11/13/2025
সাভারের বাইপাস রোড ধরে সামান্য ভেতরে গেলেই একটা সরু গলি। এই গলির বাতাস আজও অন্যরকম রুক্ষ ধুলো মেশানো আর পুরোনো সিমেন্টের এক অদ্ভুত শীতল গন্ধ। ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল একসময় সাত নম্বর বিল্ডিং। এখন শুধু ভাঙা পিলারের কঙ্কাল, মরিচা ধরা লোহার কাঠামো, আর এক গভীর, কান্নার মতো নীরবতা।
মানুষ তাকে “রানা প্লাজা” বলে চেনে কিন্তু স্থানীয়দের কাছে নামটা আজও এক অভিশাপ। তারা নামটা মুখে আনে না। বলে, ওই জায়গা, ওই দিকটা, ওই অভিশাপ... যেন নাম উচ্চারণ করলেই মাটির নিচের কোনো পুরোনো পাপ আবার জেগে উঠবে।
আমি একজন লেখক, আমি ভুত দেখতে যাই না আমি দেখতে যাই সত্য। আর সেই সত্য আমি প্রথম উপলব্ধি করি ২০২৩ সালের মার্চের এক বিকেলে।
বিকেল তখন ফুরিয়ে আসছে। আকাশ জুড়ে লালচে-কমলা আলো যা ভাঙা রডগুলোর উপর পড়তেই মনে হচ্ছিল রক্ত জমে আছে। কৌতূহলেই গিয়েছিলাম খবর করার জন্য নয়। পাশেই ছোট্ট একটা চায়ের দোকান চালান আবদুল করিম চাচা। তাঁর বয়স সত্তরের কাছাকাছি, চোখের কোণে জমে আছে বহু বছরের ঘুমহীন রাত আর দুঃখের ছাপ।
আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভাঙা বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“চাচা, এই বিল্ডিংয়ে এখনো কেউ আসে?”
চাচা চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিলেন, চোখদুটো ছোট করে বললেন,
“মানুষ আসে না বাবা। মানুষ তো আর সাহস করে না। তবে শব্দ আসে।”
আমি ভ্রু কোঁচকালাম, “শব্দ? কিসের শব্দ, চাচা?”
তিনি চারপাশটা দেখলেন, গলাটা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“রাতে মনে হয় সেলাই মেশিন চলে। একটানা, চিঁ চিঁ চিঁ… টক টক টক… একটানা। যেন কেউ খুব দ্রুত কাজ শেষ করতে চাইছে।”
আমি হেসে ফেললাম, “হয়তো পাশের কোনো ফ্যাক্টরির আওয়াজ হবে।”
চাচা মাথা নাড়লেন এবার আরও জোরালোভাবে। তাঁর চোখে ছিল এক জেদ।
“না রে বাবা, এই দিকের সব ফ্যাক্টরি বন্ধ। রাতে এই এলাকায় শুধু কুকুর ডাকে। আর ওই বিল্ডিং থেকে আসে সেলাই মেশিনের শব্দ। মনে হয়… তারা এখনো কাজ শেষ করেনি।”
তাঁর কথা শুনে আমার কৌতূহল ভয় মেশানো এক শিহরণে বদলে গেল। মনে হলো এই মানুষটা কোনো গল্প বলছে না এক কঠিন সত্যের সাক্ষী দিচ্ছে।
রাত নেমেছিল দ্রুত। চারপাশটা যেন এক বিশাল কালো ক্যানভাস তার মাঝে ভাঙা বিল্ডিংটা এক অভিশাপের মতো দাঁড়িয়ে। আমি পকেটে ক্যামেরা আর একটা টর্চ নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
ভেতরের বাতাসটা অদ্ভুত ঠান্ডা। যেন গ্রীষ্মের দুপুরেও এখানে বরফ জমে থাকে। মনে হলো এই জায়গায় রোদ্দুর বাতাস উষ্ণতা -সব প্রবেশ নিষিদ্ধ।
ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, প্রতিটি ধাপে মনে হচ্ছে নিচের মাটিটা আবার কেঁপে উঠবে। ছেঁড়া তারের জাল পুরোনো সিমেন্টের ওপর জমে থাকা অজস্র থ্রেডের গুচ্ছ। মেঝেতে পড়ে আছে কারো পরা একটা শাড়ির টুকরো হয়তো নীল পাড়ের কাদায় মাখা। কেউ তুলেও নেয়নি হয়তো তোলার মতো কেউ বেঁচেও নেই।
আমি টর্চ জ্বালালাম। আলো পড়তেই এক ভয়ংকর দৃশ্য চোখে পড়ল দেয়ালের এক পাশে কারও হাতের ছাপ। সাদা ধুলোয় জমে থাকা যেন শেষ মুহূর্তে কেউ বাঁচতে চেয়ে দেওয়া পাঁচটা আঙুলের স্পষ্ট ছায়া। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা তখনও বাকি ছিল।
আমি যখন তৃতীয় তলার, যেখানে একসময় প্রোডাকশন ফ্লোর ছিল সেখানে ঢুকলাম। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো কেউ যেন কথা বলছে। ফিসফিস করে কিন্তু মেশিনের শব্দের মতো টান টান ধ্বনি।
চিঁ চিঁ চিঁ… টক টক টক…
ঠিক যেভাবে একজন অপারেটর দ্রুত সেলাই করলে আওয়াজ হয়।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আলো নিভে গেলনা কিন্তু বাতাস থেমে গেল। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। নীরবতা যেন চিৎকার করছে।
তারপর হঠাৎ কানে এল একটা গলা খুব ক্ষীণ খুব চাপা। মনে হলো আমার কানের ঠিক পাশে কেউ ফিসফিস করছে,
“তুমি রিপোর্ট করতে এসেছো?”
