11/08/2025
লেখকের কথা
প্রাক-ব্রিটিশ আমল এবং ব্রিটিশ আমলে বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস পরস্পর বিপরীতমুখী। সুলতানী ও মুঘল আমলে মুসলমান সমাজ যতটা অগ্রগতি সাধন করতে পেরেছিলো, ব্রিটিশ আমলে তা থমকে যায়। ব্রিটিশ শাসনের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ শাসকদের শাসননীতি সম্পূর্ণভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর পক্ষে গিয়েছিলো এবং তারা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছিলো। এর ফলে অটোমেটিক বাংলার মুসলমান সমাজের অবস্থান রাষ্ট্রীয় জায়গায় তো বটেই, সামাজিকভাবেও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিলো।
রাষ্ট্রে নিজেদের হিস্যা বুঝে নিতে এবং সামাজিকভাবে নিজেদের পুনর্গঠন করতে বাংলার মুসলমানের জন্য জাগরণ / পুনর্জাগরণ ছিল একপ্রকার অনিবার্য। এই অনিবার্য জাগরণের সূচনা হয় ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম সিপাহী বিদ্রোহের পর। সশস্ত্র সংগ্রাম সাময়িকভাবে ব্যর্থ হবার পর মুসলমানদের প্রায় সকল পক্ষ একমত হয় যে, সামাজিকভাবে নিজেদের পুনর্গঠন করে রাষ্ট্রীয় হিস্যা নিশ্চিত না করতে পারলে মুসলমানদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংগঠন— সর্বোপরি সকল উপায়েই চেষ্টা শুরু হলো। স্যার সৈয়দ আহমদ লিখে, বক্তৃতা দিয়ে মুসলমানদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ইংরেজদের ভাষা, রাষ্ট্রনীতি কবুল করে নিয়েই মুসলমানদের এগিয়ে যেতে হবে। মুসলমান সমাজে যতজনই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন ও সরকারের সাথে যুক্ত ছিলেন প্রায় সবাই এই নীতি কবুল করে নিয়েছিলেন। বাংলায় এই নীতির বাস্তবায়নে সিরিয়াসলি কাজ শুরু করেছিলেন নবাব আবদুল লতিফ।
এভাবেই বাংলার মুসলমানদের সামাজিক পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রে নিজেদের হিস্যা বুঝে নেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়, উনিশ শতকের শেষদিকে। ঠিক তখনই হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হয় গো-রক্ষিণী সভা, গো-রক্ষা আন্দোলন— গরু রক্ষার কর্মসূচি। হিন্দু সমাজের যে কাস্ট সিস্টেম তাতে তাদের যে কোনো দাবি-দাওয়া সাধারণত উচ্চবর্ণের বাবুদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। গরু রক্ষা কর্মসূচিতেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই কর্মসূচি প্রায় পুরোটাই কুক্ষিগত ছিল জমিদারদের মধ্যে, উচ্চবর্ণের বাবুদের সহায়তায়। গরু রক্ষা আন্দোলন মূলত হিন্দুদের ধর্মরক্ষার অংশ হিসেবেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ধর্মরক্ষার চেয়ে জমিদারদের স্বার্থরক্ষা ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের ঢাল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।
কেবল ব্রিটিশ আমলে নয়, বরং এই ভূখণ্ডে মুসলমানরা সংগঠিত হবার শুরু থেকেই গরু জবাই নিয়ে আপত্তির মুখে পড়েছে। বাংলায় সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সুফি হজরত শাহজালালের আগমন ও সিলেটে বসবাসের পেছনে গরু জবাইয়ের অধিকার হরণের ঘটনা জড়িত। হজরত শাহজালালেরও পূর্বে আসা সুফি, বাবা আদম শহীদ রাজা বল্লাল সেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, গরু জবাইয়ের ইস্যুতে। এই ঐতিহাসিক সূত্রগুলো তো আগে থেকেই মুসলমানদের মাথায় ছিল, সাথে যুক্ত হয়েছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর গরু রক্ষার সাংগঠনিক কার্যক্রম। সময়টাও খেয়াল রাখা জরুরী, যখন মুসলমানরা পুনর্জাগরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রে নিজেদের হিস্যা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। মুসলমানদের গরু জবাইয়ের অধিকারের বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজের যে সাংগঠনিক কার্যক্রম তাকে মুসলমানরাও সিরিয়াসলি নিলো। বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের সুসংগঠিত করলো গরু রক্ষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করতে। বিশেষত, মীর মশাররফ যখন হিন্দু সমাজের গরু রক্ষা আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে লেখা শুরু করলেন, তারপর মুসলমান সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া ছিল ঐতিহাসিক এক ঘটনা। ব্রিটিশ আমলে বোধহয় সেই প্রথম ইভেন্ট, যেখানে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান ব্যক্ত করতে পেরেছিলো। যার ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ শাসকরাও মুসলমানদের স্বতন্ত্র স্বার্থ নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছিলো।
এই বইতে আমরা সেই ঐতিহাসিক ইভেন্টের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বিশেষত গরু রক্ষা আন্দোলনে জমিদারদের ভূমিকা এবং তাদের আর্থ-সামাজিক স্বার্থ কিভাবে জড়িয়ে পড়েছিলো। মুসলমানদের অধিকারবিরোধী আন্দোলনে মীর মশাররফের সংহতিকে কেন্দ্র করে মুসলমান মধ্যবিত্তের যে ঐক্যবদ্ধ লড়াই, মামলাসহ, এ বিষয়েও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
আমরা দাবি করছি না যে, কোনো ঐতিহাসিক তথ্য আমরা আবিষ্কার করেছি কিংবা নতুন কোনো তত্ত্ব হাজির করেছি। চেষ্টা করেছি, এই ঐতিহাসিক ইভেন্ট নিয়ে যেসব লেখাপত্র পাওয়া যায় তার বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপন করতে। পাঠকরা যেন দলিল থেকে নিজেরাও চাইলে আরো পয়েন্ট আউট করতে পারেন সেজন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংযুক্ত করা হয়েছে। উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে লেখকের বানান হুবহু রাখা হয়েছে; মীর মশাররফের গো-জীবন’র বানান হুবহু রেখে দিলে পাঠক ক্ষেত্রবিশেষ নাও বুঝতে পারেন এই ধারণায় কিছু বানান চলনসই করা হয়েছে।
—লেখকের কথা থেকে
মোহাম্মদ আবু সাঈদ