04/18/2025
part:4
খিলাফাহ কিভাবে মুসলিম বিশ্বে শিল্পায়ন ঘটাবে?
১. প্রতিরক্ষা কেন্দ্রীক অর্থনীতি গড়ে তোলা:
কোন অর্থনীতি যে সেক্টরে বেশি গুরুত্ব দেয় তার ভিত্তিতেই সে অর্থনীতির চরিত্র নির্ধারিত হয়। সেই সেক্টরটিই অন্যান্য সেক্টরের জন্য চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় ১৯৮০র দশক পর্যন্ত বৃটেনের অর্থনীতি ছিল মূলতঃ ম্যানুফ্যাকচারিং কেন্দ্রীক। কিন্তু ৮০র দশক থেকে সেখানে সেবাখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে বৃটেনের অধিকাংশ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিদ্যুৎ, পানি, পয়নিস্কাশন, টেলি কম্যুনিকেশন, তথ্যপ্রযুক্তি, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট ইত্যাদি সেবাখাতকে ঘিরে আবর্তিত। এসব সেবাখাতের প্রয়োজনেই অন্যান্য অর্থনৈতিক সেক্টর নিজেকে গড়ে তুলছে। কিন্তু খিলাফতের অর্থনীতি হবে প্রতিরক্ষাশিল্প কেন্দ্রীক অর্থনীতি। উন্নত প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা ও তার ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি ও আধুনিকায়নই হবে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। এধরণের অর্থনীতি যে শুধুমাত্র কর্মসংস্থান ও সম্পদ সৃষ্টি করবে তা নয় বরং বৈরী পরাশক্তিগুলোর আগ্রাসী পরিকল্পনা থেকেও খিলাফতকে রক্ষা করবে।
প্রতিরক্ষা কেন্দ্রীক অর্থনীতির অপরিহার্য করণীয় হলো সমরাস্ত্র তৈরীর কারখানার পাশাপাশি সাপোর্ট ইন্ডাষ্ট্রি হিসেবে স্টীল, লোহা, কয়লা, যানবাহন নির্মান, খনিজ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি শিল্প গড়ে তোলা।
রাষ্ট্রকে শিল্পোন্নত করতে হলে আরেকটি বিষয় প্রয়োজন আর তা হলো এমন একটি ফোরাম গড়ে তোলা যারা সুনির্দিষ্টভাবে শিল্পপতিদেরকে নিয়ে কাজ করবে এবং সব সময় তাদেরকে উৎসাহ যোগাবে। ভারী শিল্পের প্রয়োজনে সাপোর্ট ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে তোলার কাজটি অনেকাংশেই শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে করতে হবে এবং এক্ষেত্রে তাদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করার সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় পলিসি থাকতে হবে। দরকার হলে লোহা, কেমিক্যাল ইত্যাদি শিল্পের জন্য উদ্যোক্তাদেরকে বিনামূল্যে সরকারী জমি বরাদ্দ দিতে হবে। খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও অন্যান্য কেমিক্যাল নিস্কাশনের জন্য যৌথ বিনিয়োগের নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে; যেসব শিল্প রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তায় সরাসরি অংশগ্রহণ করছে তাদের ক্ষেত্রে কর রেয়াত ও ঋণ প্রদানসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করতে হবে।
১৯৫২ সালে যখন জাপানে মার্কিন দখলদারিত্বের অবসান ঘটলো তখন জাপান ঠিক এ ধরণের নীতি গ্রহন করেছিল। উত্তর কোরিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া কমিউনিজমের হুমকি মোকাবেলায় জাপান তখন তার সেরা ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের কাজে লাগায়। আর স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে তারা মার্কিনীদের কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেয়েছিল।
