
19/05/2025
#তোমাকে_ভালোবাসি_হে_নবী
#লেখক_গুরু_দত্ত_সিং
#হাফেজ_আরিফুল_ইসলাম
পর্ব 01
আরবে প্রত্যেক গোত্রের ছিলো স্বতন্ত্র বসবাস। কেননা আরব হলো মুরুভূমি ও পাহাড়-পর্বতের দেশ। বিরাট জনবসতি, কিংবা শহর-নগর গড়ে ওঠা তাই সম্ভব ছিলো না সেখানে। এমন কি সাধারণ লোকালয় গড়ে ওঠাও ছিলো অসম্ভব। কোথাও একটু পানির খোঁজ, কিংবা সবুজের সামান্য আভাস পাওয়া গেলে সেখানেই তাঁবু টানিয়ে নেমে পড়তো 'মরুভূমির জাহাজে' ভেসে বেড়ানো পুরো দল। এভাবে গড়ে উঠতো ক্ষুদ্র একটা বস্তি, যার স্থায়িত্ব নির্ভর করতো পানি ও সবুজ ঘাসের উপর। মক্কাবাসীদের এই ছিলো জীবনধারা। আশপাশের বস্তিগুলোরও ছিলো একই অবস্থা।
নিয়মতান্ত্রিক কোন রাজা বা রাজ্য ছিলো না মক্কায়। বড় বড় গোত্র থেকে দশ সদস্যের নির্বাচিত পঞ্চায়েতই স্থানীয় বিচার ও শাসন পরিচালনা করতো। পবিত্র কাবাগৃহের তত্ত্বাবধায়কও নিযুক্ত হতো তাদের মধ্য থেকে। দীর্ঘকাল ধরে বহাল ছিলো এ আন্তগোত্রীয় ব্যবস্থা, যা মক্কাবাসীদের কাছে অলিখিত বিধানের মর্যাদা লাভ করেছিলো।
এর মধ্যে মক্কায় একবার বাইরের হানাদার বাহিনীর হামলা হলো। হযরত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রপিতামহ হাশিম তাদের সফল মোকাবেলা করলেন এবং বিপর্যস্ত হানাদার বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলো। মহাসংকটকালের এই বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকার মাধ্যমে হাশিম গোত্রীয় বীরের মর্যাদা লাভ করেছিলেন এবং মক্কায় তাঁর একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এমন কি মক্কাবাসীদের কাছে হাশেমীদের এ অনন্য মর্যাদা উত্তরাধিকার-স্বীকৃতি লাভ করেছিলো।
হযরত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতা হযরত আব্দুল্লাহ চব্বিশ বছর বয়সে বিবি আমেনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। আরবের অভিজাত গোত্রের অভিজাততম হাশেমী পরিবারের এবিবাহ বেশ ধূমধামের সাথেই সম্পন্ন হলো। গুণ ও চরিত্র মাধুর্যে বিবি আমেনা ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত নারী সমাজের আদর্শ। স্বর্গীয় সৌন্দর্যের এক জ্যোতির্বলয় বিরাজমান ছিলো তাঁকে ঘিরে। তাই ছোট বড় সকলেই সশ্রদ্ধ সম্বোধন করতো তাঁকে। এক অনাবিল দাম্পত্য সুখের মাঝে উভয়ের দিন গুজরান হতে লাগলো। কিন্তু নিয়তি বড় নির্মম! সুখ ও শান্তির নিরবচ্ছিন্ন অবকাশ দিতে রাজী নয় কাউকে সে। তাই সুখের পায়রা ডানা মেলতে না মেলতেই নির্মম নিয়তির এক ঝাপটায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো মাটিতে। দুঃখের কালো ছায়া নেমে এলো বিবি আমেনার 'কুসুম-উদ্দাত' জীবনে। স্বামী আব্দুল্লাহ ব্যবসা উপলক্ষে সফরে বের হলেন। কিন্তু ফিরতি পথে মদীনায় পৌঁছে এমন অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, প্রাণ সংশয় দেখা দিলো এবং সত্যি সত্যি তাঁর শেষ সময় ঘনিয়ে এলো। আর সব মানুষের মতো তাঁকেও সাড়া দিতে হলো পরপারের ডাকে। মাত্র পঁচিশ বছরের তাজা যুবক আব্দুল্লাহ তখন। বিধাতার কী রহস্য-লীলা! স্বপ্নের পুষ্পকলি প্রস্ফুটিত হওয়ার পূর্বেই বিদায় নিলেন আমেনার 'জীবন মালঞ্চের মালাকর'।
হায় আব্দুল্লাহ! আগামীকাল যার শুভাগমনে ধন্য হবে মানব সমাজ, ধন্য হবে বিশ্বজগত, তাঁর পিতৃত্বের মহাগৌরব ললাটে ধারণ করেও চোখ জুড়িয়ে একটিবার দেখে যাওয়া হলো না তাঁকে। আবদুল্লাহ কি জানতেন যে, বিবি আমেনার গর্ভে তাঁর রেখে যাওয়া 'অংকুর' সুশীতল ছায়ার মহাবৃক্ষ হবে একদিন, অশান্ত মানবতা যাঁর আশ্রয়ে ছুটে আসবে শান্তির সন্ধানে, মহামুক্তির আকুতি নিয়ে! হায় আফসোস, যে গৃহকোণ থেকে উৎসারিত হবে 'সত্য-জলের পবিত্র গঙ্গা' এবং নিবারিত হবে লক্ষ কোটি তৃষ্ণার্ত আত্মার মহাসত্য সন্ধানের তৃষ্ণা, সে গৃহের গৃহী নিজে বিদায় হলেন আত্মার অনন্ত পিপাসার অসীম বেদনা নিয়ে!
