09/02/2025
কুপ্রবৃত্তি যখন ভালো কাজ করতে চায়:
আমাদের আকাবিরগণ নফসের কূটচাল থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ সজাগ ও সতর্ক থাকতেন। নফসকে কোনোভাবেই তার ইচ্ছার অধীন করে দিতেন না। আহমদ ইবনে আরকাম বালখি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, একবার আমার নফস আমাকে জিহাদে বের হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করল! আমি তো হতবাক। বিস্ময়ে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, জিহাদ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায় প্রতিটি প্রাণ, অথচ আমার নফস আমাকে সেই জিহাদে শামিল হতেই অনুপ্রাণিত করছে! অথচ নফসরে স্বরূপ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন:
إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ.
'মানুষের মন অবশ্যই মন্দ কর্মের প্রতি অধিক মাত্রায় আদেশ করে। ৩৫ সুতরাং আমার নফসও তো আমাকে মন্দ কর্মে উৎসাহিত করার কথা, কিন্তু সে কেন আমাকে জিহাদের মতো এত উন্নত আমলের দিকে উৎসাহিত করছে? এটা তো কখনই হতে পারে না?
তখন আমি ভাবলাম, আমার নফস দীর্ঘদিন একাকীত্ব ভোগ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, একঘেয়েমিতে ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়েছে। তাই মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ ও তাদের সান্নিধ্যে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জিহাদে বের হতে চাচ্ছে।
(৩৪. নাদরাতুন নাইম: ৮/৩৩১৪)
(৩৫. সুরা ইউসুফ: ৫৩)
আত্মবিচার: ১০৩
ফলে তার এই একঘেয়েমিও কেটে গেল, মানুষের মধ্যে নিজের বীরত্বও প্রকাশ পেল।
আমি মনের এই অবস্থা আঁচ করতে পেরে আমার নফসকে সম্বোধন করে বললাম, আমি তোমাকে জনসম্মুখে আসতে দেব না এবং মানুষের মধ্যে পরিচিতও করাব না। তখন আমার নফস এতেও সায় দিল। তখন আমার নফসের আবার খারাপ ধারণা হলো এবং আমি বললাম, আল্লাহ হলেন সর্বাধিক সত্যবাদী। আর তিনি তো বলেছেন, 'মানুষের মন অবশ্যই মন্দ কর্মপ্রবণ।' তাহলে আমার নফস আমাকে এই ভালো কাজও সায় দিচ্ছে কেন? তখন আমি আমার নফসকে বললাম, তাহলে আমি তোমাকে নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হব খালি গায়ে, বর্ম, ঢাল ও শিরস্ত্রাণবিহীন অবস্থায়; যাতে তুমিই হও জিহাদের প্রথম শহিদ।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমার নফস এ ক্ষেত্রেও আমাকে সায় দিল! আমি যা করতে চাচ্ছিলাম তা-ই করতে বলল।
তখন আমি আবারও আমার নফসের প্রতি পূর্বের ন্যায় সন্দিহান হলাম। আর আমি বিভিন্ন নেক আমলের কথা স্মরণ করলাম, যার প্রত্যেকটিতে নফস সায় দিয়েছে। যা নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
আহমদ ইবনে আরকাম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তখন আমি ভীষণ পেরেশান হলাম। বার বার ভাবতে লাগলাম, এমন তো হওয়ার কথা নয়! তাই আমি আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করলাম, হে প্রভু! আমার নফসের এই ভালো মানুষির রহস্য আমার সামনে উদ্ঘাটন করে দিন। কেননা আমি আমার নফসকেই অভিযুক্ত করি এবং আপনার কথাই নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি।
এরপর দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর আমার অন্তরে কাশফ হলো, আমার সামনে রহস্য উদ্ঘাটিত হলো। আমার নফস যেন আমাকে এ কথা বলছিল যে, হে আহমদ! তুমি আমাকে কামনা-বাসনার প্রতিটি বস্তু থেকে বঞ্চিত করে এবং আমার প্রতিটি চাওয়ার বিরোধিতা করে প্রতিদিনই তো হত্যা করে চলেছ, যে সম্পর্কে কেউ জানে না। সুতরাং জিহাদে অংশগ্রহণ করে যদি নিহত হও, তবে আমাকে একবারেই হত্যা করে ফেললে। তখন আমি তোমার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলাম। এভাবে আমি তোমার হাত থেকে মুক্তিও পেলাম, আবার জিহাদে অংশগ্রহণ করে শহিদ হওয়ার কারণে আমার সুনাম-সুখ্যাতি ও বীরত্বের কথাও মানুষের মধ্যে প্রচার হলো। লোকেরা তখন বলবে, আহমদ ইবনে বালখি শহিদ হয়েছেন! এভাবে আমার স্মরণ ও সম্মান জীবিত থাকবে।
12
3
আত্মবিচার: ১৯
আহমদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমার কাছে আমার নফসের এই চরিত্র প্রকাশ পাওয়ার পর আমি বসে গেলাম এবং সেই বছর জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলাম। ৩৬
পাঠক! দেখুন, মানুষের আত্মা মানুষকে কতভাবে বিভ্রান্ত করে। কতভাবে ধোঁকা দেয়। কখনো খারাপ কাজ করে বিপথগামী করে, আর কখনো ভালো কাজের ছুরতে মানুষকে বিপথগামী করে। তাই নফসের বিরুদ্ধে মানুষের শাসন ও কঠোরতাও হতে হবে নানামুখী। নিজেকে শাসন না করার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারলে কখনই নিজেকে নফসের ক্ষতি ও ধোঁকা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। এ কারণেই জনৈক বুজুর্গ বলেছেন:
تَوَقَّ نَفْسَكَ لَا تَأْمَنْ غَوَائِلَهَا فَالنَّفْسُ أَخْبَثُ مِنْ سَبْعِينَ شَيْطَانًا
'তুমি তোমার নফসকে বাঁচাও, নফসের কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করো না। কেননা একটা নফস সত্তরটি শয়তান থেকেও নিকৃষ্ট ও ভয়ানক ক্ষতিকর।'