শিল্পবিকাশের সুযোগ সৃষ্টির জন্য তখনকার জাপান সরকার অংশীদারী ব্যবসার শর্তসমূহ শিথিল করে এবং বড় বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অনুমোদন দেয়। সেসময় যে সব বিজনেস হাউসের জন্ম হয়েছিল এখনও তারা জাপানের অর্থনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। বড় বড় শিল্পপতিরা তখন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে বুঝেছিল যে রাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী বিনিয়োগ করলে তারা স্বল্প সময়েই বড় পুঁজি সৃষ্টি করতে পারবে। এদিকে মার্কিনীরাও সেসময় জাপানের কাছ থেকে সামরিক রসদ কেনা শুরু করে, ফলে বিশ্ব বাজারে জাপানী পণ্যের বিশাল চাহিদা সৃষ্টি হয়। শিল্প স্থাপনের এই কর্মযজ্ঞের কারণে অর্থনীতিতে সম্পদের প্রবাহ বেড়ে যায় এবং অনেক বিনিয়োগকারী কৃষি এবং টেক্সটাইলের মতো মন্থর প্রকৃতির অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে পুঁজি সরিয়ে এনে অত্যাধুনিক কলকারখানা গড়ে তোলে।
এভাবে উদ্যমী বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগীতামূলক অংশগ্রহণের ফলে জাপানের মন্থর প্রকৃতির শিল্পসমূহ এক সময় অত্যাধুনিক যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরীর শিল্প দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। ১৯৭০ সাল নাগাদ জাপানের শিল্পপণ্যের তালিকার প্রথম দিকে স্থান করে নেয় রঙিন টিভি, এসি, পেট্রোকেমিকেলের মতো অনেক উন্নত প্রযুক্তির পণ্য যার কোন কোনটি এর ২০ বছর আগে জাপানের মানুষ চোখেই দেখেনি।
অনুরূপ নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে খিলাফত ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজিকে রাষ্ট্রের পরিকল্পনার সাথে সংযুক্ত করবে এবং প্রধান প্রধান শিল্পপতিদেরকে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট থাকবে। আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে যে এমনকি আজকের দুঃখজনক বাস্তবতায়ও মুসলিম বিশ্বে ধনাঢ্য শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর কোন অভাব নেই। রাষ্ট্রের পরিকল্পনার মধ্যে বড় অর্থনৈতিক লাভের সম্ভাবনা দেখলে আমাদের বর্তমান সম্পদশালীরাও কৌশলগত শিল্পে বড় বিনিয়োগে অবশ্যই উৎসাহিত হবে। এছাড়া পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদেরকে যদি লাভের পাশাপাশি দেশ ও জনগণের কল্যাণের বিষয়টিও বোঝানো যায় তাহলে তাদের উৎসাহ ও উদ্যাম নিঃসন্দেহে আরো বৃদ্ধি পাবে।
২. রাজনৈতিক আকাংখা:
মুসলিম বিশ্ব শিল্পায়নের দিক থেকে পশ্চাৎপদ থাকার একটি মূল কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক আকাংখার অনুপস্থিতি। মুসলিম শাসকরা এতদিন আমাদের দেশগুলোকে শুধুমাত্র পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বাজারে পরিণত করার নীতি বাস্তবায়ন করেছে। তথাকথিত মুক্তবাজার ও মুক্তবাণিজ্যের ধারণা সব সময়ই আমাদের দেশগুলোর শিল্প কারখানা ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। শিল্প কারখানা বলতে যা অবশিষ্ট আছে সেগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে মূলতঃ পশ্চিমাদের ভোগের সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে। সার্বিক আদর্শিক শূণ্যতার মাঝেও যখনই কোন মুসলিম রাষ্ট্র রাজনৈতিক পরিকল্পনাকে সম্পৃক্ত করে শিল্প স্থাপন করেছে তখনই তারা সরাসরি লভবান হয়েছে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় পাকিস্তান আঞ্চলিক রাজনীতিতে টিকে থাকতে গিয়ে পারমানবিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল এবং অবশেষে সে পারমানবিক শক্তির অধিকারী হতেও সক্ষম হয়েছে; মিশরও ৫০ এর দশকে অনুরূপ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল কিন্তু ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের কাছে পরাজিত হওয়ার পর দেশটি তার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে।