আমি চারদিকে তাকালাম। কেউ নেই। শুধু একটা ভাঙা লোহার টেবিল, তার উপর রাখা পুরোনো আধভাঙা একটা সেলাই মেশিন। মেশিনটার পাশে ছোট মরচে ধরা একটা নামফলক - “শিউলি বেগম, লাইন-৭”।
আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে আমি পাশের বস্তিতে গেলাম। সেখানে পেলাম রুমা নামের এক মেয়েকে। সে তখন ঐ একই ভবনে কাজ করত যেদিন ভবনটা ধসে পড়ে।
তার চোখের নিচে কালচে দাগ যেন বহু বছর ঘুমায়নি। কথাগুলো মুখ থেকে বের হয় ধীরে ধীরে প্রতিটি শব্দ যেন পাথর সরিয়ে বের করা হচ্ছে।
“আমরা তখন তৃতীয় তলায় ছিলাম। আগের দিনই বিল্ডিংয়ে ফাটল দেখা দিয়েছিল। ম্যানেজারের কাছে গেলাম সবাই বলল, ‘কাজ বন্ধ করেন, আমরা ভয় পাচ্ছি।’ কিন্তু ম্যানেজার চিৎকার করে বলল, ‘একদিন কাজ না করলে বেতন কাটা যাবে, ক্ষতিপূরণ পাবে না।’ আমরা নিরুপায় হয়ে ঢুকেছিলাম।”
তার গলা কেঁপে গেল। চোখ নামিয়ে সে বলল,
“সকাল ৮:৫৭-তে হঠাৎ একটা আওয়াজ। মনে হলো মাটি ফেটে যাচ্ছে। চারপাশটা শুধু ধুলো আর ইট। আমার পাশের মেয়েটা, শিউলি… সে বাঁচেনি। ওর শরীরটা মেশিনের নিচে আটকা পড়েছিল। আমি চেঁচাতে পারিনি। যখন আমাকে বের করা হলো, শুনেছি ওর হাতের ঘড়িটা থেমে গেছিল ঠিক ৯টা ৬ মিনিটে…”
আমি শিউলি নামটা শুনে চমকে উঠলাম। এই তো সেই নাম যা আমি গতরাতে অন্ধকারে দেখেছি। মনে হলো, শিউলি আমাকে চিনতে পেরেছিল।
আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। সত্যের এই ভয়ংকর রূপ আমাকে আবার সেখানে টেনে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় রাতে আমি ভয়েস রেকর্ডার নিয়ে ফিরলাম।
বিল্ডিংয়ের ভেতরে এখন লতাগুল্ম গজিয়েছে কিন্তু ভেতরের বাতাসে আজও একধরনের অচেনা ধুলো ঝুলে থাকে। মনে হয় কেউ সেলাই শেষ করে এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে শুধু এই কাজটা শেষ করার জন্য।
রাত তখন ১২টা। আমি রেকর্ডারটা অন করে ভাঙা সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছি।
রেকর্ডারে আওয়াজ এল। প্রথমে ক্ষীণ তারপর স্পষ্ট হলো-
চিঁ চিঁ চিঁ… টক টক টক…
ঠিক যেমনটা চাচা করিম বলেছিলেন। মেশিনের একটানা শব্দ।
তারপর এক নারীকণ্ঠ খুব ধীরে, যেন ফিসফিস করে কাঁপছে,
“আমরা এখনো কাজ করছি…”
আমার হাত কাঁপতে শুরু করল। আমি টর্চ ফেললাম। আলোর নিচে কেউ নেই। শুধু বাতাসের মধ্যে ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোগুলো উড়ছে। মনে হচ্ছে কেউ সেলাই করছে যদিও মেশিনে কেউ নেই।
আরেকটা চাপা আওয়াজ এল যেন খুব ক্লান্ত, কিন্তু নির্দেশ দিচ্ছে,
“লাইন বন্ধ কোরো না… পিস শেষ হয়নি…”
আমার মনে হলো শুধু একটা পিস, একটা শার্ট বা একটা প্যান্ট শেষ করার জন্য ওরা চিরকাল এখানে আটকে আছে। আমি দৌড়ে বাইরে এলাম। পেছনে ফিরে দেখলাম তৃতীয় তলার একটা ভাঙা জানালায় লালচে আলো। ঠিক যেমনটা জ্বলত মেশিনের সিগন্যাল লাইটে যখন কাজ শেষ করার শেষ চেষ্টা চলত। কিন্তু বিল্ডিংয়ে কোনো বিদ্যুৎ নেই!
