06/10/2021
আলো
রোজকার অভ্যাসের মত মোহনা এ সময় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ওই দূরের তিনকোণিয়া পার্কের মাঝে পুকুরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। নিস্তব্ধ পার্কে হাওয়ায় পাতা দোলা শব্দ ছাড়া হয়তো দু একটা কুকুর ঘেউ করে ডেকে ওঠে মাঝে মধ্যে। মধ্য গগনে স্টিলের থালার মত উজ্বল পূর্ণ চাঁদমামা তার রূপালী আলোর ঘোমটায় ঢেকে রাখে চারপাশের প্রকৃতি। সন্ধ্যেকে সরিয়ে রাত্রি নামে। ঘনত্ব বাড়ে রূপালী আলোর। মোহনার ভালো লাগে এই আলোর স্নিগ্ধতা। এসময় বিট্টু ঘুমিয়ে পড়ে। মোহনার ছোট ছেলে। আর বড় মেয়ে দিশা ডাইনিং রুমে মোবাইলে গেমস খেলে। গতবছর তথা এবছর লকডাউন এর জন্য অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। স্কুলের ঝুট-ঝামেলা থেকে একটু নিশ্চিন্ত মোহনা। অমরেশ বাড়ি ফেরে একটু রাত করে। এখন রোজ অফিস যেতে হয় না। সপ্তাহে তিন দিন। অল্প সময়ে অফিস বলে কাজের চাপটাও বেশি। সহকর্মীরাও রোজ আসে না। পার্সোনাল গাড়ি থাকার জন্য দু’জনকে ড্রপ করে বাড়ি ফিরতে একটু রাতই হয় অমরেশের। এই ফাঁকতালে মোহনা পুকুরের জলে চাঁদ আর মেঘের আলোছায়ার লুকোচুরিতে মজে থাকে।
মান্ধাতার আমলের টেলিফোন বাজার মতো ক্রিংক্রিং মোবাইলটা বেজে ওঠে। অমরেশ ফিরেছে। অতিথি বা বন্ধুদের মতো কলিং বেল বাজিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকা অমরেশ পছন্দ করে না। মোহনা তার শ্বাশুড়ী মাকেও দেখেছে এই অভ্যেস পালন করতে। ফ্ল্যাট বাড়িতে এমনিতেই একটু চোখাচোখি চলে। জুতোর সেলফিটা যদি এক ইঞ্চি সরে যায় তবে পাশের জন্য হাইকোর্ট দেখাতে ছাড়ে না।
বিদিশা গেমস খেলতে খেলতে আড়চোখে অমরেশের জুতোর দিকে তাকায়। কালো বুটের উপর ছিটছিট কাদা লেগে। মোবাইলটা পস করে অমরেশের দিকে তাকিয়ে বলে, “পাপা তোমার জুতোয় কাদা লেগে বৃষ্টি হয়েছিল” অমরেশ ক্লান্তভাবে হেসে বলে, “অনুসূয়া আন্টির বাড়ির সামনে কাদা জমেছিল ভুল করে পা দিয়ে ফেলেছিলাম” “ওফ পাপা তুমি একটু সাবধানে হাঁটতেও পারো না”। কিচেন থেকে মোহনা মেয়ের জ্যাঠামো শুনে বলে, “বাবা অফিস থেকে ফিরেছে এখন বিরক্ত করো না তুমি খেতে এসো”। বিদিশা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মোবাইলটা সোফার ওপর রেখে উঠে যায়।
অমরেশ একদৃষ্টে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে মেল টাইপ করছিল। মোহনা চশমাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “প্লাস আছে এবার মাইনাস পাওয়ার হবে ডাক্তারবাবু লাইট জ্বেলে ল্যাপটপে কাজ করতে বলেছেন বয়সটাও পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে”। টাইপ করতে করতে অমরেশ বলল, “বাদ দাও ডাক্তাররাই আঙুলের ডগায় সিগারেট গুঁজে জ্ঞান দেয় সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয় আফটার অল আমাদের শরীর অসুস্থ না হলে ওদের চলবে কি করে”। মোহনা অমরেশ এর পাশে বসে বলে, “আর কতক্ষণ”। “প্লিজ মাই ডিয়ার আরেকটু আজ মিস্টার লাখোটিয়া কে রিপোর্টটা পাঠাতে হবে তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো আমি