08/17/2021
যখন বয়স ২৩, ধরা পরে যে আমার জরায়ুতে টিউমার। এর আগেও অনেক সমস্যা হতো পিরিয়ড চলাকালীন, কখনো পাত্তা দেইনি। যখন দিলাম, খুব বেশি দেরি হয়ে গেছিলো।
অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেবার পর কেমন যেনো ফাঁকা লাগতো বুকের ভেতর। সবেমাত্র ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি, আর তখনই সব সাধ-আহ্লাদ শেষ হয়ে গেলো। কখনো মা হবো না, ভালোবেসে কেউ ছুঁয়ে দিলে ভালোলাগা হবে না, কত দুশ্চিন্তা ছিলো মাথায়। একরাতে শুনলাম মা বড়পাকে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, "এ মেয়েকে কিভাবে পার করবো, কে নেবে?" পায়ের নিচের মাটি সরে গেল আমার। শিকড়হীন আমি চোখের জলের সমুদ্রে ভিজতে থাকলাম।
আমার বড়পার বিয়ে হয় ২৯ বছর বয়সে। মাস্টার্স শেষ করে চাকরি করে তবে বিয়ে। বাবামায়ের কোন অমত ছিলো না। কেউ বিয়ের কথা বলতে এলে "এখনই কেন বিয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়াক" এসব বলে কাটিয়ে দেয়া হতো। আর আমার বেলায়? অপারেশনের তিনমাসের সময় থেকে সমন্ধ দেখা শুরু হলো। সকলেই ডিভোর্সড সন্তানের বাবা কিংবা বউ মরে গেছে বাচ্চাকাচ্চা রেখে। এমন ছেলে ছাড়া আমার মতো পঙ্গুকে কেই বা বিয়ে করবে?
এভাবে দুই-তিনবছর কেটে যায়, আর তখনই আমার জীবনে আসে টুনটুনির বাবা। উনি আর বড়পার কলিগ, বড়পার অফিসেই ইন্টার্নশিপের জন্য জয়েন করেছিলাম, সেখান থেকে এই বিয়ের কথা অব্দি এগিয়ে যাওয়া। আমিও মত দিয়ে দিলাম। বাবামায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি না, তাই এই বিয়েটাই আমার মুক্তি, এমনই ভেবেছিলাম।
টুনটুনির বাবা মানুষ হিসেবে চমৎকার। দেখতে বেশ সুন্দর, মার্জিত, ভালো চাকরি করে। কিন্তু তার বাচ্চার মা মারা গেছেন কিডনির অসুখে, যখন বাচ্চার বয়স মাত্র দুই। টুনটুনি সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তার ফুপুর ও বিয়ে হয়ে গেল কিছুদিন আগে। তাই শেষপর্যন্ত সংসার দেখার ভার এসে পরলো আমার উপর। শেষপর্যন্ত, আমার ভাগ্যে কিছু তো জুটলো!
আমরা খুব ভালো আছি। টুনটুনির বাবা আমাকে খুব ভালোবাসে। আর টুনটুনিও ঠিক আমার সন্তান। এক মূহুর্তের জন্যেও মনে হয়নি যে টুনটুনি আমার অংশ নয়। আমরা খুব সুখে আছি।
কিন্তু যখন রাত গভীর হয়, নিস্তব্ধতা ভেদ করে টুংটাং রিকশার বেল শোনা যায়, জোছনায় ঘর উপচে পরে, আমার বুকের ভেতর ঠিক আগের মতোই ফাঁকা লাগে। এইযে আমার জন্যে টুনটুনির ও তার বাবার ভালোবাসা, সবই তো স্বার্থের জন্য। কেউ তো আমাকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেয়নি! কিংবা আমিও তাদের কাছে ভালোবাসার টানে আসিনি!
টুনটুনির দরকার ছিলো মা, তার বাবার দরকার ছিলো বাচ্চার জন্যে মা। যেহেতু আমার নিজের কোন বাচ্চা হবে না, টুনটুনির অনাদর হবে না কোনদিন। আবার আমিও বিয়ে করেছিলাম কারণ এই সংসারে কেউ আমাকে বন্ধ্যাত্বের খোঁটা দেবেনা। নাহ, ভালোবেসে এই সংসার হয়নি আমার। দিনের আলোয় বোঝা যায় না, আঁধারে সব কমতি জ্বলজ্বল করে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করে।
আমার বুকটা আজও ফাঁকা, এমন এক অপূর্ণতায় ঘেরা আমি যেখান থেকে কোন মুক্তি নেই।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)
©️NakedMind