খিলাফাহ যখন আবার প্রতিষ্ঠিত হবে তখন তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে অভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আকাংখার ভিত্তিতে সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে একতাবদ্ধ করা। যখন খিলাফাহ রাষ্ট্রের জনগণ একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যের ব্যাপারে একমত হবে তখন তারা সবাই সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে থাকবে। এক সময় মুসলমানদের বাকী ভূ-খন্ডগুলোও এ ব্যাপারে একমত হবে এবং তারাও খিলাফাহ্র সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য অগ্রসর হবে। বর্তমানে বিদ্যমান পরিকল্পনাহীনতা থেকে খিলাফাহ উম্মাহকে বের করে আনবে এবং সুনির্দিষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের সকল দক্ষ ও অভিজ্ঞ নাগরিককে একতাবদ্ধ করবে।
বৃহত্তর জনগণের আস্থা সৃষ্টির জন্য যা সবচেয়ে কার্যকর তা হলো যথাযথ সামরিক সক্ষমতা। নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষা এবং শত্রুকে পরাজিত করার জন্য একটি বৃহৎ ও অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনীর কোন বিকল্প নেই। এ ধরণের একটি সামরিক শক্তির আকাঙ্খা, যা এই মুহুর্তে মুসলিম বিশ্বে অনুপস্থিত, স্বাভাবিকভাবেই খিলাফতকে দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে ধাবিত করবে যার জন্য প্রয়োজন হবে ব্যাপক শিল্পায়ন। আর শিল্পায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে কারিগরি দক্ষতা আর কাঁচামালের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ। এ দুটি পূর্বশর্ত কিভাবে পূরণ হবে সে জন্যও আমাদের যথাযথ নীতি ও কৌশল থাকতে হবে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ। কমিউনিষ্টরা ক্ষমতায় আসার পর ১৯২৮ সালে ৫ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে যার উদ্দেশ্য ছিল দেশে ভারী শিল্পের শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলা।
সে সময় গৃহীত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ছিল কতগুলো অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রার সমষ্টি মাত্র। ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ এর মাঝামাঝি ইউএসএসআর- এর অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য এসব লক্ষমাত্রা গ্রহণ করা হয়েছিল, যেসকল পদক্ষেপগুলোর মধ্যদিয়ে জাতিটি শিল্প ও সামরিক দিক থেকে স্বনির্ভর হতে চেয়েছিল।
সেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির পদ্ধতিগত উন্নয়নের মধ্যদিয়ে ভারি শিল্পের দিকে ধাবিত হওয়া, তথা ভারি শিল্পের মাধ্যমে আদিম কৃষিভিত্তিক জাতি থেকে শিল্পোন্নত ও সামরিক দিক থেকে একটি শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হওয়া। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্টালিন তার শাসনামলে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা ও সম্পদকে কয়লা, লোহা, স্টিল ও রেলওয়ের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি উৎপাদনে নিয়োগ করেছিলেন। ম্যাগনিটোগোর্সকের মতো ইউরালের অন্তর্গত নতুন নতুন শহরগুলোতে উৎসাহী তরুণ কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর চেষ্টাও চালানো হয়েছিল।
৩. খনিজ প্রক্রিয়াকরণ:
নিজস্ব খনিজ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উপর পূর্ণ নিযয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য ও অন্য জাতির উপর নির্ভশীলতা কমানোর লক্ষ্যে খিলাফত রাষ্ট্র তার খনিজদ্রব্য উত্তোলন, প্রক্রিয়াকরণ ও শোধনাগার তৈরি করবে। যেহেতু কাঁচামাল শিল্পের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, কাঁচামালকে ঘিরে আমাদের মূল উদ্দেশ্য থাকবে পরনির্ভশীলতা কমানো।
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী একটিমাত্র দেশ পাকিস্ত্মানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সম্পদ হলো- তেল, গ্যাস, সোনা, ক্রোমিয়াম, লোহা, কয়লা, বক্সাইট, কপার, এন্টিমনি, সালফার, লাইমস্টোন, মার্বেল, বালি, রক-সল্ট এবং সিরামিকের ক্লে বা কাদামাটি। যেহেতু খিলাফত অন্যান্য মুসলিম ভূ-খণ্ডগুলোকেও একীভূত করার মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে, তাই অন্যান্য দেশ গুলোর সম্পদগুলোও খিলাফতের আওতায় আসবে। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই খিলাফতের অভ্যন্তরীণ সম্পদগুলোর উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণের নীতি বিদেশী কারিগরি দক্ষতার উপর নির্ভশীল রাখা হবে না।
মুসলিমদের বেশিরভাগ সম্পদই প্রক্রিয়াকরণ করা হয় বিদেশী কম্পানিগুলোকে দিয়ে তথা আমেরিকান কম্পানিগুলোকে দিয়ে। উত্তোলনের নামে এসব সম্পদের বেশিরভাগ অংশই এসকল পশ্চিমা কম্পানিগুলোকে দিয়ে দেওয়া হয়। কখনও কখনও দেশীয় তেল কম্পানিগুলোকেও বেসরকারিকরণের নামে বিক্রি করে দেয়া হয় ঐসব কম্পানিগুলোর কাছে।
খনিজ প্রক্রিয়াকরণে স্বনির্ভশীল হওয়ার জন্য বেশকিছূ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেসকল সম্পদ খিলাফতের মধ্যে থাকবে না সেগুলো অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে আনা হবে। ইদানিং চীনও একই নীতি গ্রহণ করেছে। চীন তার তেলের প্রয়োজন মেটাতে আফ্রিকান দেশগুলোতে তেলের বিনিময় প্রচুর পরিমানে অন্যান্য সাহায্য প্রদান করে চলেছে। পাশ্চাত্য নীতির অনুসরণেই চীন এখন আফ্রিকায় প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠানসহ দরকারী রাস্তা-ঘাট, স্কুল, হাসপাতাল ও অফিস-আদালত গড়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক ইন্দো-আফ্রিকান সম্মেলনও এ নীতির একটি সুন্দর উদাহরণ। একই ধরণের নীতি খিলাফত রাষ্ট্রও প্রয়োজনে গ্রহণ করবে, যদিও আল্লাহর রহমতে মুসলিম ভূ-খণ্ডগুলো পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর।
মুসলিম বিশ্বে বিদ্যমান পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর ব্যাপারেও খিলাফতকে কিছু নীতি নির্ধারণ করতে হবে। তারা মুসলিম বিশ্বে থাকলে আমাদের কি সুবিধা, আর কি সমস্যা, তা গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। বর্তমানে তারা চরম স্বাধীনতা ভোগ করছে; বিশেষ করে খনিজ সম্পদের বিষয়টিতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা শ্রম ও দক্ষতার মজুরি হিসেবে খনিজ সম্পদের অংশীদারিত্ব পেয়ে থাকে, এছাড়া মুসলিম বিশ্বের দূর্নীতিপরায়ন শাসকগোষ্ঠী ও অভিজাতশ্রেণী ব্যক্তিগত স্বার্থের বিনিময়ে জনগণের সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দিচ্ছে; যার কারণে খনিজ সম্পদের প্রকৃত অধিকারী হয়েও তা থেকে জনগণ তেমন কোন সুবিধা পাচ্ছে না।