আসছি”। মোহনা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে পেল্লাই একটা হাই তুলে বললো, “দূর তোমাকে আমার জানা আছে সবে তন্দ্রা আসবে আর তুমি ঘরে ঢুকে লাইট জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেবে”। অমরেশ একটু জোরে হেসে ওঠে। মোহনা অমরেশের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে, “আস্তে বিট্টু উঠে পরবে তখন আরেক বিপদ বারবে”। অমরেশ মোহনার কাঁধে হাত রেখে বলে, “আজ মনে হচ্ছে ম্যাডাম পুরো মুডে আছে” “দুর খালি বাজে কথা”। মোহনা উঠে গিয়ে এক ঢোক জল খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকায় রাত্রি সাড়ে বারোটা। অমরেশ খুব মনোযোগ দিয়ে মেলের শেষ কটা লাইন চেক করল। তারপর মেলটা সেন্ড করে দিয়ে মোহনাকে বলল, “মোহ তোমাকে তো একটা গুড নিউজ দেওয়াই হয়নি”। মোহনা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “কাল সকালে বলোনা খুব ঘুম পাচ্ছে”। অমরেশও ছাড়ার পাত্র নয় “প্লিজ একটু বসি না কাল তো অফিস নেই, দিশাও স্কুল যাবে না, গল্পটা কি ভালো জমেছে তুমি খিচুড়ি পাকিয়ে দিচ্ছো”। মোহনা দেখল আর কোন উপায় নেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, “বল” “রবিবার অনুসূয়া আর মিষ্টার সান্যাল একটা পার্টি থ্রো করেছে, অনলি কাপেল”। মোহনা চমকে উঠে বলল, “এই লকডাউনে পার্টি”। অমরেশ মোহনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আরে বাবা বিশাল একটা কিছু নয় মাত্র চল্লিশ জন, নো ককটেল, জাস্ট একটা গেট টুগেদার, আরেকটু ডান্স গতবার ওদের অ্যানিভার্সারির খাওয়া-দাওয়া বাকি ছিল না সস্তায় সেরে দিচ্ছে”। মোহনা বলল, “দিশা আর বিট্টু কাদের কাছে থাকবে”। এবার পেল্লাই একটা হাই তুলে বলল অমরেশ, “ফাস্ট ফ্লোরে টম আঙ্কেলের কাছে রেখে যাব সন্ধ্যেবেলা মাত্র তিন ঘন্টার তো ব্যাপার”। বাধা দিয়ে মোহনা বলল, “না না উনি বয়স্ক মানুষ আমি মাকে আসতে বলি তুমি শনিবার গিয়ে মাকে নিয়ে এসো”।এ প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া ছাড়া অমরেশ আর কিছু খুঁজে পেল না।
অনুসূয়া কোল্ড্রিংসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মোহনার সামনে এসে বলল, “মোহ তুমি একা একা বসে বোর হচ্ছ কেন, কাম অ্যান্ড জয়েন উইথ আস, লেটস ইঞ্জয়, কেউ আছে মিউজিক টা একটু জোরে দাও”। অনুসূয়া মোহনাকে হাত ধরে টানতে টানতে ছাদের মাঝখানে নিয়ে এসে কোমর দুলিয়ে নাচতে আরম্ভ করল। মোহনা এসবে খুব একটা অভ্যস্ত নয়। সে ছোটবেলায় কোনদিনই ব্যাকরণ মেনে নাচ শেখেনি। মোহনার বেতালা নাচের ধরন দেখে দূর থেকে অমরেশ ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছিল। অমরেশের এসব অভ্যাস আছে। সে প্রায়ই এরকম গেট টুগেদার পার্টিতে এ্যাটেণ্ড করে। এগুলো কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে স্টেটাস মেন্টেনের একটা অঙ্গ। ধীরে ধীরে সময় একটু গড়াতেই পার্টির আমেজ গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। খোলা আকাশের নিচে অনুসূয়াদের ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদ নিয়ন আলোয় গমগম করতে লাগলো। একবার করে মিউজিক চেঞ্জ হচ্ছে আর