এক সপ্তাহ পর আমি শহরে ফিরে এলাম। ভয়েস রেকর্ডটা শুনলাম। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আমার বন্ধু, তার কাছে নিয়ে গেলাম। সে বিশ্লেষণ করে হতবাক।
সে বলল,
“এটা শুধু মেশিনের শব্দ নয়। একটা অনিয়মিত হার্টবিট ফ্রিকোয়েন্সি মানুষের হৃদস্পন্দন, যা খুব দ্রুত চলছে যেন কেউ ভয় পেয়ে খুব জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু এর উৎস… সেটা বোঝা যায়নি। মানুষের গলা আর মেশিনের শব্দ মিলেমিশে একটা অদ্ভুত সুর তৈরি করছে।”
আমি হাসলাম না। আমি জানতাম এটা কোনো গ্যাস বা অপদেবতা নয়।
আমি জানতাম হয়তো ওরা সত্যিই এখনো কাজ করছে, আমাদের মতোই ঠিক সময় মতো শেষ না হওয়া ‘পিস’টা শেষ করতে চায়। তারা জানে কাজ শেষ না হলে বেতন কাটা যাবে। সেই ভয় আজও তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
আজ সেখানে একটি নতুন গার্মেন্টস ভবন তৈরি হচ্ছে। সাদা রঙ চকচকে কাঁচের জানালা আধুনিক সেফটি লক। কিন্তু স্থানীয় শ্রমিকরা বলে প্রতি বছর ২৪ এপ্রিলের রাতে, লাইট বন্ধ হলে একটা বিশেষ ঘরে সেলাই মেশিন নাকি নিজে থেকেই চলতে শুরু করে।
ওরা কাজ থামায় না। ওরা কেবল ফিরে আসে নিজের অসম্পূর্ণ কাপড়ের খোঁজে।
আমার বিদায় নেওয়ার সময় চাচা করিম আবার আমার হাত ধরলেন। তিনি খুব শান্ত গলায় বললেন,
“তুমি কি কখনো ভেবেছো, বাবা? যে জায়গায় শত শত মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল, সেই একই মাটির উপর তৈরি নতুন কারখানার মেশিনে প্রথম কাপড়টা কে সেলাই করে?”
আমি উত্তর দিতে পারিনি।
শুধু দেখলাম সন্ধ্যার আলোয় সাত নম্বর বিল্ডিংয়ের ভাঙা কাঁচে সূর্যের শেষ রশ্মি পড়ছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ভেতরে কেউ বসে আছে, শিউলি বেগম। সেলাই করছে আর নরম গলায় গুনগুন করছে যেন নিজের পুরোনো স্বপ্নগুলো সেলাই করে জুড়তে চাইছে।
আর সেই স্বপ্নের গানের তালে আমি শুনলাম মেশিনের একটানা শব্দ, যা কখনো থামে না।
চিঁ চিঁ চিঁ… টক টক টক… টক…
তুমি কি জানো, সাভারের সাত নম্বর বিল্ডিং আজও রাতের বেলা নিস্তব্ধ থাকে না? হয়তো ওরা এখনো শেষ না হওয়া পিসটা সেলাই করছে… কারণ তাদের বেতন কাটা যাবে। এই গল্পটা শেয়ার করুন, যেন শিউলি বেগমের কাজটা শেষ হয়।
#সাত_নম্বর_বিল্ডিং
@ collected from Misk al Mar