
23/09/2025
💞🌿নন্দ থের: সেসময় ভগবান বুদ্ধের ভাই মাসীমার ছেলে আয়ুষ্মান নন্দ অনেকজন ভিক্ষুকে বললেন, ‘বন্ধুগণ, আমি অনিচ্ছার সাথে ব্রহ্মচর্য আচরণ করতেছি, ব্রহ্মচর্য পালন করতে পারতেছি না। আমি (শীলাদি) শিক্ষা (ত্রয়) ত্যাগ করে গৃহী হব। এ কথা শুনে একজন ভিক্ষু ভগবানের কাছে গিয়ে তাঁকে বন্দনা করে একপাশে বসে বললেন, ভন্তে, ভগবানের মাসতুতু ভাই আয়ুষ্মান নন্দ ভিক্ষুগণকে বলতেছেন যে তিনি অনিচ্ছার সাথে ব্রহ্মচর্য আচরণ করতেছেন, ব্রহ্মচর্য রক্ষা করতে পারতেছেন না, শিক্ষা ত্যাগ করে গৃহী হবেন। তখন ভগবান অন্য একজন ভিক্ষুকে বললেন, ভিক্ষু, তুমি যাও, নন্দ ভিক্ষুকে আমি ডাকতেছি বলে বলো। ‘আচ্ছা ভন্তে’ বলে সেই ভিক্ষু ভগবানকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আয়ুষ্মান নন্দের কাছে গেলেন এবং তাঁকে বললেন, ‘বন্ধু, আসুন আপনাকে শাস্তা ডাকতেছেন। ‘আচ্ছা বন্ধু’ বলে আয়ুষ্মান নন্দ সেই ভিক্ষুকে প্রত্যুত্তর দিয়ে ভগবানের কাছে উপস্থিত হলেন এবং ভগবানকে অভিবাদন করে একপাশে বসলেন। তখন ভগবান তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে নন্দ, তুমি কি সত্যসত্যই ভিক্ষুগণকে এইরূপ বলতেছ যে তুমি অনিচ্ছার সাথে ব্রহ্মচর্য আচরণ করতেছ, ব্রহ্মচর্য পালন করতে পারতেছ না, শিক্ষা ত্যাগ করে (ভিক্ষু হতে) হীন স্থানীয় গৃহী হবে? ‘হ্যাঁ ভন্তে।’ ‘হে নন্দ, তুমি কেন অনিচ্ছার সাথে ব্রহ্মচর্য আচরণ করতেছ? কেনই-বা ব্রহ্মচর্য রক্ষা করতে পারতেছ না? কেন শিক্ষা ত্যাগ করে গৃহী হবে? ‘ভন্তে, শাক্যকুমারী জনপদকল্যাণী চুল আধা আঁচড়ে আমি চলপ আসার সময় আমাকে অনুরোধ করল, ‘হে আর্যপুত্র, মুহূর্তের মধ্যে ফিরে আসবেন।’ ভন্তে, আমি সেই কথা মনে করে অনিচ্ছার সাথে ব্রহ্মচর্য আচরণ করতেছি, ব্রহ্মচর্য রক্ষা করতে পারতেছি না। তাই শিক্ষা ত্যাগ করে হীন গৃহী হব।
নন্দের কথা শুনে বলবান পুরুষ যেমনভাবে কুড়ান বাহু মেলে অথবা মেলা বাহু কুড়ায় এমনভাবে ভগবান নন্দের বাহু ধরে জেতবন হতে অন্তর্ধান হলেন। বুদ্ধ নন্দকে নিয়ে অরণ্যপথে অনেক দূর যাবার পর এক অগ্নিদগ্ধ অরণ্যে পৌঁছলেন। সেখানে আধপোড়া একটি গাছের গুঁড়ির ওপর কুঁচকানো চামড়া, বৃদ্ধা, নাক-কান কাটা এক কুৎসিত বানরী দেখা গেল। এই কুৎসিত বানরীটাকে দেখিয়ে বুদ্ধ নন্দকে প্রশ্ন করলেন ‘নন্দ বলো তো এটা কী?’ উত্তরে নন্দ বললেন, ‘এটা একটি বানরী।’ বুদ্ধ পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘বলো তো নন্দ এই বৃদ্ধা বানরী আর শাক্যকুমারী জনপদকল্যাণী কে বেশি সুন্দরী?’ তা শুনে নন্দ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বুদ্ধকে বললেন, ‘ভন্তে, রাজনন্দিনী জনপদকল্যাণীর সঙ্গে কারও কি তুলনা করা চলে? আপনি আমার মনে প্রচণ্ড আঘাত দেবার প্রত্যাশায় আমাকে এরূপ প্রশ্ন করছেন তাই নয় কি?’ তার উত্তরে বুদ্ধ বললেন, ‘তুমি আমার ছোটো ভাই, তোমার মনের দুঃখ কোথায় তা জানার জন্য এবং মনের সৌন্দর্যবোধ পরীক্ষাচ্ছলে এভাবে প্রশ্ন করছি, এতে তোমার দুঃখ করার কী আছে? এ কথা বলে বুদ্ধ নন্দকে নিয়ে অতিদ্রুত তাবতিংস দেবলোকে গেলেন।কপোতের পায়ের ন্যায় রাঙাচরণা পাঁচশত অপ্সরা তখন দেবরাজ ইন্দ্রের সেবা করতে এসেছিলেন। তখন ভগবান আয়ুষ্মান নন্দকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে নন্দ, তুমি ওই কপোতের পদের ন্যায় পদবিশিষ্টা অপ্সরা সকল দেখতেছ কি?’ ‘হ্যাঁ ভন্তে’ ‘হে নন্দ, শাক্যকুমারী জনপদকল্যাণী বেশি সুন্দরী, না এই কপোতচরণা অপ্সরা পাঁচশত বেশি সুন্দরী? ‘ভন্তে, এই অপ্সরাগণের তুলনায় জনপদকল্যাণী যেন নাক-কান কাটা একটি আধপোড়া বানরী, এদের কাছে সে নগণ্যা, তুলনায় অযোগ্যা, এমনকি কলাপ্রমাণ বা কলাংশপ্রমাণও (ষোল ভাগের একভাগও) সুন্দরী হবে না। এরাই অধিকতর সুন্দরী দর্শনযোগ্যা এবং আনন্দদায়িনী।’