নাচের বহর বদলাচ্ছে। মিস্টার সান্যাল অমরেশ কে বলল, “আমি অনুসূয়াকে বলেছিলাম একটু ওয়াইন রাখতে এসব গেট টুগেদারে এক সিপ না নিলে ঠিক আমেজ আসে না” “আপনি ঠিকই বলেছেন মিস্টার সান্যাল তবে এই সিচুয়েশনে না নেওয়াই ভালো এক্ সিপ কখন এক বোতল চেঞ্জ হয়ে যাবে কেউ বলতে পারবে না” “ও তবে আপনিও ইনডাইরেক্টলি অনুসূয়ার দলে”। বলে দুজনে হা হা করে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ পর মিসেস ত্রিপাঠী এসে হাজির হল বড্ড ঢলানি মেয়ে। সবসময় ওভার রিয়েক্ট করে। মুখভর্তি মেকআপ করে খুকি সেজে আসে। এদিকে বয়স ঘড়ির পেন্ডুলামের মত চোখের কোলে ঝুলে রয়েছে। অনেক দিন আগে এনাকে লক্ষ্য করেছিল মোহনা। নাচতে নাচতে বারবার ঢলে পড়ছিল অমরেশের গায়ে। এমনকি এক প্যাক মদ ফেলে দিয়েছিল জামার ওপর। সেই থেকে মুখটা ভালো করে মনে রেখেছে মোহনা।
আর মোহনার ভালো লাগছে না। বড় আনচান করছে মনটা। কতক্ষণে সে বাড়ি ফিরবে। কেউ যেন অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। কেউ যেন ডাকছে তাকে। সমুদ্রের ঢেউয়ের স্রোতের মতো বাড়ছে হৃদস্পন্দন। একবার চেয়ারে থেকে উঠছে একবার বসছে সে। একটা ফিস বাটারফ্লাই নিয়ে এক কামড় খেয়ে প্লেটে নামিয়ে রাখল মোহনা। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে মোহনার কপালে। বার দুয়েক টিসু পেপার দিয়ে মুখ মোছা মোহনা। এই বেগতিক অবস্থা দেখে একটা ওয়েটের মোহনাকে জিজ্ঞেস করল, “একটু জল খাবেন ম্যাডাম আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে”। মোহনা “না ঠিক আছে” বলে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। রজনী তখন উত্তাল। অমরেশ তখন পার্টিতে মশগুল এসময় ওকে বার করা সম্ভব নয়। আর কিছুতেই নিজের আবেগ চেপে রাখতে পারছে না মোহনা। অমলেশের প্যান্টের পকেট থেকে গাড়ির চাবিটা ছিনিয়ে নিয়ে পার্কিং থেকে গাড়ি স্টার্ট করে সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটল মোহনা। পিছনে অমরেশ চিৎকার করতে করতে দৌড়চ্ছে “ওকে কেউ আটকান স্টীয়ারিং-এ ওর হাত সেট নয়”। ততক্ষণে মোহনা দু কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গেছে।
তিনকোনিয়া পার্কের মাঝে পুকুরের জলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চাঁদটা। পাতা দোলা হাওয়াও বইছে না আজ। সেও মনে হয় অপেক্ষা করে আছে কারো জন্য। মোহনা ব্যালকনির রেলিং ধরে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো দেওয়ালে। এতক্ষণে হৃদপিণ্ড গতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। শান্ত চোখে একফালি দৃষ্টিতে পুকুরের দিকে তাকাল মোহনা। অগোছালো চুলের কিছু অংশ কপালের ঘামে লেপ্টে। উপরের ঠোঁট কিঞ্চিত কাঁপছে মোহনার। শাড়ির আঁচলের খানিক অংশ মার্বেল স্পর্শ করে ঝুলে আছে। চাঁদের রূপালী আলোয় আপ্লুত মোহনার ব্যালকনি। অমরেশ বহুবার বহু সাজে দেখেছে মোহনাকে। কিন্তু এই মৃদু রূপালী আলোয় আপ্লুত মোহনার সৌন্দর্য কোনদিন দেখেনি অমরেশ। মোহনা অমরেশের হাতে হাত রাখে। অমরেশ বুকে টেনে জাপ্টে ধরে মোহনাকে। চোখ ভেজে দুজনের।
কৃষ্ণেন্দু সামন্ত
১০ই জুন ২০২১ ।।