12/25/2024
নুপুরের চুল গুলো বড়ো। চুলায় আগুন দিতে গিয়ে সেই চুল পুড়ে একাকার। কোন ফাঁকে, কোন উদাসীনতায় শখের চুলগুলোতে আগুন ধরে গেল সেই হদিস সে পেল না। চিৎকার-চেঁচামেচিটা শুরু করল তার পিসি শাশুড়ি। জলভর্তি জগে চুল গুলো ডুবিয়ে দিয়ে নুপুরকে বাঁচালো। নুপুরের মুখটা লাল। ভয়ে লাল হয়ে গিয়েছে। হট্টগোলের শব্দে নুপুরের শাশুড়ি ছুটে এলো। মুধুবালা দেবী বউয়ের এমন বোকামোতে ভীষণ খ্যাপে গেল। ভয়ংকর চেঁচিয়ে বলল,
‘ওমা ওমা ওমা, বউ, তুমি কি দেখে কাজ করো না? চুলে আগুন লাগিয়ে দিছো! শরীর পুড়লে তো তোমার বাপের বাড়ির মানুষ বলতো আমরা আগুন লাগিয়ে মেরে ফেলছি। এমন সর্বনাশ করো না আমাদের।’
নুপুর অনুরাগশূন্য নয়নে তাকিয়ে রইল দূরে। উন্মনা কণ্ঠে বলল,
‘সর্বনাশ করবো না, মা। চিন্তা করবেন না। আমি আমার বাদে কারো সর্বনাশ করিনি কখনো।’
মুধুবালা দেবী পুত্রবধূর এহেন উদাসীনতায় বিরক্ত হলো। সেই বিরক্তি ছুটে গেল চোখেমুখে মি সা ই লের গতিতে,
‘কেমন ধরণের কথা বলো এসব! তোমার কথা শুনলে মানুষ বলবো তুমি কত দুঃখেই না আছো। তোমারে কত যন্ত্রণাই না আমরা দেই। দুঃখের পাহাড় বুকে।’
নুপুর হাসল, ‘পাহাড় নেই বলছেন?’
মুধুবালা দেবী কিছুটা থতমত খেলো। কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘হয়েছে, আর সর্বনাশ করতে হবে না। যাও ঘরে। বাকি রান্না ঠাকুরঝি শেষ করবে।’
‘হাঁটুর চুল পুড়ে পিঠে চলে এলো। আমার কত শখের চুল ছিল আপনি তো জানতেন তাই না? তবুও আপনার কোনো হাপিত্যেশ নেই। কেবল আমার শরীর পুড়ে গেলে তার দায়ভার আপনাদের ঘাড়ে পড়বে বলে সব চিন্তা। আর অন্তর যে পুড়ে ছাই সে বেলা? অন্তরের ফোসকা দেখা যায় না বলে তার দায় অস্বীকার করে ফেলেন তাই না?’
প্রশ্ন করে হাসল নুপুর। মুধুবালা দেবী ছেলের বউয়ের প্রশ্নে বিব্রতবোধ করল। কথা আগানোর শব্দ না পেয়ে রান্নাঘর ত্যাগ করল। নুপুর পিসিমার দিকে একবার তাকিয়ে ছুটে ঘরে চলে এলো। এত মন খারাপ নিয়ে আসলে বাঁচা যায় না।
কুমার ঘরে বসে ল্যাপটপে আঙুল চালাচ্ছে ব্যস্ত গতিতে। তার প্রচন্ড ধ্যান ল্যাপটপের স্ক্রিনে। কানে ইয়ারফোন। গান শুনছিল বোধহয়। হুট করে ঘরে কারো পায়ের অস্তিত্ব পেতেই মাথা তুলল। চোখ তুলতেই বিক্ষিপ্ত নারী চরিত্র নুপুরকে দেখতে পেল। মুখ চোখে মেয়েটার আতঙ্ক। কুমার ভ্রু নাচালো, ‘কী হয়েছে? ভূত দেখলেন না-কি দিনে-দুপুরে?’
নুপুর বাঁকা চোখে তাকাল। কুমারকে দেখলে তার মন খারাপ হুর হুর করে বাড়ে সবসময়। আজও ব্যতিক্রম হলো না। মন খারাপ বাড়লো নিমিষেই। ব্যাকুলতা নিয়ে শুধাল, ‘ল্যাপটপে কী করছিলেন? প্রাক্তনের ছবি দেখছিলেন?’
