15/12/2023
টিউশনি করানোর জন্য যে ছাত্রের বাসার দিকে যাচ্ছিলাম সে ছাত্রের সাথে আমার রাস্তায় দেখা। বাইকের পিছনের সিটে এক সুন্দরী রমণীকে বসিয়ে আমার ছাত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমাকে দেখেই সে তড়িঘড়ি করে বাইক চালিয়ে চলে গেলো। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, এখন ছাত্রের বাসায় যাবো কি যাবো না। কারণ ছাত্রতো আমার এখন মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এমন সময় ছাত্র আমায় ফোন দিয়ে বললো,
-- "স্যার, আল্লাহর দোহাই লাগে আজ বাসায় যাবেন না। কারণ আমি বাবা মাকে বলেছি আপনার ডায়রিয়া হয়েছে তাই আজ আপনি পড়াতে আসতে পারবেন না। এখন যদি আপনি বাসায় যান তাহলে আমার খবর আছে।"
ছাত্রের কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম,
-- "দুনিয়াতে কি অন্য কোন রোগ ছিলো না? শেষে কিনা ডায়রিয়া রোগী বানিয়ে দিলে। যায় হোক তা বাইক কোথায় পেলে?"
- "বাইকটা আমার এক বন্ধুর। আর পিছনে যে মেয়েটা বসা ছিলো সে একান্তই আমার নিজের গার্লফ্রেন্ড। ওরে নিয়ে একটু ঘুরার জন্যই আপনাকে ডায়রিয়ার রোগী বানিয়েছি"
আমি আমার ছাত্র সৈকতের কথা শুনে হাসতে হাসতে ফোনটা রেখে দিলাম।
আসলে ও এমনিতে খুব চঞ্চল হলেও পড়াশোনায় খুবই ভালো আর খুবই মেধাবী। তাছাড়া আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা ছাত্র শিক্ষকের না বরং বন্ধুত্বের।
পরদিন যখন ছাত্রকে পড়াতে যাই তখন ওর চুল টেনে বললাম,
-- "এখনো এইচএসসি পাস করো নি এর মধ্যেই গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছো? তা হেলমেট ছাড়া বাইক চালাও কেন? তাছাড়া এতো স্পিডে কি কেউ বাইক চালায়?"
ছাত্র হেসে বললো,
-- "স্যার, বাইকের পিছনের সিটে গার্লফ্রেন্ড বসলে বাইককে তখন বিমান মনে হয়। ইচ্ছে করে হাওয়ার গতিতে ছুটে যাই। সে যায় হোক, স্যার আপনি কখনো R15 বাইকটা চালিয়েছেন?"
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,
-- "না চালাই নি। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?"
- "আসলে বাবা বলেছে আমি এইচএসসি পরীক্ষার পর আমায় বাইক কিনে দিবে।তাই ভাবছিলাম এই বাইকটা নিবো"
আমি বললাম,
-- "সেটা পরে দেখা যাবে এখন পড়ায় মন দাও..."
পড়ানো শেষে যখন চলে যাবো তখন ছাত্রের বাবা আমায় ডেকে বললো,
-- "শুনলাম তোমার নাকি ডায়রিয়া হয়েছে? শরীরের অবস্থা এতোটাই খারাপ নাকি যে বিছানা নষ্ট করে ফেলেছো কয়েকবার।তা এখন শরীরের অবস্থা কেমন?"
কথাটা শুনে আমি যখন ছাত্রের দিকে রাগী চোখে তাকালাম তখন ও কোন রকম আমার সামনে থেকে চলে গেলো। আমি হালকা গলা কেশে বললাম,
-- "জ্বী এখন ভালো।আচ্ছা আংকেল শুনলাম সৈকতকে পরীক্ষার পর বাইক কিনে দিচ্ছেন?"