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এসব কোম্পানি কোন দক্ষতা বা প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করছে না। খিলাফতের অভ্যন্তরে কোন বিদেশী কোম্পানীকে কাজ করতে হলে অবশ্যই মুসলমানদের সাথে প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তি করতে হবে। পারস্পারিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যবসা বানিজ্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। যদি দুটি দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক সম্পর্ক থাকে তাহলে তাদের পক্ষে সহজে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্ভব হয় না। বর্তমান বিশ্বে চীন-মার্কিন সম্পর্কের দিকে তাকালে বিষয়টি সহজেই বোঝা যায়। পরস্পর বৈরী এই দুটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তাদের পক্ষে হঠাৎ করে সংঘর্ষে জড়ানো খুবই কঠিন। প্রযুক্তি বিনিময়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সম্প্রতি একটি ভাল নজির স্থাপন করেছে। সম্প্রতি ফ্রান্স ও পাকিস্তানের মধ্যে সাবমেরিন নির্মান ও সরবরাহের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ চুক্তি বলে ফ্রান্সের কাছ থেকে পাকিস্তান ৩টি সাবমেরিন কিনবে, কিন্তু শর্ত হলো এর একটি নির্মিত হবে ফ্রান্সে আর বাকী দুটি ফ্রান্সের তত্বাবধানে পাকিস্তানের প্রযুক্তিবিদদের হাতে তৈরী হবে। এ ধরণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্বলিত নির্মান চুক্তি অবশ্যই উন্নত শিল্প বিকাশে সহায়ক হবে।
খিলাফাহ রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার নিজস্ব কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা সম্পর্কে গতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। যে সব প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি আমাদের নেই তা দ্রুত বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিজেদের সক্ষমতাকে যুগোপযোগী করে রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পাকিস্তানে বর্তমানে চিনি ও সিমেন্ট নির্মানের প্লান্ট, কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদন কারখানা, সড়ক নির্মানের জন্য রোলার তৈরীর কারখানা ইত্যাদি ক্ষুদ্র ও ভারী শিল্পের কারখানা আছে। এসব কারখানাকে সামান্য পরিবর্তন করেই সেখানে ভারী লৌহ ও ইস্পাতজাত সামগ্রী তৈরী করা সম্ভব। এসব লৌহ ও ইস্পাতজাত পণ্য আবার অন্যান্য শিল্প, যেমন গাড়ী নির্মান, সমরাস্ত্র নির্মান ইত্যাদিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
৪. খিলাফত তিনভাবে শিল্পে বিনিয়োগ করবে:
– সরাসরি বিনিয়োগ: যে সব শিল্প সাধারণত লাভজনক ভিত্তিতে চালানো সম্ভব নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের অন্যান্য শিল্পের বিকাশ ও নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য সেগুলোকে অবশ্যই রাষ্ট্রের নিজস্ব বিনিয়োগে স্থাপন করতে ও চালু রাখতে হবে। যেমন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, সাবমেরিন ও যুদ্ধ জাহাজ নির্মান, রেলওয়ে ইত্যাদি।
– যৌথ বিনিয়োগ: যেসব ক্ষেত্রে পরবর্তীতে রাষ্ট্র তথা জনগণ লাভবান হবে, অথবা যেসব শিল্প সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া গড়ে উঠতে পারবে না, যেমন তেল উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ইত্যদিতে রাষ্ট্র ব্যক্তিখাতের সাথে যৌথ বিনিয়োগ করবে।
– ব্যক্তিখাতের শিল্পে ভর্তুকি বা সুবিধা প্রদান: যারা রাষ্ট্রের চাহিদা মতো পণ্য উৎপাদন করবে, যেমন কোন গাড়ি কারখানা যদি সামরিক যান বা ট্যাঙ্ক উৎপাদন করে তবে তাকে যথাযথ আর্থিক সুবিধা দিতে হবে। যারা অন্যান্য শিল্পের জন্য কাঁচামাল উৎপাদন করে তাদেরকে ভর্তুকি বা ঋণ সুবিধা দেয়া যেতে পারে। রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৃহৎ ইন্ডাষ্ট্রি (যেমন অস্ত্র কারখানা ইত্যাদি) স্থাপনকারীদেরকে বিনামূল্যে সরকারী জমি বরাদ্দ দিতে হবে।
