02/12/2025
আমি তো টিকিট কাইটটাই উঠছিলাম। ৫০ টাকা লস!
আমরা শিক্ষিত হইলাম 🫡 মানুষ হইলাম না 😅
শহরের বুকে ঝকঝকে মেট্রোরেল। আধুনিকতার প্রতীক। সেই স্টেশনের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসিন। পরনে ধূলিমলিন জামা, কিন্তু পকেটে তার ‘পরিশ্রমের’ টাকা। সারাদিন ভিক্ষা করে জমানো ৫০ টাকার একটা নোট।
ইয়াসিন কাউন্টারে হাত বাড়াতে পারে না। সে এক আঙ্কেলকে গিয়ে বলল, "আঙ্কেল, আমি ঢাকা যামু। আমারে একটু টিকিট কাইটটা দ্যান।" আঙ্কেল হয়তো ঘৃণাভরে তাকিয়েছিলেন, কিন্তু টিকিটটা কেটে দিয়েছিলেন। ইয়াসিন ভাবে, সে আজ আর পথের ফকির নয়, সে আজ প্যাসেঞ্জার। সে নিয়ম মেনেই ট্রেনে চড়বে।
ট্রেন এল। দরজা খুলল। কিন্তু ভেতরে এ কী অবস্থা! মানুষ আর মানুষ। দম বন্ধ হয়ে আসে ইয়াসিনের। সে তো এভাবে অভ্যস্ত নয়। সে অভ্যস্ত আখাউড়ার লোকাল ট্রেনের ছাদে, যেখানে হু হু করে বাতাস লাগে গায়ে। ভেতরে কেউ একজন ধমক দিল, "এই পিচ্চি, সর!" ইয়াসিনের আর ভালো লাগে না। সে মনে মনে বলে, "দরজা বন্ধ, বাতাস খাইতে পারি না। এইডাতে কেমনে যায়?"
তার চোখ পড়ে দুই বগির মাঝখানের সংযোগস্থলে। সেখানে মইয়ের মতো গ্রিল, পাশে একটু ফাঁকা। ব্যস, ইয়াসিনের মাথায় খেলে গেল তার ভাই ইমনের শেখানো সেই ‘মন্ত্র’। ইমন ভাই, যে কি না ‘বড় ডাকাত’, সে ইয়াসিনকে শিখিয়েছিল—"চলন্ত ট্রেনে কেমনে উঠবি, কেমনে নামবি। গ্রিল শক্ত কইরা ধইরা রাখবি। চাঁদপুরে নামবি না, গ্রিল ছাড়বি না।"
ইয়াসিন ভাবে, "ধুর! আমার তো ট্রেনিং আছে। এই মেট্রো আর এমন কী!" সে ভিড় ঠেলে ফাঁক গলে বেরিয়ে এল। ট্রেনের বাইরের শক্ত গ্রিলটা ধরল। ট্রেন চলতে শুরু করল। বাতাসের ঝাপটা মুখে লাগতেই ইয়াসিন হাসল। সে জানে না, তার মাথার ওপরেই ১৫০০ ভোল্টের মরণফাঁদ। সে জানে না, এই ট্রেন আর আখাউড়ার ট্রেন এক নয়। সে শুধু জানে—তার ট্রেনিং আছে, সে মরবে না।
পরের স্টেশনেই ধরা পড়ল সে। পুলিশ, আনসার, উৎসুক জনতা ঘিরে ধরল তাকে। সবার চোখে আতঙ্ক, কিন্তু ইয়াসিনের চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
অফিসার ধমক দিয়ে বললেন, "তুমি জানো তুমি মরে যেতে পারতে?" ইয়াসিন নির্বিকার। পকেটে হাত দিয়ে বলল, "মরতাম না স্যার। আমার ট্রেনিং আছে।" অফিসার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কিসের ট্রেনিং? কে দিয়েছে?" ইয়াসিন গর্ব করে বলল, "আমার ভাই ইমন। হেয় বড় ডাকাত। হেয় শিখাইছে কেমনে গ্রিল ধরতে হয়।"
পুলিশ তাকে ভয় দেখায়, "তোমাকে এখন জেলখানায় আটকাব। হাতে পায়ে ডান্ডাবেরি পরাব। মারব।" ইয়াসিন হাসে। তার হাসিতে কোনো ভয় নেই। সে উল্টো পুলিশকে বুঝিয়ে দেয় জীবনের সরল সমীকরণ। "আটকাইবেন? আটকান। কোনো সমস্যা নাই। আমি অন্যায় করছি, আমার শাস্তি হইব। কিন্তু জেলে নিলে তো কামই। কাম করুম, খামু আর ঘুমামু। এইডাই তো আমার কাম।"
উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। যে ছেলে জেলখানাকে ‘খাওয়া আর ঘুমানোর’ নিরাপদ আশ্রয় মনে করে, তাকে আপনি কীসের ভয় দেখাবেন? তার মা নেই, বাবা নেই, ঠিকানা বলতে সে চেনে শুধু ‘পথ’। তার কাছে পুলিশ, জেল, মার—সবই জীবনের রুটিন।
ইয়াসিনকে যখন পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে, তখন সে একবারও নিজের জন্য কাঁদেনি। সে শুধু বলেছিল, "আমি তো টিকিট কাইটটাই উঠছিলাম। ৫০ টাকা লস!"
সারকথা: শুধু প্রযুক্তি দিয়ে দেশ আগাবে না, যদি না সেই প্রযুক্তির ব্যবহারকারী মানুষগুলোকে আমরা শিক্ষিত ও সচেতন করতে পারি। ইয়াসিনের ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—চকচকে মেট্রোরেলের নিচে এখনো অন্ধকার বস্তির মানসিকতা রয়ে গেছে।
©