&%ঠি দিয়ে আরেকটা বা&%রি মা&%রো।

-সরি।

বউয়ের মন খারাপ হলো। লে হালুয়া! মনতো আমার খারাপ হওয়ার কথা। বললাম,

-থাক মন খারাপ করোনা। ঠিক হয়ে যাবে।

—আমি সত্যি সরি, বুঝতে পারিনি ব্যথা পাবেন।

-আরে সমস্যা নাই বাদ দাও।

—তাহলে আরেকটা কথা বলি? রাগ করবেননা কিন্তু, প্রমিস করেন।

-বলো রাগ করবনা।

—ব্যথা সেরে গেলে আবার ডিগবাজি দিয়েন প্লিজ।

মুহূর্তেই আমার মুখ বাংলার পাঁচের মতন হয়ে গেলো৷ আল্লাহ আমারে ধৈর্য দাও, নাহলে রশি ফালাও উপরে উঠে যাই। বউ আবার হাসতে থাকলো। আমি কোমড়ে ব্যাথা নিয়ে বললাম, 'আল্লাহ তোমারে হেদায়েত দিক।' বউ জোরেজোরে হাসতে থাকলো। বউকে সুন্দর লাগছে খুব। আপাতত বউয়ের হাসিমুখ দেখেই ব্যথা কমাচ্ছি৷
লেখাঃ Md Rubel Hasan

Address

Singapore

Telephone

+6598993042

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when নীল ক্যাফের ভালোবাসা posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share