খিলাফতের কর্তব্য হবে প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগের জন্য সম্পদশালী উদ্যোক্তাদেরকে উৎসাহিত করা। ইতিমধ্যেই মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ পরমানু বিজ্ঞানী এবং পেট্রোলিয়াম বিশেষজ্ঞ তৈরী হয়েছে; কিন্তু রাষ্ট্রের যথাযথ রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় তারা বিদেশে চাকরী খুঁজে নিচ্ছে; যার কারণে মুসলিম বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির সংকট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ১৯৬৭ তে যখন মিশর তার পারমানবিক কর্মসূচি বন্ধ ঘোষণা করে তখন সেখানকার বিজ্ঞানীরা সাদ্দাম হোসেনের সামরিক প্রকল্পে যোগ দেয়। পাকিস্তানের পরমানু প্রকল্পের স্থপতি আব্দুল কাদির খাঁন এখন বেকার।
শিল্পায়নের গতি ধারাকে যদি অব্যাহত রাখা যায় তাহলে তা সামগ্রিক অর্থনীতিতে অবশ্যই ব্যাপক গতি সঞ্চার করবে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, যে জন্য শিল্পে এই গতি অর্জন করা যাচ্ছে না তা হলো যথাযথ রাজনৈতিক আকাংখা ও পরিকল্পনার অভাব। মুসলিম দেশগুলোর বর্তমান অর্থনীতিতে সত্যিকারের কোন চালিকা শক্তি নেই এবং অধিকাংশ ধনী দেশ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রির টাকায় ভোগ-বিলাস করছে।
আমরা যদি বিশাল আকারের প্রতিরক্ষা ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে তোলার কাজে হাত দিই তাহলে ব্যক্তিখাত থেকে অবশ্যই বড় ধরণের বিনিয়োগ আসবে কারণ সরকারের তৈরী করা বড় ধরণের চাহিদা যে সুযোগ সৃষ্টি করবে তাকে কাজে লাগাবে প্রাইভেট সেক্টর। সবার আগে যে ভাল ফলটি দৃশ্যমান হবে তা হলো ব্যাপক কর্মসংস্থান। যদিও মুসলিম বিশ্বে দক্ষ জনবলের অভাব নেই তার পরও হঠাৎ করে শিল্পায়ন ঘটলে আমাদেরকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রশিক্ষণ সুবিধা চালু করতে হতে পারে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলে স্বাভাবিকভাবেই দৈনন্দিন পণ্যের ব্যবহার ও চাহিদা বাড়বে, কেননা অনেক মানুষের হাতে তখন খরচ করার মত টাকা আসবে। পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টরেও কাজ ও উৎপাদনশীলতা বাড়বে। নিত্য পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি বিলাসী পণ্যের চাহিদা, ব্যবহার ও উৎপাদন বাড়বে, সেখানে আবার নতুন শিল্প গড়ে উঠার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ আরো সম্প্রসারিত হবে; বাড়বে অর্থনীতিতে সম্পদের প্রবাহ।
৫. কৃষি:
একটি টেকসই শিল্পায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। জাতি যাতে খাদ্যের জন্য বিদেশী শক্তির উপর নির্ভরশীল না থাকে এটা নিশ্চিত করা অতীব জরুরী। সকল উন্নয়নই অর্থহীন হয়ে পড়বে যদি জনগণের মৌলিক খাদ্য নিরাপত্তা না থাকে। তাই খিলাফতকে স্রষ্টা প্রদত্ত বিশাল উর্বর ভূমিকে কৃষি উৎপাদনে যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্য একটি সুষম নীতি প্রনয়ণ করতে হবে।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্ক শিল্পের পাশাপাশি একটি মোটামুটি শক্তিশালী কৃষিভিত্তি তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮০ সালের পর আইএমএফ এর ধ্বংসাত্মক প্রেসক্রিপশন তার কৃষিখাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। তার পরও তুরস্ক এখনও খাদ্যপণ্য, গবাদি পশু এবং পোল্ট্রি রপ্তানীকারক দেশ।