কুমার প্রকৃতপক্ষে কাজ করছিল। নিত্যান্তই, একদম গোপনে মাঝেসাঝে সে প্রাক্তনের আইডি সার্চ করে ঘাটে। তা জানে নুপুর। তাই বলে সবসময় আইডিতে পড়ে থাকবে এমন ভাবাটা কি উচিত? মোটেও নয়। কুমারের কিঞ্চিৎ রাগ হলো তাই। রাগ ধরে রেখেই বলল,
‘হ্যাঁ।’
নুপুরের ব্যাকুলতা মুষড়ে পড়ল। আহত চোখে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। কুমার মুখ ঘুরিয়ে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ নিবদ্ধ করল। নুপুর আনমনে কি যেন ভাবল তারপর আসক্তিহীন গলায় বলল,
‘আপনার আমার মাঝে সবচেয়ে বেশি পছন্দের জিনিস কী? আমার চুলগুলো তাইনা?’
হুট করে নুপুরের এমন প্রশ্নের মানে বুঝলো না কুমার। তাই তাকিয়ে রইল অবাক নয়নে। সংশয় নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’
কুমারের হ্যাঁ বলতে দেরি কিন্তু নুপুরের পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে দেরি হলো না। সে ছুটে গিয়ে ড্রয়ার থেকে কেঁচি বের করেই ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কেটে ফেললো পুড়ে যাওয়া চুল গুলো। চোখের পলকে পুড়ে গিয়ে অবশিষ্ট থাকা পিঠ সমান চুল গুলো ছোটো হয়ে কাঁধ সমান হলো। কুমার তাকিয়ে রইল বোকার মত। বুঝে উঠতে পারলো না হুট করে কি হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে আবছা স্বরে বলল,
‘কী করলেন!’
নুপুর হেসে তাচ্ছিল্য করে জবাব দিল, ‘যে আমার যাতনার খোঁজ রাখে না তার পছন্দের জিনিস আমি কেন রাখবো?’
‘কিন্তু চুল গুলো তো আপনারও পছন্দের ছিল।’
‘না তো! কে বলেছে আমার পছন্দ ছিল?’
কুমার দু'কদম এগিয়ে এসে অবাক নিয়ে বলল, ‘পছন্দ ছিল না? তবে যত্ন করতেন কেন?’
‘আপনার জন্য। ভেবেছিলাম চুলের উছিলায়ও যদি আপনার একটু করুণা পাই!’
‘তাহলে আজ করুণার আশা ছাড়লেন কেন?’
‘চুল গুলো পুড়ে গেছে চুলার আগুন লেগে। অথচ আপনি খোঁজ রাখলে তো! পুরো দুনিয়া ভুলে আপনি তো এক প্রাক্তনেই নিমজ্জিত। বর্তমান দেখার আর সময় কই?’
কুমার যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। চুলে আগুন লেগে গিয়েছিল ঘটনাটা তো সে জানতোই না! তাই বলে মেয়েটা চুলগুলো কেটে ফেলবে? এত রাগ তার!
‘চুলে আগুন ধরেছিল তাই বলে চুল সবগুলোই কেটে ফেলবেন!’
‘চুলে আগুন ধরেছে সেটা তো বাহ্যিক। চুলে আগুন ধরাতে চুল কাটিনি। আসলে মনে আগুন ধরাতে চুলটা কেটেছি।’
‘মনেও আগুন ধরে?’
‘আপনার মতন স্বামী পেলে ধরেই।’
‘আমার মতন স্বামী পেয়ে আপনার অনেক দুঃখ তাই না?’
‘তা আর বলতে! যার জীবনে অতীত বড়ো তার জীবনে কখনোই তো আমি আসতে চাইনি।’
‘আমি কি কখনো আপনার সামনে অতীতকে এত বেশিই প্রাধান্য দিয়েছিলাম? কেন তাহলে অভিযোগ?’