অকাল 'বৈধব্যের চিতায়' দগ্ধ বিবি আমেনার শোকাহত হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, সে তো স্বাভাবিক, কিন্তু শতবর্ষের প্রান্তসীমায় পুত্র-শোকে আবদুল মুত্তালিবের করুণ অবস্থা ছিলো বর্ণনাতীত। সবার ছোট হলেও আবদুল্লাহ ছিলেন তাঁর প্রিয়তম পুত্র। সুতরাং এমন পুত্রশোক যার কলিজায় বিধেছে তার পক্ষেই শুধু সম্ভব এর গভীরতা অনুভব করা।৭নির্জন মরুভূমিতে আবদুল মুত্তালিব যখন রাতের তারাভরা আসমানে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন তখন হয়ত তিনি আসমানে যিনি আছেন নিরব ভাষায় তাঁকে বলতেন-
'বুড়ো বাবার কলজেপোড়া গন্ধ কি তোমার এতই ভালো লাগে হে জগত-নিয়ন্তা! নইলে তরতাজা পুত্রকে আমার কেন ছিনিয়ে নিলে এমন বয়সে, এমনভাবে। তার আগে যদি আমাকে তুলে নিতে তাহলে তো পুত্রশোকের এ নরকযন্ত্রণা আমাকে ভোগ করতে হতো না। আর তো পারি না প্রভো! এবার সাঙ্গ করো তোমার এ কৌতুক-লীলা, নিভিয়ে দাও আমার জীবন প্রদীপের এ নিভু নিভু শিখা।'
কিংবা হয়ত তাঁর অনুযোগ ছিলো আরো করুণ, আরো মর্মস্পর্শী, যা প্রকাশ করার 'যথাশব্দ' মানুষের ভাষায় আজো তৈরী হয়নি। তাই শুধু প্রার্থনা করি, হে বিধাতা! এমন পুত্রশোক কোন কালে, কোন দেশে, কোন মানুষকে আর দিও না তুমি।
একদিকে ছিলো বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিবের এমন করুণ অবস্থা, অন্যদিকে বিধাতার ইঙ্গিতে ফিরেশতালোক থেকে যেন ভেসে আসছিলো এই সুমধুর সান্ত্বনাবাণী-
'শান্ত হও বৃদ্ধ! শান্ত হও। বিধাতার অসীম করুণা সম্পর্কে কেন তোমার এত নিয়াশা! কেন এমন ধৈর্যচ্যুতি! কত বড় সৌভাগ্য তোমার অপেক্ষায় রয়েছে জানো তা! অন্তর্দৃষ্টি মেলে দেখো, ললাটে তোমার এক অক্ষয় তিলক এঁকে দেয়ার জন্য ভগবানের কৃপায় কী বিপুল আয়োজন চলছে স্বর্গরাজ্যে! যে নূরের রোশনিতে দূর হবে গোটা আরবের অন্ধকার, তোমারই ঘরে যে হবে সে নূরের প্রথম উদ্ভাস! পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে সুদূর ভারত ভূমিকেও আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দেবে যে নও হেলাল, তার শুভোদয়-লগ্ন যে সমুপস্থিত! যে মুক্তিদূতের আবির্ভাব-প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে বিশ্বজগত, তিনি যে তোমারই ঘরে আসছেন 'শিশু জাদুকর' হয়ে! যে মুআজ্জিনের কণ্ঠ-বাণী সাফা পাহাড়ের চূড়া থেকে হিমালয়ের পর্বত শৃঙ্গে প্রতিধ্বনিত হবে, তিনি যে তোমারই বংশধর। যাঁর পবিত্র নামের নূরনূরানিয়াতে তোমারও নাম হবে চিরউজ্জ্বল, চিরঅমর, তিনি যে আসছেন তোমারই ঘরে, তোমার পুত্রবধুর কোলে।বিনিময়ে পুত্রশোকের ক্ষুদ্র কোরবানীতে কেন তোমার এতো কুণ্ঠা, এতো অনুযোগ!'
সূরাতুল 'বাকারাহ'র পনেরতম রুকুতে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর এরূপ দু'আ বর্ণিত হয়েছে-
'হে আমার প্রতিপালক! মক্কাবাসীদের মাঝে তাদেরই একজনকে নবীরূপে প্রেরণ করুন।'
'সূরাতুস-সাফ' এর পথম রুকুতেও অনুরূপ দু'আর উল্লেখ রয়েছে।
বাইবেল যোহনের এক অধ্যায়ে হযরত ঈসা (আঃ)ও স্বজাতিকে সুসংবাদ দিয়ে বলেছেন-
'আমার পর এক নবীর আবির্ভাব হবে যাঁর নাম হবে আহমদ।'
স্বয়ং হযরত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
'আমি হলাম দাদা ইবরাহীমের দু'আ এবং ভাই ঈসার সুসংবাদ।'