খিলাফতের উচিত হবে কৃষি ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করা। এখানে উল্লেখ্য করার মতো একটি বিষয় হলো ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর উত্তর কোরিয়া ‘যাচ্ ফিলসফি’ নামে একটি সুষম কৃষিনীতি বাস্তবায়ন করে। কমিউনিস্ট চিন্তাধারার অনুসরণে এটি ছিল একটি তিন স্তরের কর্মসূচী। উত্তর কোরিয়া এখন তার কৃষি সারঞ্জাম ও প্রযুক্তি অন্যান্য দেশে রপ্তানি করতে আগ্রহী কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন শর্তের কারণে তা এই মুহুর্তে সম্ভব হচ্ছে না। আগামী দিনে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে উত্তর কোরিয়ার সাথে কৃষি উন্নয়ন চুক্তি করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে খিলাফত নিশ্চয়ই এমন বাণিজ্য সমঝোতায় পৌঁছবে যাতে করে আমরা তাদের কৃষি প্রযুক্তি ও কৌশল থেকে লাভবান হতে পারি।
এ নিবন্ধে যে আলোচনা হল তা মূলতঃ মোটাদাগের নীতি ও কৌশল। খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে সব ভূমি খিলাফতের অন্তর্ভূক্ত থাকবে সেগুলোর বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই আসল কৌশল স্থির করতে হবে। আজকের মুসলিম বিশ্ব সম্পদ, দক্ষতা ও জনশক্তিতে সমৃদ্ধ। খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে আমাদের এই দক্ষ জনগোষ্ঠীই খিলাফতের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করবে।
আমাদের বর্তমান শাসকরা পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর এজেন্ট। এরা কখোনই রাষ্ট্রের সামর্থ ও সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাবে না। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জার্মানি দ্রুত শিল্পায়ন করে বাকী ইউরোপের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, যার প্রেক্ষাপটে ১ম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। মাত্র ৬ বছরের শিল্প বিপ্লব পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্যকে জার্মানীর অনুকুলে নিয়ে এসেছিল এবং তাকে রুখতে পৃথিবীর বাদবাকি পরাশক্তিগুলোকে একতাবদ্ধ হতে হয়েছিল। মাত্র ২০ বছরের শিল্পায়ন সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরবর্তী ৫০ বছর ধরে মার্কিন পরাশক্তির মোকাবেলায় সামর্থ যুগিয়েছিল। এই উদাহরণগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, যদি প্রবল ইচ্ছা শক্তি থাকে তাহলে যে কোন জাতি শিল্পোন্নত হতে পারে এবং নিজেকে রক্ষা করতে পারে। আর শিল্প ক্ষমতা না থাকলে প্রত্যেকটি জাতিকেই হতে হবে অন্যজাতির অনুগ্রহ নির্ভর।
তবে খিলাফতের শিল্প ক্ষমতা অর্জন আর এতক্ষণ ধরে আলোচিত জাতিগুলোর শিল্প ক্ষমতা অর্জনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। কুফর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত জাতিগুলো শিল্পায়ন ঘটিয়েছে অন্য জাতিকে পদানত করা, উপনিবেশ স্থাপন ও পরাশক্তি হওয়ার আকাঙ্খা বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে।
অপরদিকে মুসলিম উম্মাহর শিল্প ক্ষমতা অর্জন ও প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধনের যে চেষ্টা, তার পেছনের চালিকা শক্তি ও প্রেরণা হলো ইসলামী আক্বীদা। আর মুসলমানদের সকল কর্ম পরিকল্পনা অবশ্যই হবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র আদেশ ও রাসূল (সা) এর মহান বাণীর আলোকে আলোকিত।
“হে ঈমানদারগণ! যখন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল এমনভাবে তোমাদেরকে ডাকেন যা তোমাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে তখন সেই ডাকে সাড়া দাও।” [আল কুরআন ৮:২৪]