কথার ঘাত-প্রতিঘাতে আর এগুলো না নুপুর। কেবল চুল গুলো ফ্লোরে ফেলে দিয়ে বিবশ কণ্ঠে বললো,
‘কাকে প্রাধান্য দিবেন আর কাকে দিবেন না তা যদিও আপনার ব্যাপার তবুও আপনি আমায় বাদে আর কাউকে প্রাধান্য দিলে আমার খারাপ লাগে। নিজেকে ছোটো লাগে।’
আর কথা বাড়লো না। তার আগেই নুপুর ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি ডেঙ্গিয়ে ছাদে চলে গেল। আকাশ মেঘলা। গমগমে ধ্বনিতে ডাকছে অনবরত। চারপাশ মুখরিত সেই ডাকে। ক্ষণে ক্ষণে রুপোলি আলোয় বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
নুপুরের মনে হল মনের সাথে আকাশের একটি সাদৃশ্য রয়েছে। মনের তালে তালে পরিবর্তন হয় তার রঙ। এই যে আজ নুপুরের মন ভালো নেই তেমনি মন ভালো নেই আকাশের। হয়তো এই বিশাল আকাশটা নুপুরের সঙ্গী হতে চায়।
আকাশ চিরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়তে লাগল। নুপুর দু’হাত মেলে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
'বৃষ্টি তুমি মুছে দিও তার দুঃখ, যে আমায় ভালোবাসতে পারেনি কভু।'
কথা শেষ হতেই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া নুপুর অনুভব করল তার পায়ে কারো হাতের ছোঁয়া। বেশ চমকে গেল সে। ভড়কে গিয়ে চোখ নামাতেই দেখল পায়ের কাছটায় বসে আছে কুমার। সাদা পাঞ্জাবি শরীরে। মিনিট খানেক আগেও তো লোকটার শরীরে গেঞ্জি ছিল। হুট করে পাঞ্জাবি পরল কেন?
তাছাড়া এখানে, পায়ের কাছেই বা করছে কী?
নুপুরের মনের প্রশ্নের উত্তর মিলে গেল তৎক্ষণাৎ। বৃষ্টির জলে ধুয়েমুছে যাওয়া আলতার দিকে চোখ যেতেই চক্ষু তার ছানাবড়া হয়ে গেল। স্তম্ভিত কণ্ঠে বলল, ‘করছেন কী! আমাকে আলতা দিয়ে দিচ্ছেন কেন? পাঞ্জাবিই-বা পরেছেন কেন?’
কুমার জবাব দিল না। এক মনে আলতা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আলতার কৌটাটা রাখল রঙচটা রেলিং-এ। তার এক হাতের মুঠোয় থাকা অনেকক্ষণ যাবত চেপে রাখা, চুপসে যাওয়া কাঠগোলাপটা নুপুরের কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
‘তেমন কিছুই করছি না। একটি মেয়ের অভিযোগ আমি নাকি তার কোনো কথাই জানি না, মানি না, রাখি না। তাই মেয়েটিকে জানাতে এলাম— তার বৃষ্টিস্নানের কথা আমি জানি। আলতা পায়ে দিয়ে, পাঞ্জাবি পরা পুরুষের সাথে শখের বৃষ্টিস্নানের আকাঙ্ক্ষার কথা আমি জানি। তাইতো আলতা নিয়ে ছুটে এলাম কত দ্রুত। মেয়েটি কি এবার মানবে— আমি তাকে ভালোবাসি? একটু মানবে কি?’
দূরে বজ্রপাত হলো। কেঁপে উঠলো নুপুরের দেহ। শাড়ি ভিজে লেপটে গেছে শরীরে। বৃষ্টির জল ভীষণ ঠান্ডা লাগছে যেন হুট করেই। এতক্ষণ লাগেনি। না-কি মনের আগুন নিভে যাওয়ায় এত ঠান্ডা লাগছে চারপাশ?
কুমার হাসলো অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা নুপুরকে দেখে। আলগোছে নিজের হাতের মুঠোয় তার হাত টেনে নিতে নিতে বলল,
‘আর প্রাক্তনের ছবি দেখবো না কানে ধরলাম। এবার চুলগুলোর যত্ন কেবল নিজের জন্য নিবেন কেমন? কারণ আমি আপনায় ভালোবাসি। কেবল চুলগুলোকে নয়, পুরো আপনাকেই ভালোবাসি।’
[সমাপ্ত]
#বৃষ্টিস্নান
কলমে: মম সাহা