ভগবান : ‘হে নন্দ, প্রব্রজ্যায় তুমি বিশেষভাবে রমিত হও, রমিত হও। তুমি ওইরূপ পাঁচশত অপ্সরা পাওয়ার জন্য আমি জামিন রইলাম।’
নন্দ : ভন্তে ভগবান, আপনি যদি আমার ওইরূপ পাঁচশত অপ্সরা লাভের জামিন হন, তবে আমি ভগবানের ব্রহ্মচর্যধর্মে বিশেষভাবে রমিত হব।’
তারপর ভগবান পুরুষের সংকুচিত বাহু প্রসারণের ন্যায় বা প্রসারিত বাহু সংকুচনের ন্যায় ভগবান নন্দের বাহুতে ধরে তাবতিংস [ত্রয়ত্রিংশ] স্বর্গে অন্তর্ধান হয়ে জেতবনে উপস্থিত হলেন। ভিক্ষুগণ শুনলেন, ভগবানের মাসতুতো ভাই আয়ুষ্মান নন্দ অপ্সরা লাভের জন্য ব্রহ্মচর্য পালন করতেছেন। ভগবান নাকি এর জন্য পাঁচশত অপ্সরা লাভের জামিন হয়েছেন। তারপর হতে আয়ুষ্মান নন্দের বন্ধু ভিক্ষুগণ আয়ুষ্মান নন্দকে ভৃত্য ও উপক্রেতা বলে ডাকতে লাগলেন। আয়ুষ্মান নন্দ নাকি চাকর, উপক্রেতা; তিনি অপ্সরা লাভের জন্য ব্রহ্মচর্যাচরণ করতেছেন, তখন আয়ুষ্মান নন্দ বন্ধু ভিক্ষুগণের ভৃত্য ও উপক্রেতাবাদকে অত্যন্ত ঘৃণা করে বিবেকস্থানে একাকী অপ্রমত্ত, উৎসাহশীল, সমাধিস্থ ও নির্বাণগতচিত্ত হয়ে বাস করতে করতে অচিরে সেই ব্রহ্মচর্যের অবসানভূত অর্হত্ত্ব স্বীয় অভিজ্ঞা দ্বারা লাভ করেছিলেন, যার জন্য কুলপুত্রগণ গৃহ হতে অনাগারে প্রব্রজ্জিত হন। তাঁর কর্তব্য শেষ হল এবং এই লোকে আর আসবেন না বলে জানলেন, অর্থাৎ আয়ুষ্মান নন্দ একজন অর্হৎ হলেন।
সেই রাতের শেষ ভাগে কোনো এক দেবতা জেতবন আলোকিত করে ভগবানের নিকট আসলেন; এবং ভগবানকে অভিবাদন করে একপাশে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে সেই দেবতা ভগবানকে বললেন, ভন্তে, ভগবানের মাসীমার পুত্র আয়ুষ্মান নন্দ ইহলোকেই আসক্তিক্ষয় করে অনাস্রব চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি নিজ অভিজ্ঞাবলে লাভ করে বিহার করতেছেন। ভগবানও (দিব্যজ্ঞানে) জানতে পারলেন যে নন্দ ইহলোকেই আসবক্ষয়হেতু অনাসব চিত্তবিমুক্তি, প্রজ্ঞাবিমুক্তি স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা লাভ করে বিহার করতেছে।
অনন্তর আয়ুষ্মান নন্দ সেই রাত গত হলে ভগবানের নিকট এসে তাঁকে অভিবাদনপূর্বক বললেন, ‘ভন্তে, আমার পাঁচশত অপ্সরা লাভের জন্য ভগবান যে জামিন হয়েছিলেন, এখন আমি ভগবানকে ওই জামিন হতে মুক্ত করতেছি।’
ভগবান বললেন, ‘হে নন্দ, আমিও চিত্তের দ্বারা চিত্ত অবগত হয়ে জানতে পেরেছি যে, তুমি আসবসকল ক্ষয় করে ক্ষীণাসব হয়েছ এবং ইহজন্মেই অভিজ্ঞাদ্বারা চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি লাভ করে বিহার করতেছ। একজন দেবতাও রাতে আমাকে ওই কথা বলেছে। যে হতে তুমি আসক্তিহীন হয়ে আসবক্ষয়হেতু ক্ষীণাসব হয়েছ, যখন হতে তোমার চিত্ত পাপ হতে মুক্ত হয়েছে, তখন হতেই আমি সেই জামিন হতে মুক্ত হয়েছি।’
আয়ুষ্মান নন্দের বিষয় সর্বতোভাবে অবগত হয়ে ভগবান তখন এই প্রীতিগাথা উচ্চারণ করেছিলেন :
আর্যমার্গ সেতু দিয়ে
ভবপঙ্ক হয়েছে যে পার,
সেই জ্ঞান দণ্ডাঘাতে
কামকাঁটা মর্দিত যাঁর,
অবিদ্যার ক্ষয়জ্ঞান
যে ভিক্ষুর হয়েছে উদয়,
সুখে-দুঃখে লোকধর্মে
সেই ভিক্ষু কম্পিত না হয়।