উনি হেসে বললো,
- "একমাত্র ছেলে আবদার করেছে না করি কিভাবে? আমার তো টাকা পয়সার অভাব নেই যে ছেলেকে একটা বাইক কিনে দিতে পারবো না। তাছাড়া সৈকত তো বাইক চালাতে পারে।"
আংকেলের কথা শুনে বললাম,
-- "আপনার টাকা আছে বলেই আপনি সন্তানকে বাইক কিনে দিবেন কিংবা সন্তান বাইক চালাতে পারে বলেই তাকে বাইক কিনে দিতে হবে বিষয়টা কিন্তু এমন না। বাইক চালানোর ক্ষেত্রে ম্যাচিউরিটির একটা বিষয় আছে। আমার মনে হয় না সৈকতের মাঝে সেই ম্যাচিউরিটিটা এসেছে। আপনি একটু বিষয়টা ভেবে দেখবেন।"
কথাগুলো বলে আমি চলে গেলাম—
আমার কথাগুলো সেদিন আংকেল বুঝতে পেরেছিলো কিনা জানি না। কিন্তু পরীক্ষার পরেই ছেলেকে তার পছন্দের বাইক কিনে দিয়েছিলো।
যেদিন সৈকতের রেজাল্ট দিলো সে সবার আগে আমাকে ফোন করে জানালো সে এ প্লাস পেয়েছে।তার ঘন্টাখানিক পরেই আমাকে ফোনে জানানো হলো সৈকত মারা গেছে। খবরটা পেয়ে পাগলের মতো ছুটে গেলাম ওদের বাসায় ।
বাসায় এসে দেখি মৃতদেহটা মেঝের উপর সাদা কাফনের কাপড়ে ঢেকে আছে। ছাত্রের মা শেষবারের মতো ছেলের মুখটা একবার দেখতে চাইছে কিন্তু কেউ উনাকে দেখতে দিচ্ছে না। আংকেলকে দেখলাম ছেলের রক্তেভেজা রেজাল্ট কার্ডটা নিয়ে পাথরের মতো সোফাই বসে আছে।
আমি মৃতদেহের পাশে বসে যখন কাফনের কাপড়টা সরালাম তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে বসে বমি করতে লাগলাম।
কেউ একজন এসে আমায় পানির বোতল দিয়ে বললো,
- "ভাই কোন সমস্যা?"
আমি মুখে কিছু না বলে হাতের ইশারায় বললাম কোন সমস্যা নেই, আপনি চলে যান।
লোকটা চলে গেলে আমি চোখে মুখে পানি দিলাম। এখন বুঝতে পারছি সৈকতের মাকে কেন শেষবারের মতো সন্তানের মুখটা দেখতে দিচ্ছে না। মুখ থাকলে তো দেখতে দিবে। শুধু গলা থেকে দেহটা পরে আছে। খুব চেষ্টা করছি নিজের কান্নাটা আটকে রাখতে কিন্তু পাচ্ছি না। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
সৈকতের এমন করুণ মৃত্যুর জন্য ওর মা বাবাও অনেকটা দায়ী। অনেক বাবা মা আছে নিজেদের সামর্থ্য থাকলেই সন্তান যা আবদার করে তা পূরণ করে দেয়। কিন্তু একটা বার ভেবে দেখে না সেটা সন্তানের জন্য ঠিক কিনা।দূর্ঘটনা কখনো বলে আসে না, তাই বলে নিজের আনম্যাচিউর ছেলের হাতে বাইকের চাবি তুলে দিয়ে তারপর নিজের কপালের দোষ দিবেন সেটা তো ঠিক না।
গতবছর বাইক এক্সিডেন্টে মারা যায় ২ হাজার ২১৪ জন যাদের প্রায় ৯০% তরুণ৷ এ বছর প্রথম চার মাসে এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৮৩০ জন এরাও প্রায় সবাই তরুণ৷মহামারীর নাম ❝ বাইক এক্সিডেন্ট ❞।
আপনার সন্তানকে তখনই বাইক কেনার পরামর্শ দিন যখন সে বাইকের দায়িত্ব নিতে শিখেছে৷পোষ্ট টা সব বাবাদের কাছে শেয়ার করে পৌছে দেন..।
াঁদ
কলমেঃ আবুল বাশার পিয়াস