29/06/2025
মনু মিয়ার পরিচিতি ‘অন্তিম শয্যার কারিগর’ হিসেবে। মনের গহিনের পরম দরদ আর অপার ভালোবাসা দিয়ে সৃষ্টিশীল শিল্পীর মতো তৈরি করেন মুসলিম সম্প্রদায়ের শেষ ঠিকানা কবর।
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, দূর থেকে দূরান্তরে কারও মৃত্যু সংবাদ কানে আসা মাত্রই খুন্তি, কোদাল, ছুরি, করাত, দা, ছেনাসহ কবর খুঁড়তে বা তৈরি করতে সহায়ক সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে যান তিনি।
এ কাজে দূরের যাত্রায় দ্রুত পৌঁছতে নিজের ধানি জমি বিক্রি করে কয়েক বছর আগে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন মনু মিয়া।
সেই ঘোড়াটিই হয়ে ওঠে তার সহচর- যেটা নিয়ে দিনের আলো হোক কিংবা রাতের অন্ধকার, মানুষের মৃত্যুর সংবাদ পেলেই টগবগ করে ছুটে যেতেন। হাতে কোদাল, কাঁধে ফাতিলা কাপড়। চোখে নির্ভীক নিষ্ঠা।
মানুষের অন্তিম যাত্রায় একান্ত সহযাত্রীর মতো তিনি বাড়িয়ে দেন দুহাত।
এভাবেই কবর খননের কাজ করে তিনি পার করে দিয়েছেন তার ৬৭ বছরের জীবনের সুদীর্ঘ ৪৯টি বছর।
কোনো ধরনের পারিশ্রমিক কিংবা বকশিশ না নিয়ে এ পর্যন্ত খনন করেছেন ৩ হাজার ৫৭টি কবর।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে মনু মিয়া তার মাকে হারান। মায়ের কবরে বাবা, বড় ভাই আর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে একমুঠো মাটি দিয়ে তাকে শেষ বিদায় জানানোর সময়েও মনু মিয়া বুঝতে পারেননি, তাকে কতটা অসহায় করে চলে গেছেন মা!
খুব অল্পদিনেই যখন মায়ের অভাবটা বুঝতে শুরু করলেন, তখন থেকে মনু মিয়াও শামিল হলেন বদলে যাওয়ার মিছিলে।
কারও মৃত্যু সংবাদ শুনলেই তার মানসপর্দায় ভেসে উঠত মায়ের কথা।
অকৃত্রিম ভালোবাসার সেই মা মাটির ঘরের শেষ বিছানায়, কেমন কাটছে তার দিন? কেমন আছেন মা?
মাকে নিয়ে এসব খুব ভাবাত মনু মিয়াকে। ব্যাকুল হৃদয়ে মায়ের কবর জিয়ারতের জন্য ছুটে যেতেন কবরস্থানে।
এভাবে যাওয়া-আসা থেকেই স্থানীয় গোরখোদকদের সঙ্গে মনু মিয়া একদিন কবর খননের কাজে অংশ নেন।
প্রথম সে দিনের কথা বলতে গিয়ে মনু মিয়া বলেন, ‘আমি তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, আমি যেন আমার মায়ের শেষ ঠিকানাটা সাজিয়ে দিচ্ছি।
এরপর থেকে যখনই সুযোগ পেয়েছি, তখনই তাদের সঙ্গে কবর খননের কাজে অংশ নিয়েছি।
এভাবে একসময় এ কাজটার প্রতি আমার অন্যরকমের একটি ভালোলাগা জন্মে গেল।
কোনো কারণে যদি একটি কবরে শরিক হতে না পারতাম, মনে হতো কী যেন করা হয়নি।’
মনু মিয়ার উপলব্ধি ছিল- মানুষের অন্তিম শয়ানের কবরটি হতে হবে সুন্দর, নিখুঁত ও সৃষ্টিশীল।
কারণ মৃত্যু হচ্ছে জীবনের শেষ ঠিকানা। জন্মের একমাত্র শর্ত হলো মৃত্যু।
দুনিয়াদারিতে কত ক্ষমতা, ধন, সম্পদ। অন্তিম শয়ানে কিছুই দেওয়া যায় না। একমাত্র কাফনের কাপড় ছাড়া।
হাজারো মানুষের কবর খোঁড়া সেই মনু মিয়া আজ শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে সকালে ইন্তেকাল করেছেন।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মনু মিয়ার স্বজনেরা বলেন, জীবনভর কবর খোঁড়ার কাজ করতে গিয়ে নিজের দিকে খেয়াল হয়নি নিঃসন্তান মনু মিয়ার।
ফলে শরীরে নানা জটিল রোগ বাসা বাঁধে। রোগে কাবু হয়ে সম্প্রতি শয্যাশায়ী হন তিনি। গত ১৪ মে তাঁকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থতাবোধ করলে তাঁকে বাড়িতে নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু আজ সকাল থেকে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে যান, এরপর ইন্তেকাল করেন।
মনু মিয়ার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে তাঁর ভাতিজা শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি (মনু মিয়া) দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
সূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ, প্রথম আলো