24/07/2024
ছবিটা আমার ঘরের জানালা থেকে তোলা। যে-ভবনটায় তিন বছর ধরে থাকছি, সেটা একটা গোরস্তানের সাথে লাগোয়া। গোরস্তানে কখনও নতুন ভবন উঠবে না, ফলে প্রচুর আলো-বাতাস পাব— এই লোভেই এখানে বাসা নিয়েছিলাম। গোরস্তানে পাঁচতলা-সমান উঁচু দুটো গাছ ছিল। বজ্রপাত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ একটা গাছ পুরোপুরি কেটে ফেলেছে, আরেকটার ডালপালা ছেঁটে দিয়েছে। এককালে গাছ দুটোয় সন্ধ্যায়-ভোরে অসংখ্য টুনটুনি-চড়ুই কিচিরমিচির করত। এই কিচিরমিচির শোনাও ছিল এই বাসা ভাড়া নেওয়ার আরেক কারণ। আশা পূরণ হয়েছে; গোরস্তানে কোনো ভবন ওঠেনি, আলো-বাতাসের ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছি। এই আলো, এই বাতাস কেউ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করছে না। এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে এখানে কবর দেওয়া হয়— মাসে গড়ে দু-একজন। তিন বছরে যত লোককে কবর দেওয়া হয়েছে, ফিরে তাকাইনি; গা-সওয়া হয়ে গেছে। কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেওয়া হলে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়, বিউগলের শব্দ শুনে তখন তাকাই; গার্ড অব অনারের পুরো প্রক্রিয়া দেখি।
কিন্তু শনিবারে এখানে কবর দেওয়া হয়েছে চলমান ছাত্র-আন্দোলনে যাত্রাবাড়িতে নিহত হওয়া এক তরুণকে, বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। মরদেহ কয়েক মিনিটের মধ্যে কবরে রেখে আতঙ্কিত স্বজনরা চলে গেছে। কবরে রাখার প্রাক্কালে এক-দেড় মিনিটের জন্য মুখমণ্ডল দেখানো হয়েছিল, মুখমণ্ডলজুড়ে ছিল ছোট-ছোট বরফকুচি। ছেলেটার মা ছাড়া আর কেউ কান্নাকাটি করেনি। সেই কান্নাও ছিল চাপা, মাপা এবং স্বল্পস্থায়ী। ওর সমবয়সী সবার মুখ ছিল শক্ত। চোখে পানি ছিল না একজনেরও, চোখ ঠিকরে আগুন বেরোচ্ছিল; এই চোখগুলো ছিল 'যে-জলে আগুন জ্বলে' কথাটার সার্থক প্রতিচ্ছবি। শোয়া থেকে উঠে বসে সেরেফ বাঁয়ে তাকালেই কবরটা চোখে পড়ে। অন্যান্য কবরের দিকে আলাদাভাবে কখনও তাকানো হয়নি। কিন্তু এই কাঁচা কবরটার দিকে তাকানো হয়ে গেছে অসংখ্যবার। রাতে দেখি, ভোরে দেখি; বৃষ্টির সময়ে দেখি, বৃষ্টি থামার পরে দেখি; ইচ্ছে করে দেখি, অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখি; দেখতে থাকি, দেখতে থাকি।
ইতিহাসের বাঁকবদল ঘটিয়ে ফেলা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজনের মরদেহ থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে একই সমান্তরালে শুচ্ছি-ঘুমাচ্ছি-জাগছি, জাগছি-ঘুমাচ্ছি-শুচ্ছি— ব্যাপারটা হজম করতে-করতে অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ছি।
কপি: আখতারুজ্জামান আজাদ