24/03/2025
পারগয়ড়া বাজার : ফুটবলের বাঁশিতে জেগে ওঠা এক বাজারের গল্প
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার একটি প্রাণবন্ত গ্রাম পারগয়ড়া। প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন এই গ্রামটিকে অনেকেই মজার ছলে গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নের "রাজধানী" বলে ডাকেন। তবে এই গ্রাম শুধু নামেই নয়, ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিক থেকেও বেশ সমৃদ্ধ। বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকে গড়ে ওঠা পারগয়ড়া বাজারের জন্মকাহিনি যেন এক রূপকথার গল্পের মতো।
বৃটিশ আমল থেকেই এই গ্রামের বেশ নাম ডাক রয়েছে। তবে এই গ্রামের একমাত্র বাজারটির জন্ম কিন্তু অনেক পরে। ১৯৯০ এর দশকের আগে বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত পারগয়ড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ ভবন (বর্তমানে আলোর ভুবন পাঠাগার), ডাকঘর (পোস্ট অফিস), গুমানীগঞ্জ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও এর সংলগ্ন কোয়াটার, একটি নাট্যমঞ্চ (এটি মূলত একটি অডিটোরিয়াম। যা বিডি হল নামে পরিচিত হলেও এটি ছিল মূলত নাট্যমঞ্চ। এটিকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হতো পারগয়ড়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থা। বর্তমানে ভবনটি পরিত্যক্ত), এরশাদ আমলে প্রতিষ্ঠিত কৃষি অফিস (বর্তমানে নেই) ছিল করতোয়া নদীর তীরে গোবিন্দগঞ্জ-দাড়িদহ সড়কের পাশে বর্তমান বাজার এলাকায়। সাথে কিছু ভাসমান দোকান দিনের বেলায় বসত রাস্তার পাশে। তবে স্থায়ী বাজার তখনও ছিল না।
১৯৯০-এর দশকের শুরু। সারা দেশ তখন বদলের হাওয়ায় দুলছে। আর সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া এসে লাগল এক ছোট্ট গ্রাম — পারগয়ড়া। বাজার বলতে তখন দু-একটি ভাসমান দোকান আর ধানের মাঠের পাশে চায়ের টং ঘর।
১৯৯০-এর দশকের শুরুর সেই সময়টা যেন আজও জীবন্ত হয়ে আছে পারগয়ড়ার মাটিতে। গ্রামের নিভৃত কোণ থেকে জন্ম নিয়েছিল এক অনন্য ইতিহাস — "শাহ আব্দুল হামিদ গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট"। এটি শুধু একটি ফুটবল প্রতিযোগিতা ছিল না; এটি ছিল পারগয়ড়ার আত্মপরিচয়ের এক নতুন সূচনা।
বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম স্পিকার প্রয়াত এডভোকেট শাহ আব্দুল হামিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পারগয়ড়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (পাসউস) উদ্যোগ নেয় এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের। তখনকার দিনে এমন আয়োজন এক অকল্পনীয় বিস্ময় হিসেবে ধরা দিয়েছিল। টুর্নামেন্টের মাঠে পা রেখেছিলেন সেসময়ের জাতীয় লীগের তারকা ফুটবলাররা, আর তাদের খেলায় মুগ্ধ হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষের ঢল নেমেছিল।
মাঠের চারপাশে বাঁশের তৈরি সাময়িক গ্যালারি, হাতে বানানো পতাকা, আর গ্রামের ছেলেদের ঢাক-ঢোলের শব্দ — মুখরিত থাকত পুরো পারগয়ড়া । গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোয় হাজার হাজার দর্শকের গগনবিদারী চিৎকারে বাতাস কেঁপে উঠত। বিকেলের রোদের আভায় বাঁশের গোলবারের সামনে গোল করার সেই মুহূর্তগুলো আজও বহু মানুষের মনে গেঁথে আছে।
টুর্নামেন্ট চলেছিল প্রায় তিন মাস ধরে। প্রতিটি দিন ছিল উৎসবের মতো। খেলা শেষ হতেই বাজারে জমে উঠত আড্ডা। ভাসমান চা দোকানের বেঞ্চিতে বসে খেলার বিশ্লেষণ চলত রাত অবধি।
পারগয়ড়ার ইতিহাসে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে এই এক ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে, যা শুধু খেলার আনন্দই দেয়নি, বরং একতা ও সমবায়ের শক্তি প্রদর্শন করেছে। টুর্নামেন্টটি পারগয়ড়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক চেহারা পাল্টে দিয়েছে।
খেলা হতো বিকেলে, আর সেসময় রাস্তার পাশে ভাসমান দোকানীরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসে যেত। চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান - একে একে দোকানগুলো খুলতে থাকে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে দর্শকদের ভিড় জমত। মানুষজন সন্ধ্যার পরও ভাসমান দোকানের বেঞ্চিতে চায়ের আড্ডায় মত্ত থাকত, আর দোকানগুলো গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকত।
তবে, তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না, তাই দোকানগুলো আলোকিত হত হারিকেন, কুপি বাতি, আর ল্যাম্পোর আলোয়। দীর্ঘদিন ধরে চলা টুর্নামেন্টের কারণে পারগয়ড়ায় ভাসমান দোকানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। টুর্নামেন্ট শেষ হলেও অনেক দোকানিই স্থায়ীভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে শুরু করে। । এরই ধারাবাহিকতায় অনেকেই স্থায়ী দোকান খুলে বসেন, আর সেখান থেকেই গড়ে ওঠে পারগয়ড়া বাজার।
সে সময়ের নিস্তব্ধ গ্রাম হঠাৎই জীবন্ত হয়ে ওঠে, যেন ফুটবল খেলা শুধু আনন্দ নয়, একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এই পরিবর্তন শুধু পারগয়ড়ার চেহারা বদলায়নি, এটি প্রমাণ করেছে যে, খেলা মানুষকে একত্রিত করতে পারে এবং অর্থনৈতিক জীবনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারে।
আজকের পারগয়ড়া বাজার শুধু পণ্য কেনাবেচার জায়গা নয়, এটি এক ইতিহাসের সাক্ষী। মাঠের প্রতিটি ঘাসের ডগায় লেগে আছে সেই সোনালি দিনের স্মৃতি, যখন ফুটবলের বাঁসিতে জেগে উঠেছিল পুরো গ্রাম। সেই টুর্নামেন্টের দর্শকদের করতালির শব্দ, রাতের অন্ধকারে ঝলমল করা হারিকেনের আলো, আর দোকানিদের হাসিমুখ যেন এখনও বাজারের বাতাসে ভাসে। পারগয়ড়ার গল্পটা তাই শুধু একটা গ্রামের গল্প নয়। গল্পটা ইতিহাসের, ঐতিহ্যের।
তথ্যসূত্র : জাকির হোসনে - তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, পাসউস
© মো. সাঈদ আল সাহাব
- ছবিটি বেশ অনেক দিন আগের